বুধবার, ১৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

জাতির জনকের হাত ধরে শূন্য থেকে যাত্রা করা প্রতিরক্ষা বাহিনী

মেজর নাসির উদ্দিন আহম্মদ (অব.) পিএইচডি, গবেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

জাতির জনকের হাত ধরে শূন্য থেকে যাত্রা করা প্রতিরক্ষা বাহিনী

এখনো বাতাসে বারুদের গন্ধ

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯১৪ সালের ২৮ জুনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর পক্ষে ভারত উপমহাদেশ থেকে প্রায় ১৫ লাখ সৈন্য এবং সাড়ে ৫ লাখ বেসরকারি পেশাজীবী অংশ নেন, যাদের প্রায় ৯ লাখ আর ঘরে ফেরেননি। এই যুদ্ধে তারা শহীদ হয়েছেন বলেই ধরে নেওয়া হয়। এদের অনেকেই ছিলেন বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডের তৎকালীন অধিবাসী। ২০১৫ সালের ২ জুলাই বিবিসির প্রতিবেদনেও এ অঞ্চলের হাজার হাজার সৈন্যের শহীদ কিংবা পঙ্গু হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এই ভয়াবহ যুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৮ সালের নভেম্বরের ১১ তারিখ বেলা ১১টা ১১ মিনিটে। যুদ্ধ শেষ হলেও তখন বাতাসে বারুদের গন্ধ, ঘরে ঘরে স্বজন হারানোর আর্তনাদ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধের জন্য ব্রিটিশদের মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত নির্যাতনের ক্ষতবিক্ষত প্রভৃতি বিরাজ করছিল। ব্রিটিশদের নিরাপদে ফিরে আসার জন্য কয়েক লাখ ভারতীয় সৈন্য ও বেসামরিক পেশাজীবী তখনো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাধ্যতামূলক শ্রম দিচ্ছিল। তাই বলা যায় এক যুদ্ধবিধ্বস্ত অশান্ত পৃথিবীতেই জন্ম নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এই পরিস্থিতি আরও সংকটময় করে তোলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ প্রবর্তিত নিপীড়নমূলক আইন রোলট অ্যাক্ট এবং ১১ এপ্রিল ১৯১৯ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের অমৃতসারের জালিয়ান ওয়ালাবাগে একটি সমাবেশে ব্রিটিশদের নির্বিচার গুলিতে ১৪৯৯ জন নিরস্ত্র ভারতীয়র মৃত্যু হয়। এতে আহত হয় ১১৩৭ জন এবং অজানা সংখ্যক ভারতীয় চিরতরে হারিয়ে যায় (সূত্র : বিবিসি)। তাই যুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী বিরূপ পরিস্থিতিতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। হয়তো এরই প্রভাব আমরা দেখতে পেয়েছি পরবর্তীতে তাঁর সামরিক জ্ঞান, সামরিক চিন্তা ও সামরিক দর্শনে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতা

১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর এই ছয় বছর বিশ্ব কাঁপিয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর যৌবনকাল (১৯ থেকে ২৫ বছর) অতিবাহিত করেন। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে দেখা যায় এই সময়টিতে তিনি শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সান্নিধ্যে আসেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ সার্বিকভাবে বিশ্বরাজনীতির দীক্ষা লাভ করেন। বিশ্বযুদ্ধ সমগ্র বিশ্বে যে ভয়াবহতা সৃষ্টি করে, তা প্রত্যক্ষ করার করুণ অভিজ্ঞতা হয় বঙ্গবন্ধুর, যা পরবর্তীতে তাকে শান্তিকামী নেতায় পরিণত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লেখেন, ‘গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজ যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান, চাল সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাউল চল্লিশ, পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নাই রাস্তায় লোকে মরে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে না।’ ব্রিটিশ শাসকদের এই সময়কার মনোভাবের কথাও প্রকাশ পায় তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। বঙ্গবন্ধুর মতে, ‘ইংরেজদের কথা হলো, বাংলার মানুষ যদি মরে মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে, তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি, যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।’ এই পরিস্থিতি যৌবনেই বঙ্গবন্ধুকে একটি স্বাধীন দেশ ও নিজস্ব সামরিক শক্তির প্রয়োজনীয়তার দীক্ষা দেয়। একজন সামরিক কমান্ডারের মতো তিনি ম্যাপ ও অন্যান্য তথ্য সঙ্গে রাখতেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তা উঠে আসে এভাবে, ‘আমার কাছে ভারতবর্ষের একটা ম্যাপ থাকত। আর হাবীবুল্লাহ বাহার সাহেবের পাকিস্তান বইটা এবং মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবও পাকিস্তান নামে একটা বিস্তৃত বই লিখেছিলেন সেটা; দুইটা বই আমার প্রায় মুখস্থের মতো ছিল। আজাদের কাটিংও আমার ব্যাগে থাকত। সিপাহি বিদ্রোহ এবং ওহাবি আন্দোলনের ইতিহাসও আমার জানা ছিল।’ বাঙালির সামরিক শক্তিমত্তা ও ঐতিহ্যে প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, ‘মুসলমানরা কিছুদিন পূর্বেও দেশ শাসন করেছে। তাই ইংরেজকে গ্রহণ করতে পারে নাই। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালি মুজাহিদ? বাংলাদেশ থেকে সমগ্র ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জিহাদে শরিক হয়েছিল। তিতুমীরের জিহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফরাজি আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি-প্রকৃতির দিকে বিশেষ মনোযোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর, তাঁর বর্ণনা মতে, “যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে ইংরেজ যুদ্ধের গতির পরিবর্তন করে ফেলল। এই সময়ে কংগ্রেস ‘ভারত ত্যাগ কর আন্দোলন’ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনকেও শহীদ সাহেব এবং হাশিম সাহেব জনগণের আন্দোলনে পরিণত করতে পেরেছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গেও আমাদের লড়তে হবে, এই শিক্ষাও হাশিম সাহেব আমাদের দিচ্ছিলেন। আমাদেরও ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা জাত ক্রোধ ছিল। হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হবার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগত। এই সময় নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারত বর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের দলে নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। মনে হতো, ইংরেজের থেকে জাপানই বোধহয় আমাদের আপন, আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনো দিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ আমাদের ব্যথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাস বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম, মনে হতো, সুভাস বাবু একবার বাংলাদেশে আসতে পারলে ইংরেজকে তাড়ান সহজ হবে।” এখানে উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান চীন দখলের জন্য তৎকালীন বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) দখল করে এবং অতি দ্রুত ব্রিটিশদের হটিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্গে সংলগ্ন মিয়ানমারের সীমান্ত ও তৎসংলগ্ন এলাকায় পৌঁছে যায়। আর অপ্রতিরোধ্য জাপানিদের মোকাবিলায় ব্রিটিশরা ব্যাপকহারে বাঙালিদের যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করে এবং বাধ্যতামূলক শ্রমের বিনিময়ে কুমিল্লা, ফেনী, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বিমান ঘাঁটি রেললাইন প্রভৃতি গড়তে থাকে। নিজস্ব সামরিক শক্তির অভাব কীভাবে দুই পরাশক্তির মাঝে আমাদের অসহায় করে তোলে, তাঁর সম্যক জ্ঞান বঙ্গবন্ধু লাভ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধীনতা ধরে রাখতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিতে সহায়তা করে। শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী না থাকলে দেশের যে ক্ষতি হয়, তা বঙ্গবন্ধু বুঝতেন বলেই লিখেছিলেন। ‘একটা কথা সত্য, মোগলদের পতনের পরে বারবার লুটতরাজ হয়েছে। জাঠ ও মারাঠি এবং শেষ আঘাত হেনেছে ইংরেজ। জাঠ ও মারাঠিরা কিছু কিছু লুট করেই চলে গিয়েছিল, কিন্তু ইংরেজ সব কিছু লুট করেই নিয়ে গিয়েছে ভারতবর্ষ থেকে। লর্ড স্থানীয় লোকরাই এই লুটের প্রধান কর্ণধার ছিলেন।’

লাহোর প্রস্তাব ও ক্যাবিনেট মিশনে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বর্ণনা

ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ভারতের ভিতর থেকে অন্যান্য দেশের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসকদের ওপর ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণার দাবি ওঠে। এই দাবিকে বেগবান করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী লাহোর পৌঁছেন এবং পরদিন ২৩ মার্চ ১৯৪০ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাধারণ সভায় ব্রিটিশ শাসন অবসানের প্রাথমিক রূপরেখা প্রদান করেন, যা ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে পরিচিতি পায়। লাহোর প্রস্তাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অঞ্চলে স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম প্রদেশ করার রূপরেখা দেওয়া হয়। শেরে বাংলার শিষ্য হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যৌবনের প্রারম্ভে এভাবেই একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুকে ধারণ করেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের স্বাধীনতার রূপরেখা তৈরির জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট ‘ক্যাবিনেট মিশন’ নামক বিশেষ কর্তৃপক্ষ গঠন করে। ক্যাবিনেট মিশন তৎকালীন বাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি বিশেষ অঞ্চল বা ‘প্রোভিসিয়াল গ্রুপ’সহ বিভিন্ন ভৌগোলিক বিভাজনের প্রস্তাব করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, মুদ্রা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তখন ২৬ বছরের টগবগে যুবক। দেশ বিভাগ ও স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্ন, কেন্দ্র প্রদেশের সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষার মতো স্পর্শকাতর বিষয় সম্পর্কে তিনি তখন সম্যক ধারণা লাভ করেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এ সংক্রান্ত বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, “কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করছে ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে।... তাতে দেশ রক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে এবং বাকি সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হয়েছিল।” এমনি এক প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলিম রক্তাক্ত দাঙ্গা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু তখন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং সম্মুখসমরের যোদ্ধার মতো মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেন। এ ছাড়াও ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ’৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজপথের লড়াকু সৈনিক।

 

দফাভিত্তিক আন্দোলনে প্রতিরক্ষা প্রসঙ্গে 

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভারত ও পাকিস্তানের জন্মের পর তৎকালীন বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) সত্যিকারে স্বায়ত্তশাসন তথা সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য দফাভিত্তিক বেশ কিছু আন্দোলন হয়। এসব আন্দোলন ছিল মূলত বাঙালির প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি ধারাবাহিক প্রস্তুতি, যার প্রকৃত রূপকার ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এসব দফাভিত্তিক আন্দোলনের সূচনা ঘটে ১৯৫৪ সালের ‘পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক সরকার নির্বাচনে ২১টি প্রস্তাব বা দফা নির্বাচনী ইশতিহার আকারে প্রকাশের মধ্য দিয়ে, এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেন এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য প্রাদেশিক কৃষিমন্ত্রী হন। নির্বাচনের অঙ্গীকার বা ইশতেহারের ১৯ নম্বরে পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশের) প্রতিরক্ষার প্রসঙ্গে বলা হয়, “লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বঙ্গের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত সব বিষয় পূর্ব বাংলা সরকারের অধীনে আনয়ন; দেশ রক্ষা ক্ষেত্রে স্থলবাহিনীর হেড কোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে এবং নৌ বাহিনীর হেড কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন; এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণ কারখানা স্থাপন ও আনসার বাহিনীতে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।”

১৯৬৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়। মাত্র ১৭ দিনের এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার সৈন্য ও নিরীহ জনগণ প্রাণ হারায়। এই যুদ্ধে মূলত বাঙালিদের নিয়ে গড়া ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে বোদয়ান সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী সম্ভাব্য প্রবেশপথে সম্মুখসমরে নিয়োজিত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল অর্থ তখন পশ্চিম পাকিস্তানে গেলেও এদেশের নিরাপত্তা পাকিস্তানিদের কাছে ছিল অবহেলিত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি তদানীন্তন পশ্চিমা শাসকরা। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তথা কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় দেওয়া তার বক্তব্যে বলেন, “সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অন্য অংশসহ বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।”

এমনি এক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধশেষে  ১৯৬৬ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। এই ছয় দফার দ্বিতীয় দফায় বলা হয় যে, “ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে। আর ৬নং প্রস্তাবে বলা হয় যে, “প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানের অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।”

ছয় দফা দাবির পর তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীদের কাবু করার চেষ্টা করা হয়। এ সময় তাঁর হাতে গড়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর ইশারায় “ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” গড়ে তোলে এবং ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি ঘোষণা করে। এই ১১ দফার ৩-এর খ ধারায় বলা হয়, “ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশ রক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা-এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে। অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা হইবে নিরংকুশ।” অপরদিকে ৩-এর চ ধারায় বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি রক্ষাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন করিতে হইবে।” ১০নং ধারায় দাবি করা হয় যে, “সিয়াটো, সেন্টো, পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করিয়া জোটবহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করিতে হইবে।”

 

তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার পর থেকে প্রায় সার্বক্ষণিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকতেন। তাই প্রকাশ্যে তিনি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না। তবে উন্মুক্ত ভাষণে তিনি ঠিকই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষ্যম্যের চিত্র তুলে ধরতেন। দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, অরক্ষিত সীমান্ত, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বিশেষত অফিসার পদে অতি অল্পসংখ্যক বাঙালির উপস্থিতি, চাকরিরত বাঙালি সেনাদের প্রতি অবিচার বিষয়ই উঠে আসত তার বক্তৃতায়। তবে গোপনে যে তিনি ঠিকই প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তাদের খোঁজখবর রাখতেন, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী নিয়ে ভাবতেন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতেন, তার তথ্য পাওয়া যায় ‘তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র বিস্তারিত বর্ণনায়। এই মামলায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের মাধ্যমে ভারতের সহায়তায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চক্রান্ত করার অভিযোগ আনা হয় বঙ্গবন্ধুসহ মোট ২৮ জন সরকারি কর্মচারী, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সদস্য এবং রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে। তাদের দ্রুত বন্দী করে সামরিক কায়দায় বিচারের প্রহসন চলে। তীব্র আন্দোলনের মুখে এই বিচার বন্ধ হয় এবং বন্দীরা মুক্তি পায়। এ সময় জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন (পরে কর্নেল ও এমপি) শওকত আলী, ক্যাপ্টেন মঞ্জুর, মেজর খুরশীদ উদ্দিন ও ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান, নৌবাহিনীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও লেফটেন্যান্ট রহমান এবং বিমান বাহিনীর সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হকসহ অনেকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ রাখতেন।

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদস্যদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখার সুবাদে একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বন্দী হওয়ার আগে জাতির জনক যে ‘শেষ বার্তা’ বা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তা ইপিআর বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

 

 

