বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রতিদিনের জয় অনিবার্য

তসলিমা নাসরিন, লেখক, চিকিৎসক

প্রতিদিনের জয় অনিবার্য

বাংলাদেশ প্রতিদিনের বয়স ১০ হলো। আজকাল মুদ্রিত পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, টিকে থাকতে হলে অনলাইন ছাড়া গতি নেই, এমন যখন অবস্থা, তখন ১০ বছর পার করেছে প্রতিদিন। করোনাভাইরাসের থাবার নিচে বসে বিশাল উৎসব সম্ভব নয় জানি। কিন্তু মনে মনের উৎসব তো চলতেই পারে। আমি মনে মনে উড়িয়ে দিলাম সহস্র রঙিন ফানুস।

বাংলাদেশ প্রতিদিন আমার কাছে কোনও খবরের কাগজ নয়, আমার কাছে এটি আরও বড় কিছু, আরও বিশাল কিছু। বাংলাদেশ প্রতিদিন আমার কাছে আমার হারিয়ে যাওয়া দেশ, যে দেশ আমাকে নিরাপত্তা দেয়, ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে প্রদীপের আলো দেয়, আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দেয়, আমাকে থোকা থোকা স্বপ্ন দেয়। দেশের কাজই তো এই, যখন কেউ নেই পাশে, দেশ তখন মায়ের মতো পাশে থাকে, দেশের একটি নরম কোমল হাত থাকে পিঠে। যখন বিদেশ বিভুঁইয়ে ধসে গেছি বারবার, তখন আলতো করে যে তোলে আমাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য, সেটি দেশ।

না, এ ছাড়া কোনও দেশ নেই আমার। যখন নারীবিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, যখন কট্টর মৌলবাদী সমাজ, যখন নিষ্পৃহ নির্মম সরকার আমার লেখক সত্তাকে হত্যা করার জন্য হেন কাজ নেই যে করেনি, তখন সেই দুঃসময়ে আমার দিকে সহানুভূতি আর সহমর্মিতার হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। আমার লেখক সত্তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ প্রতিদিন। আজ দীর্ঘদিন আমি নিয়মিত লিখছি বাংলাদেশ প্রতিদিনে। একজন ব্রাত্য, নির্বাসিত লেখকের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!

না, আমি বানের জলে ভেসে আসিনি। আশির দশকজুড়ে নারীর সমানাধিকারের জন্য আমি লড়েছি একা, নারীর বিরুদ্ধে হাজার রকম অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি একা। ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দাঁত নখ ভেঙ্গে দিতে চেয়েছি একা। জীবন বিপন্ন, তারপরও কোনও অপশক্তির সঙ্গে আপস করিনি। একা ছিলাম বলেই পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র আমার হাত থেকে শুধু কলম কেড়ে নেয়নি, আমাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রকাশক এবং সম্পাদকের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। ওঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার লেখা প্রকাশ করেন। ওঁরা গণতন্ত্রে এবং বাকস্বাধীনতায় গভীরভাবে বিশ্বাস করেন বলেই যে মতটি অধিকাংশ মতের চেয়ে ভিন্ন, সেটি প্রকাশ করার সাহস করেন। এই সাহস বাংলাদেশের অন্য কোনও প্রচার মাধ্যমের নেই। অন্য প্রচার মাধ্যম শুধু সেই মতটি প্রকাশ করতে আগ্রহী যে মতটি সকলে পছন্দ করে, যে মত বিতর্ক তৈরি করে না। কিন্তু বিতর্ক না হলে সমাজ পাল্টাবে কী করে! মুক্তচিন্তার জায়গা না থাকলে সমাজ তো স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে এক জায়গায়, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শেকড় গজিয়ে ফেলবে, বিবর্তিত হবে না।

একজন লেখককে নির্বাসন দন্ড দিলেই তাকে হত্যা করা যায় না। তার লেখা বই যদি প্রকাশ পেতে থাকে, তার লেখালেখি যদি পাঠক পাঠ করতে থাকে, তবে নির্বাসন তেমন কোনও সর্বনাশ করতে পারে না লেখকের। কিন্তু লেখকের লেখা যদি প্রকাশ না করা হয়, তাহলেই লেখকের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের মৌলবাদী সমাজ আমার মৃত্যু ডেকে এনেছিল। সেই মৃত্যু থেকে ফিনিক্স পাখির মতো আমি বেঁচে উঠতে পেরেছি শুধুই বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্য।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের যে ব্যাপারটি আমার ভালো লাগে, তা হলো সব রকমের মতামতকে জায়গা দেওয়ার উদারতা। যে গুরুত্ব দিয়ে ধর্মের পক্ষে, সরকারের পক্ষে, পুরুষতন্ত্রের পক্ষে মতামত ছাপানো হয়, একই গুরুত্ব দিয়ে ওসবের বিপক্ষেও মতামত ছাপানো হয়। শুধু একটি মতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে, বাকিগুলোকে তুচ্ছ করা হবে, শুরু থেকেই এই কাগজটি তেমন নয়। খবরের কাগজকে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হতেই হয়।

পত্রিকার প্রকাশকের সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য না হলেও সম্পাদকের সঙ্গে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। নঈম নিজাম অত্যন্ত সজ্জন, সাহসী এবং স্বপ্নবান। ১০ বছর ধরে তিনি প্রকাশ করতে পেরেছেন এই পত্রিকা। এই পত্রিকা বেঁচে থাকতে পারে আরও ১০০ বছর। ১০০ বছর পর আমিও থাকব না, এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনের বর্তমান কোনও কর্মীও থাকবে না। তাতে কী, নতুন লেখক, নতুন সম্পাদক আরও ১০০ বছর বাঁচাবে এটিকে। এভাবেই আমার দেশটি, প্রিয় দেশটি বেঁচে থাকবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর