বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষা চিন্তা

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.), নিরাপত্তা বিশ্লেষক

বঙ্গবন্ধু সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষা চিন্তা

বঙ্গবন্ধু যে একটি মর্যাদাবান বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন...

 

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে ইতিমধ্যে শত শত নিবন্ধ, প্রবন্ধ ও বই প্রকাশিত হয়েছে, এখনো হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। মাত্র ৫৫ বছরের স্বল্পতম জীবনকালে একজন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে একেবারে রাষ্ট্রনায়কে উন্নীত হওয়ার ঘটনা সমসাময়িক ইতিহাসে বিরল। ইতিহাসে অনেক সফল রাজনৈতিক নেতা, সফল রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়কের উদাহরণ রয়েছে। তবে একজন রাষ্ট্রনায়কের যেসব বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি থাকে, তার সব দিকের পরিস্ফুটন ও বহিঃপ্রকাশ সাধারণত সবার ক্ষেত্রে দেখা যায় না এবং সে সুযোগ সবার জন্য আসেও না। বিশেষ করে সমর দর্শনের দিকটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থেকে যায় প্রায় সুপ্ত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আলেখ্য ছিল সাধারণের চেয়ে ভিন্ন। দীর্ঘ সংগ্রাম, তারপর সশস্ত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশকে গড়ে তোলার সব দর্শন ও প্রজ্ঞার পরিস্ফুটনই ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর জীবনে। আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, যা কিছু সামরিক বা সমর ও যুদ্ধসম্পর্কীয় তার সবকিছু বুঝি শুধু সামরিক বা সেনানায়কদের কর্মক্ষেত্র (domain)। কিন্তু বাস্তবতা ও আধুনিক যুদ্ধের যে ইতিহাস তাতে দেখা যায়, একটি জাতির সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কতখানি সফল বা বিফল তা পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল সে দেশের রাষ্ট্রনায়কদের দূরদৃষ্টির ওপর। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যুদ্ধ হচ্ছে, More of Art than profession। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী গণযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এ রাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, তাঁর চিন্তা-চেতনা, আদর্শ, দর্শন ও দিকনির্দেশনা একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য সমগ্র জাতিকে প্রস্তুত করেছে, যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং সেই যুদ্ধে অভাবনীয় বিজয় অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র কর্মজীবন ঘিরে আমরা যে সমর দর্শন ও প্রতিরক্ষা চিন্তার পরিচয় পাই তাকে প্রধানত তিনটি ধাপ বা স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়। প্রথম ধাপটি একাত্তর-পূর্ব, বিশেষ করে ’৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ-উত্তর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা। দ্বিতীয়ত, নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সমর-কৌশল, যেটির বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভিতর। আর তৃতীয়টি, স্বাধীনতা-উত্তর সদ্যস্বাধীন একটি দেশের ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধুর প্রতিরক্ষাবিষয়ক চিন্তা-চেতনা ও তার প্রতিফলন। তিনটি পর্বের পৃথক আলোচনা নিচে তুলে ধরছি-

একাত্তর-পূর্ব বঙ্গবন্ধুর সমরচিন্তা

এখন এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ। ছয় দফার লক্ষ্য ও তা অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম, তা বাঙালিকে ধাপে ধাপে নিয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধে। এ দফাগুলোর ষষ্ঠ দফায় পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি গঠনসহ পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ নিরাপত্তাকল্পে অন্যান্য বিষয়কেও তিনি সন্নিবেশিত করেন। যেমন-১. আনসার বাহিনীকে ইউনিফরমধারীতে রূপান্তর : ২. ইপিআর অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (বর্তমানে বিজিবি) বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীন করা : ৩. পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখার ভিতর নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে রাখা। এই দাবির প্রকাশ্য যুক্তি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করা। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত একটি দিক ছিল। কোনো একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হলে বাঙালিদের দ্বারা গঠিত এসব প্যারামিলিটারি ফোর্স পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। যার প্রমাণ আমরা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেখেছি। বাঙালি সেনা ইউনিটগুলো ইপিআর, আনসার, পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন।

