বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর গরিব-হিতৈষী উন্নয়ন দর্শন

ড. আতিউর রহমান, শিক্ষাবিদ ও সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক

বঙ্গবন্ধুর গরিব-হিতৈষী উন্নয়ন দর্শন

তিনি তাঁর শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি’...

 

‘প্রত্যেক রবিবার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাউল উঠিয়ে আনতাম এবং এই চাউল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন। ঘুরে ঘুরে জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। আমাকেই অনেক কাজ করতে হতো তাঁর সাথে। হঠাৎ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তখন আমি এই সেবা সমিতির ভার নেই এবং অনেক দিন পরিচালনা করি। আর একজন মুসলমান মাস্টার সাহেবের কাছেই টাকা পয়সা জমা রাখা হত। তিনি সভাপতি ছিলেন আর আমি ছিলাম সম্পাদক।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ০৯)। এই কটি লাইনের মধ্যেই আমরা মানবিক এক অন্যরকম বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধুর বেড়ে ওঠা এমনই। প্রান্তজন তথা গরিব, বঞ্চিত মানুষের দুঃখের হাত ধরে। আর তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি গরিব মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। গরিবের উন্নয়নের কথা বলেছেন, তাদের রুটি ও রুজির কথা বলেছেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্যই ছিল এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। এ কারণে আমরা দেখতে পাই সেই ছোট্টবেলা থেকেই এবং পরবর্তীতে তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে এটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যেখানে গিয়েছেন সেখানেই উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন মানুষের উন্নয়নের কথা। নয়াচীন সফরে গিয়ে তিনি ওই দেশের খামারে গিয়েছেন। আর জানতে চেয়েছেন তাদের কৃষি, শিল্প ও শিক্ষানীতির কথা। কলকারখানায় গিয়েছেন। হঠাৎ চলে গেছেন শ্রমিকের বাড়িতে। তারা কেমন আছেন তা আগাম নোটিস ছাড়াই দেখতে গিয়েছেন। রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে পরম মমতায় আলাপ করেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর চীন সফর বিষয়ে লেখা বইটিতে এসব কথা ফুটে উঠেছে। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মাঝে বরাবরই প্রস্ফুটিত হয়েছে এটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার পায় এ দেশের সাধারণ মানুষ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে তিনি বিরাট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উন্নয়ন দর্শনে তিনি প্রথমেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। জেলা গভর্নরদের দুর্নীতি দূর করার জন্য বিশেষ আহ্বান জানিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি ভাষণেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াকু মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হন। তাঁর কূটনীতির বড় অংশ ছিল মানবিক। এই মানবিক কূটনীতির জোরেই তিনি এত দ্রুত বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে রাজি করাতে পেরেছিলেন। পেরেছিলেন ৪৪ হাজার কিউসেক পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করে গঙ্গাচুক্তি সম্পন্ন করতে। ’৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান-প্রণয়ন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) পুনর্গঠন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, নতুন ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ মোট ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ, দুস্থ মহিলাদের কল্যাণে নারী-পুনর্বাসন ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফসহ প্রায় ৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ, কৃষকের মাঝে দেড় লাখ গাভী ও ৪০ হাজার সেচ পাম্প বিতরণ এবং ব্যাপক কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ প্রবর্তন করেন। এ ছাড়া বিনা/স্বল্প মূল্যে কৃষকের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক-বিমার ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও সেসব চালুর মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বঙ্গ শিল্পকারখানা চালুসহ একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর কৈশোর ও তারুণ্যের দিকে একটু তাকানো যাক। ১৯৩৭ সালে শেখ মুজিব বাবার কর্মস্থল গোপালগঞ্জে মিশন স্কুলে ভর্তি হন। সে বয়সেই তিনি তাঁর শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি’। উদ্দেশ্য গরিব ছাত্রদের সেবা করা। সেজন্য আশপাশের বাড়ি থেকে মুষ্টি-ভিক্ষার চাল ওঠাতেন। ১৯৩৮ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ সফরে এসেছিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মিশন স্কুল পরিদর্শন করেন। সেখানেই তাঁদের আগমন উপলক্ষে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা বালক শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর সাংগঠনিক সক্ষমতা দেখে মুগ্ধ সোহরাওয়ার্দী তাঁকে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। ’৩৯ সালে কলকাতায় তাঁদের দেখা হলো। এভাবেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। হলেন গোপালগঞ্জ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক। লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতি করতে থাকেন তিনি। ’৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফের গেলেন কলকাতায়। সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হলেন। স্থানীয় মুসলিম লীগ সংগঠনেও তিনি বড় ভূমিকা রাখলেন। ’৪৩ সালে শুরু হলো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। লাখ লাখ লোক মারা যায়। সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষকে বাঁচানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। ... দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোন দিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোন দিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।’ ওই দুর্ভিক্ষপীড়িত দুঃখী মানুষের দুঃখে তিনি কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন তা তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ফুটে উঠেছে।