৭ মার্চে চূড়ান্ত সামরিক নির্দেশনা

আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে চীনে জন্মেছিলেন এক মহাসমরবিদ, লেখক ও তাত্ত্বিক গুরু সানজু। তার জগৎখ্যাত এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদকৃত গ্রন্থ ‘দি আর্ট অব ওয়ার’ বা যুদ্ধের কলাকৌশল বইটি প্রাচ্য পাশ্চাত্য সর্বমহলেই সমাদৃত এবং যে কোনো সেনা কর্মকর্তার জন্য অবশ্য পাঠ্য বলে বিবেচিত। এই বইয়ে সমর দার্শনিক সানজু সরাসরি বা সম্মুখযুদ্ধের বাইরে বিকল্প উপায় যুদ্ধ বা শত্রু ধ্বংস, শত্রুকে বোকা বানিয়ে নিজ উদ্দেশ্য হাসিল, শত্রুর আক্রমণ বা অগ্রসর হওয়া বিলম্বিত করা, গুপ্তচর বৃত্তিসহ উদ্ভাবিত বিভিন্ন কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসের আদিযুগ থেকে অদ্যাবধি অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে (১৯৭১ সাল) রেসকোর্সের ময়দানে যুদ্ধের যে কলাকৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন, এতে তার মাঝে এক মহাসমর দার্শনিকের ছায়াই খুঁজে পাওয়া যায়। যে কোনো সমর অধিনায়কের প্রধান কর্তব্য কী উদ্দেশ্যে একটি অভিযান বা যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে, তা প্রথমেই তুলে ধরা। ৭ মার্চের ভাষণের শুরুতেই আসন্ন সংগ্রামের তিনটি উদ্দেশ্য তুলে ধরে বললেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ সমর পরিকল্পনায় উদ্দেশ্য বলার পর পরই শত্রু পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়। ৭ মার্চের ভাষণে শত্রু পরিস্থিতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের ফলাফলকে গুরুত্ব না দেওয়া, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের বাইরে রাখা, নিজের টাকায় কেনা অস্ত্র ও গুলিতে নিজেদের আহত বা নিহত হওয়া, আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি বর্ণনা করেন। উদ্দেশ্য ও শত্রু পরিস্থিতি ব্যাখ্যার পর নিজেদের শক্তি সামর্থ্যরে মূল্যায়ন সামরিক পরিকল্পনার স্বতঃসিদ্ধ প্রথা। ৭ মার্চের ভাষণে নিজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি সমগ্র পাকিস্তান তথা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ‘মেজরিটি পার্টি’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরেন এবং ‘৭ কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না’ বলে তার সৈন্য সংখ্যার জানান দেন। একটি সমর পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘কার্য সম্পাদন পরিকল্পনা’ যা টাস্ক বা মোডাস ওপারে) নামেও পরিচিত। ৭ মার্চের ভাষণে এ সংক্রান্ত বেশ কিছু সামরিক দিকনির্দেশনা রয়েছে। এর অন্যতম হলো ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ’ গড়ে তোলার নির্দেশনা, ভিয়েতনাম, কিউবা, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়াসহ পৃথিবীর বহুদেশে যুদ্ধের নিয়ামক শক্তি ছিল বসতভিটা, দোকানপাট, শহর-বন্দর-গ্রাম প্রভৃতিতে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও নিবেদিতপ্রাণ প্রশিক্ষিত বা অর্ধপ্রশিক্ষিত সৈন্য মজুদ করা, যারা সুযোগমতো শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কাজ শেষে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে যায়। বঙ্গবন্ধুও একই নির্দেশনা দিয়েছেন, যা পৃথিবীর বহু দেশে প্রতিরক্ষা নীতির মূল কথা, এরপর তিনি ‘‘যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’’ করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের ফলে একদিকে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সৈন্যরা এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (সীমান্ত রক্ষী), পুলিশ ও আনসার সদস্যরা বুঝে নেয় যে সময় হয়েছে তাদের অস্ত্র নিয়ে ছাউনি ছেড়ে পাকিস্তানিদের ঠেকাতে হবে। আর সাধারণ মানুষ দা, বল্লম, টেঁটা, তীর, ধনুকসহ সব দেশীয় অস্ত্র এমনকি লাঠি নিয়েও দাঁড়িয়ে যায়, যার সম্মিলিত শক্তি যে কোনো অংশেই আধুনিক সেনাবাহিনীর শক্তির চেয়ে কম নয়, তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছে। শত্রুকে ঘায়েল করার অন্যতম কৌশল হলো তার সামরিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া এবং তাদের জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের জোগান বন্ধ করে দেওয়া। বিখ্যাত সমরবিদ সানজু বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। সমরবিদদের ভাষায় এ হলো ‘‘মাছকে পানি থেকে তুলে নেয়া’’ কৌশল যার ক্রমেই শত্রুর মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ কৌশল বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছুই আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো।” এভাবে তিনি এক প্রকার গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন। সামরিক আদেশের অপরিহার্য বিষয় ‘বিকল্প নেতৃত্ব’ যা বক্তব্যের এই অংশে আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি’’ বাক্যটির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। বিকল্প নেতৃত্ব এবং দ্বিতীয় সারির সেনা বা রিজার্ভ ফোর্স নামে পরিচিত সামরিক শক্তি নিয়ে জাতির পিতার ভাবনা উঠে আসে তাঁর ‘‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ’’ গড়ে তোলা এবং ‘‘যার যা কিছু আছে; তা-ই নিয়ে প্রস্তুত’’ থাকার নির্দেশে। এখানে লক্ষণীয় বক্তব্যের আগের অংশে “যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’’ করার কথা বলার পরে তিনি অন্যদের ‘প্রস্তুত থাকার’ও নির্দেশ দেন, যা কেবল দূরদর্শী সমরনায়কের দ্বারাই সম্ভব। যে কোনো রণক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা বেতার বা তারের সাহায্যে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর এ সংক্রান্ত নির্দেশ ছিল ‘‘মনে রাখবেন, রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না, যদি টেলিভিশনে আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না।” তিনি আরও বলেন ‘‘টেলিফোন ও টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সাথে দেওয়া নেওয়া চলবে না।’’ এভাবেই তিনি একদিকে গণমাধ্যমকে শত্রুর প্রপাগান্ডা বন্ধ এবং নিজেদের প্রপাগান্ডা প্রচার আর অন্যদিকে নিজের যোগাযোগের জন্য তার বা টেলিফোননির্ভর যোগাযোগের নির্দেশনা দেন। একটি সেনাবাহিনীর মূল শক্তি তার নিজস্ব ঐক্য ও সঙ্গতি। জাতির পিতা এ প্রসঙ্গে এক অবিস্মরণীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘‘শত্রু বাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’’ এক্ষেত্রে অবাঙালি তথা পাকিস্তান সমর্থক বিহারিদের রক্ষার দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। অপর অংশে সব হত্যাকান্ডের বিচার দাবি এবং অস্ত্রধারীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্য ‘‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো। কেউ তোমাদের কিছু বলবে না” ইত্যাদির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ প্রণীত ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্টের ঐতিহাসিক ‘জেনেভা কনভেনশন’-এর একাধিক ধারার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন, যা একজন বিবেকবান ও পেশাগত সমরবিদের অবশ্য কর্তব্যের অংশ। এর বাইরে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, বিকল্প যুদ্ধস্বরূপ হরতাল ডাকা, রাস্তায় অবস্থান, নিজেকে ‘প্রধানমন্ত্রিত্ব’ ভিখারি নয় দাবি, গরিবের চলাচল ও রুটি-রুজির ব্যবস্থা, কর্মচারীদের বেতন সংগ্রহ প্রক্রিয়া, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া, রিলিফ কমিটির মাধ্যমে আহত ও নিহতদের সাহায্য করা প্রভৃতির মাধ্যমে একটি যুদ্ধের প্রশাসনিক বা লজিস্টিক বিষয়গুলোর দিকনির্দেশনা দেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো তিনি ‘কমান্ডো’দের ‘হয় শত্রুর দমন না হয় মরণ’ মন্ত্র বাতলে দেন যুদ্ধের কৌশল হিসেবে। তার দুটি বাণী ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’ এবং ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’- যেন একদল কমান্ডোর প্রতি এক অকুতোভয় সমরনায়কের শেষ বার্তা। আর আগেকার দিনের পতাকা তুলে, ঢোল পিটিয়ে বা পশুর শিং-এ ফুৎকার দিয়ে যুদ্ধ ঘোষণার মতো তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর সংকেত দিলেন এই বলে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। উল্লেখ্য ৭ই মার্চের ভাষণকে ভিত্তি করে ১৪ মার্চ জাতির পিতা ৩৫টি নির্দেশ জারি করে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রদান করেন, যা ছিল মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের প্রশাসনিক দিকনির্দেশনা।