এর থেকে বোঝা যায়, গত শতকের ষাটের দশকের শুরু থেকে বঙ্গবন্ধু যা কিছু করেছেন এর অন্তর্নিহিত চিন্তা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের ভূবিন্যাস হচ্ছে নদীবহুল, জলাশয়পূর্ণ ও নিচু জমির সংমিশ্রণ। ষাটের দশকে এটা ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে আরও প্রকট। সামরিক বাহিনীর ভারী যান চলাচলের জন্য সড়কপথ ছিল অনুপযুক্ত। যার কারণে যে কোনো আক্রমণকারী বা দখলদার বাহিনীর জন্য সারা বাংলাদেশ হবে রীতিমতো বধ্যভূমি। ফলে ইউনিফরমধারী আনসার ও ইপিআর বাহিনীকে যদি যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচলিত ও অপ্রচলিত যুদ্ধকৌশলের সংমিশ্রণে একটি নাতিদীর্ঘ প্রতিরোধযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করা যায় তাহলে পর্যায়ক্রমে তারা বিপুল জনগোষ্ঠীকে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারবে।

তখন প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের সঙ্গে বাঙালি যুবকদের সম্পৃক্ততায় যে সম্মিলিত প্রতিরোধ শক্তির উদ্ভব হবে তাতে আক্রমণকারী বা দখলদার বাহিনী শহরকেন্দ্রিক ও ব্যাংকারকেন্দ্রিক হয়ে পড়বে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে এসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ অবস্থা হয়েছিল। আর এ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দরকার হবে তা যেন পূর্ব পাকিস্তানেই তৈরি হয়, তার জন্য এ অঞ্চলে অস্ত্র কারখানা স্থাপনের দাবি ছিল ছয় দফার ভিতর।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক দিকনির্দেশনা

বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ত ও নিবেদিত সহচর তাজউদ্দীন আহমদ অতি অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধকে যেভাবে সুসংগঠিত করেছিলেন ও যুদ্ধে দ্রুত জয়লাভের জন্য বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের যে সামরিক সহায়তা পেয়েছিলেন, তাতে এটা স্পষ্ট হয় যে, এগুলো সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পূর্বপ্রস্তুতির ফল। তবে সেই নির্দেশনাগুলো কী, কখন কীভাবে ছিল, তা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তাই আমার বিশ্লেষণটি সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে যে সামরিক নির্দেশনা ছিল তার ওপর। ৭ মার্চের ভাষণের প্রায় শেষাংশে তাৎপর্যপূর্ণ সামরিক নির্দেশনা ছিল। যেমন-১. প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, ২. জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু তোমরা বন্ধ করে দিবে; ৩. আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব; ৪. শত্রু পেছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে এবং ৫. প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদি গেরিলাযুদ্ধের জন্য মাও জে দংয়ের খ্যাতনামা ম্যাক্সিম হলো, ‘শত্রু যখন ক্লান্ত হয়ে পিছু হটবে ও নিজেদের সংকুচিত করবে তখন তাকে ধাওয়া কর এবং আঘাত কর। আর শত্রু যখন এগোবে তখন পথে অসংখ্য ছোট ছোট বাধা সৃষ্টি কর এবং নিজেরা চলে যাও নিরাপদ স্থানে।’ ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো ও যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার নির্দেশ ছিল মাও জে দংয়ের উপরোক্ত সফল গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের প্রতিফলন। আধুনিক কনভেনশনাল ও নন-কনভেনশনাল- উভয় যুদ্ধেই Denial plan কার্যকর করা যুদ্ধের একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ পরিকল্পনার মূল কথা হলো, নিজেদের কোনো সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা শত্রু যেন ব্যবহার করতে না পারে। রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু বন্ধ করা এবং ভাতে মারব ও পানিতে মারব নির্দেশনার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সমর-কৌশল Denial plan বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। উপরোল্লিখিত চতুর্থ নির্দেশনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মূলত সমগ্র বাঙালি জাতি ও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন তাঁদের সবার জন্য সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালে দেশের অভ্যন্তরে রাজাকার, আলবদর ও তাদের সহযোগী রাজনৈতিক দলের অনুসারীদের দ্বারা পঞ্চম বাহিনী (Fifth columnist) সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের বাড়িঘর, ধনসম্পদ লুটতরাজে লিপ্ত হয়েছিল। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভিতর যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল তাও এখন সবারই জানা।

পঞ্চম নির্দেশনার তাৎপর্য ছিল দেশব্যাপী যাতে বাঙালিরা সঠিক নেতৃত্বের অধীনে সুসংগঠিত হয় ও সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তার ফলেই ২৬ মার্চের পরপর বাঙালি সেনা সদস্যসহ অন্য প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যরা একটা প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এসব প্রশিক্ষিত ইউনিটকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বৃহত্তর গণবাহিনী বা মুক্তিফৌজ। একসময় সারা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আর সে কারণেই মাত্র নয় মাসের মাথায় পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য বাংলাদেশের মাটিতে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

স্বাধীনতা-উত্তর প্রতিরক্ষা চিন্তা

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে দেশে ফেরত আসেন। তখন সম্পূূর্ণ দেশটি ছিল একটি ভয়ানক ধ্বংসস্তূপ। সিদ্ধান্ত অনুসারে ’৭২ সালের মার্চেই ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার ও দেশের নিরাপত্তা ছিল পরস্পরবিরোধী দুটি সিদ্ধান্ত। এ রকম একটি বহুমুখী সংকটের মুখে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিরল নেতৃত্বের গুণাবলি, ভুবনমোহিনী ব্যক্তিত্ব, হিসাবি সাহস, প্রবল আত্মবিশ্বাস, গভীর দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞাপ্রসূত একটি মাত্র আন্তর্জাতিক সম্পর্কজনিত রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ওই সময় দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিলেন। ’৭২ সালের ১৯ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী স¦াক্ষর করেন ২৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী ও শান্তিচুক্তি। ওই চুক্তিতে মোট ১২টি অনুচ্ছেদ ছিল। তার মধ্যে নবম অনুচ্ছেদে ছিল- কোনো এক পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তিকারী প্রত্যেকে তৃতীয় পক্ষকে যে কোনো ধরনের সাহায্যদানে বিরত থাকবে। তা ছাড়া যে কোনো পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সেই আশঙ্কা নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে উভয় পক্ষ সঙ্গে সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়ে নিজেদের শক্তি এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, সে সময়ের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ওই শান্তিচুক্তির উল্লিখিত অনুচ্ছেদই ওই দুর্বল মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাব্যূহ হিসেবে কাজ করেছে। তখন আমাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে চুক্তিটি ছিল একটি শক্তিশালী নিবারণ (Deterence)। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও পুনর্গঠন শুরু করেছিলেন। সশস্ত্র বাহিনীকে বঙ্গবন্ধু যে একটি মর্যাদাবান বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, ওই সময়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ থেকেই তা বোঝা যায়। ’৭২ সালের ৪ এপ্রিল সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী গঠন করে। সেনাবাহিনীর মর্যাদার প্রতীক বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি বঙ্গবন্ধু উদ্বোধন করেন ’৭৪ সালের ৩ মার্চ। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর জন্য ট্যাংক ও বিমান বাহিনীর জন্য তখনকার সময়ের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান মিগ-২১ কিনেছিলেন। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে তিনি সেনাবাহিনীকে সব বাহিনীর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। ’৭২ সালের ৬ অক্টোবর চোরাচালান রোধে জাতীয় রক্ষীবাহিনীসহ সব বাহিনীকে সেনাবাহিনীর অধীনে ন্যস্ত করেছিলেন। আপৎকালীন বা যুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিকল্পে প্যারামিলিটারি হিসেবে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন। প্যারামিলিটারির উদাহরণ ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকাসহ প্রায় সব দেশেই রয়েছে। শান্তির সময়ে যাদের কাজ থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, আর যুদ্ধের সময় তারা সেনাবাহিনীর অধীনে সংযুক্ত হয়ে সামগ্রিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বহুগুণে শক্তিশালী করে তোলে। সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় যাতে অল্প সময়ে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সব সেনা সদস্যকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনা সদস্যের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে মাত্র দুই-আড়াই বছরের মাথায় সমগ্র সেনাবাহিনীকে ব্রিগেড গ্রুপ ফোর্সে বিন্যাস করে পুনর্গঠিত করেছিলেন। সেনাবাহিনীকে নতুন করে স্বাধীন দেশের চাহিদামতো গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের মর্যাদাবান দেশের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ দেশরক্ষা বাহিনী ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

সর্বশেষ খবর