এরপর মুসলিম লীগ রাজনীতির নানা উত্থান-পতন শেখ মুজিব খুব কাছে থেকে দেখেছেন। দাঙ্গাপীড়িত মানুষদের বাঁচানোর জন্য তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে সুদূর আসানসোল গিয়ে ত্রাণশিবির খুলেছিলেন। এর আগে ১৯৪৬ সালে সিলেট গণভোটে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়ে কৃষককে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতিসহ সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন হবে বলে তিনি করিমগঞ্জে সভা করেছেন। মানুষকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছেন। ’৪৭ সালে পাকিস্তান হলো। তিনি ফিরে এলেন পূর্ব বাংলায়। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। ’৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গড়লেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। শুরু করলেন ছাত্র রাজনীতি। আর অংশগ্রহণ করলেন ভাষা আন্দোলনে। ছাত্রলীগ গঠনের পর বিরাট সাড়া পেলেন। পূর্ব পাকিস্তান সরকার তাঁর এ রাজনৈতিক কর্মকা- পছন্দ করত না। সর্বক্ষণ গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখত। সে গোয়েন্দারাই যেসব প্রতিবেদন সরকারকে পাঠিয়েছেন সেগুলো থেকেই বোঝা যায়, তিনি গণমানুষের স্বার্থকে কতটা গুরুত্ব দিতেন। এসব প্রতিবেদন নিয়ে ইতিমধ্যেই পাঁচ খন্ড বই প্রকাশিত হয়েছে। আরও বের হবে। ভাষা আন্দোলন ছাড়াও তিনি সাধারণ মানুষের জীবনমান সমস্যা এবং খাদ্য সংকট নিয়ে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। সরকার তখন কর্ডন প্রথা চালু করেছিল। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোনো খাদ্য যেতে পারবে না। তিনি লিখেছেন, ‘ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক, খুলনা ও বরিশালে ধান কাটবার মরশুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসেবে যেত। এরা ধান কেটে ঘরে উঠিয়ে দিত। পরিবর্তে একটা অংশ পেত। এদের “দাওয়াল” বলা হতো। হাজার হাজার লোক নৌকা করে যেত। আসবার সময় তাদের অংশের ধান নিজেদের নৌকা করে বাড়ি নিয়ে আসত। এমনিভাবে কুমিল্লা জেলার দাওয়ালরা সিলেট জেলায় যেত। এরা প্রায় সবাই গরিব ও দিনমজুর। প্রায় দুই মাসের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে এদের যেতে হতো। যাওয়ার বেলায় মহাজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার খরচের জন্য দিয়ে যেত। ফিরে এসে ধার শোধ করত। দাওয়ালদের নৌকা খুবই কম ছিল। যাদের কাছ থেকে নৌকা নিত তাদেরও একটা অংশ দিতে হত। যখন এবার দাওয়ালরা ধান কাটতে গেল কেউ তাদের বাধা দিল না। এরা না গেলে আবার জমির ধান তুলবার উপায় ছিল না। ...যখন এরা দুই মাস পর্যন্ত ধান কেটে তাদের বুভুক্ষু মা-বোন-স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়ার জন্য, যারা পথ চেয়ে আছে, আর কোনো মতে ধার করে সংসার চালাচ্ছে-কখন তাদের স্বামী, ভাই, বাবা ফিরে আসবে ধান নিয়ে, পেট ভরে কিছু দিন ভাত খাবে, এই আশায়-তখন নৌকায় রওনা করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পথ রোধ করা হলো। ... শেষ পর্যন্ত সমস্ত ধান নামিয়ে রেখে লোকগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হলো। এ খবর পেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হলো না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম।’ (ওই, পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪)। এ প্রতিবাদ তীব্র হওয়ার পর সরকার সিদ্ধান্ত নিল ধান কাটতে দাওয়ালরা যেতে পারবেন। তবে ধান তাদের নিজ বাড়িতে আনতে পারবেন না। স্থানীয় গোডাউনে রেখে রশিদ নেবেন। সেই রশিদের ভিত্তিতে নিজ এলাকার গোডাউনে গিয়ে অধিকাংশ দাওয়ালই ধান পাননি। ফরিদপুরের দাওয়ালরা সরকারি হুকুম না মেনে নৌকা নিয়ে নিজ বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর লঞ্চ নিয়ে পুলিশ বাহিনী তাদের ধাওয়া করে তাদের ধরে ফেলে। ধান নামিয়ে নেওয়া হয়। সেই ধান সরকারি গুদামে যায়নি। ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু দাওয়ালদের নিয়ে শোভাযাত্রা করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে গিয়ে দেনদরবার করেছেন। গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর এ ধরনের প্রতিবাদের বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন- ’৪৮ সালের ৪ এপ্রিল ফরিদপুরের এস এন একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় বস্ত্র, খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকটের কথা তিনি বলেছেন। অনুরূপভাবে ’৪৮ সালের ১ জুন  নরসিংদীর ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির দাবি করেন। একই সঙ্গে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবিও জানান। তা ছাড়া তিনি গরিব মানুষের করের টাকায় প্রশাসনের উচ্চ সারির কর্মকর্তা, মন্ত্রী, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিদের উচ্চ বেতনের সমালোচনা করেন। খুলনায় একই বছর ১৩ ডিসেম্বরের এক সভায় শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর দাবি করেন। ’৪৭ সালের ১৩ জুলাইয়ের অন্য আরেকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে একটি লিফলেটের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ মুজিবকে ‘অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলনের’ পুরোধা বলে বর্ণনা করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের মূলে ছিল গরিব মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করা। বঞ্চিতজনের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে তিনিই যে প্রধান রাজনীতিক হিসেবে বের হয়ে আসছেন এ কথা গোয়েন্দারা জানতেন। তাই তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। নিয়মিত তাঁর কর্মকান্ডের ওপর প্রতিবেদন পাঠাতেন। আর এসবের ভিত্তিতে তিনি প্রায়ই গ্রেফতার হতেন।

পরবর্তীকালে ’৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জিতে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হিসেবেও তিনি পূর্ব বাংলার কৃষক, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরপর ওই মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হয়। তিনি ’৫৬ সালে শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে পূর্ব বাংলার উদ্যোক্তা শ্রেণির জন্য বেশ কিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ নেন। যেমন- প্রাদেশিক সরকারের হাতে আমদানি লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষমতা হস্তান্তর, প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক পাট, তুলা ও তৈরি পোশাকের মতো শিল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের একটি কার্যালয় এবং সাপ্লাই অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালকের একটি কার্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অন্তত ৫০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি তিনি তোলেন। জাতীয় চা বোর্ডের সভাপতি হিসেবেও তিনি চা-শিল্পের উন্নয়নে ইতিবাচক উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব অনুসারে ’৫৭ সালের জানুয়ারি থেকে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ এ-দেশীয় কর্তৃপক্ষের হাতে আসার কথা। এসব অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রটি ভালোভাবে বুঝতে পারেন। তাই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, পনের শ মাইল ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থিত দুই অঞ্চলের জন্য ‘দুই অর্থনীতি’ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। পূর্ব বাংলায় জনসংখ্যার আধিক্য, কর্মসংস্থানের অভাব, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে শ্রমিকের আসা-যাওয়া প্রায় অসম্ভবের মতো কারণগুলোই এ অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূলে বলে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান। এর পাশাপাশি পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদরাও ‘দুই অর্থনীতি’র ধারণাকে তথ্য ও যুক্তি দিয়ে সমর্থন জানান। ’৬১ সালে লাহোরে এক সম্মেলনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে দুই অর্থনীতির কথা বলেন। সেই ধারণার আলোকেই বৈষম্যের মাত্রা বোঝার জন্য বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক কমিশন স্থাপনের দাবি জানান। তাঁর প্রস্তাব অনুসারে একটি অর্থনৈতিক কমিশন গঠিতও হয়েছিল। ওই কমিশনে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাঙালি অর্থনীতিবিদরা কাজ করেন এবং বঙ্গবন্ধু যে বৈষম্যের কথা এত দিন বলে আসছিলেন তারই প্রতিধ্বনি করেন। কিন্তু এ কমিশনের প্রতিবেদন দ্রুতই হিমাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

এ দাবি তোলার পরপরই বঙ্গবন্ধু ফের চলে গেলেন জেলে। উল্লেখ্য, সামরিক শাসন জারির পরপরই তাঁকে বন্দী করা হয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে এই অর্থনীতিবিদ ও কিছু সরকারি কর্মকর্তার সহায়তা নিয়ে তিনি তৈরি করলেন ‘ছয় দফা’। দুই অর্থনীতির ধারণাকে রাজনৈতিক গতি দেওয়ার জন্যই ’৬৬ সালে তিনি এ ছয় দফা আন্দোলন বেগবান করেছিলেন। দুই অঞ্চলে স্ব স্ব উদ্যোগে শিল্পায়ন, মুদ্রানীতি, বৈদেশিক মুদ্রানীতি, সুদহার নীতিসহ এমন কিছু দাবি এ ছয় দফায় যুক্ত করেছিলেন তিনি, যা কার্যত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবির পর্যায়েই পড়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি অভিজনরা তাঁর এ আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেন এবং জেলে আটকে রাখেন। এক পর্যায়ে দেশদ্রোহিতার মামলাও দেয় তাঁর বিরুদ্ধে। গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে মুক্ত করে। মুক্ত হয়েই তিনি দল গোছাতে শুরু করেন। ’৭০ এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁর দল নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়। প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের তিনিই একমাত্র বৈধ মুখপাত্র। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের এলিটরা তাঁর নেতৃত্ব মানতে রাজি ছিলেন না। তাই এমন বিপুল বিজয় সত্ত্বেও তিনি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হন। ৭ মার্চ ডাক দেন মুক্তির। এরপর শুরু হয় গণহত্যা। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তাঁকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর নেতৃত্বেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন হয়। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরেই নতুন দেশের পরিচালনার দায়িত্ব নেন। শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির নয়া সংগ্রাম। আর এ সংগ্রামেও এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষই ছিলেন মধ্যমণি। নয়া সংবিধান ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উপেক্ষিত প্রান্তজনের ভাগ্যোন্নয়নে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করেন। একটি সমন্বিত নীতি-কাঠামোর অধীনে তিনি দ্রুত কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন নিশ্চিত করে দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচনে দিনরাত পরিশ্রম করতেন। সর্বক্ষণ সোনার বাংলা অর্জনের স্বপ্ন দেখতেন।

সর্বশেষ খবর