 

ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রবন্দরে নোঙর ফেলে নৌবাহিনী

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’, এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া অকুতোভয় নৌসেনা ও মুক্তিকামী আরও কিছু সাহসী মুক্তিযোদ্ধার ত্যাগ, তিতিক্ষা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে (জুন-জুলাই মাসে) বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ শুরু হয়।

এক প্রকার শূন্য হাতেই যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, যা বঙ্গবন্ধুর সময়ে একটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীর অধীনে ছিল। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের স্বাধীনতার পর এই তিনটি বাহিনীকে একই কমান্ডের অধীনে রাখার পক্ষে মত দেন কেউ কেউ। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি (১৯৭২ সাল) দেশে ফেরার তিন মাসের মাথায় পৃথকভাবে নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং তা গড়ার দায়িত্ব তুলে দেন তৎকালীন নৌপ্রধান কমান্ডার নুরুল হকের ওপর। তখন নৌবাহিনী সদস্য সংখ্যা ছিল ১৮০ জন। তাদের  অস্ত্র, নৌযান, রসদ এমনকি পোশাকও ছিল না। ইস্কাটনের ট্র্যাজিট ক্যাম্পে (বর্তমানে নেভি হাউস) এবং সেনা ও বিমান বাহিনীর দেওয়া কয়েকটি কক্ষে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নৌবাহিনী গড়ার কাজ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঢাকা সেনানিবাসের একটি কাঁঠালবাগান নৌবাহিনীকে বরাদ্দ দেওয়া হয় একটি স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে। আজ সেখানে বিএনএস মহসীন গড়ে উঠেছে। দ্রুত জনবলের ঘাটতি পূরণের জন্য মূলত সাহসী ও তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে বাছাই করা ১০০ জনকে নিয়ে চট্টগ্রামের পরিত্যক্ত নৌঘাঁটি পিএনএস বখতিয়ার (বর্তমানে বিএনএস ঈসা খান) এ ১৯৭২ সালে শুরু হয় নৌ-সেনাদের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ। পাকিস্তান আমলের পূর্ত বিভাগের পরিত্যক্ত দুটি নৌযানকে নারায়ণগঞ্জে রিভাবাইন পেট্রল ভেসেল বা জঙ্গি নৌযানে রূপান্তর করা হয় এবং ১৯৭২ সালের ১২ জুন ও ৮ জুলাই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পতাকা লাগিয়ে তা পানিতে ভাসানো হয়। তখনো বঙ্গোপসাগরে দায়িত্ব পালনের মতো কোনো নৌযান ছিল না বাংলাদেশ নৌবাহিনীর। বঙ্গবন্ধুর মধ্যস্থতা ও নির্দেশে এ সময় তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান ১৯৭২ সালের ১৬ আগস্ট ভারতে সফর শুরু করেন। এ সফরের সময় তিনি ভারতের তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এস এম নন্দ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জাগিভান রামের সঙ্গে দেখা করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নৌবাহিনী গড়ার জন্য সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস পান। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল ভারতের দেওয়া পেট্রল ক্রাফ্ট ‘বিএনএস পদ্মা’ বঙ্গোপসাগরের নীলজলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধিপত্য ঘোষণা করে। ১৯৭৩ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া ৩০ জন অফিসারসহ প্রায় ২ হাজার ৫০০ নৌসেনা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে। জাতির পিতা তাদের নৌবাহিনীতে চাকরির সুযোগ করে দেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিএনএস ঈসা খান, (চট্টগ্রাম); বিএনএস মহসীন (ঢাকা) এবং বিএনএস তিতুমীর (খুলনা) নামের তিনটি নৌঘাঁটির গোড়াপত্তন করেন, যা নৌবাহিনীর অগ্রযাত্রার পথ উন্মোচন করে। ১৯৭৪ সালের ১০ নভেম্বর জাতির পিতা নিজ হাতে চট্টগ্রামস্থ নৌঘাঁটি বিএনএস ঈসা খানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে ‘নেভাল স্ট্যান্ডার্ড’ বা নৌবাহিনীর সম্মানসূচক পতাকা তুলে দেন। এদিন তিনি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শক্তি, সামর্থ্য ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের পরবর্তী বছর (১৯৭৬ সাল) বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয় ব্রিটিশ নৌবাহিনী থেকে প্রাপ্ত শক্তিশালী সমুদ্রগামী নৌ ব্রিগেড বিএনএস ওমর ফারুক।

 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো- চট্টগ্রাম বন্দর এবং তৎসংলগ্ন উপকূলীয় জলভাগ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচলের জন্য ঝুঁকিমুক্ত করা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নৌ-কমান্ডোরা জলসীমায় বেশকিছু পাকিস্তানি নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ও তাদের সহায়তাকারীদের সাধারণ নৌযান ধ্বংস করে। এর অধিকাংশ তখন ডুবে যায়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানিরাও কিছু নৌযান ও পন্টুন ধ্বংস করে ডুবিয়ে দেয়। পানির নিচে সক্রিয় মাইনও পোঁতা ছিল বেশকিছু। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ডুবন্ত জাহাজ, পন্টুন ও মাইন সরানোর জন্য তার দক্ষ জনবল পাঠায়। তাদের কমান্ডার জোর কোভ চট্টগ্রাম বন্দরে নিরাপদে জাহাজ ভেড়ার সব প্রক্রিয়া মাত্র ৬ মাসের মধ্যে সমাপ্ত করেন। একজন সোভিয়েত নৌসেনা এ দায়িত্ব পালন করে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের প্রতিশ্রুতি পান। একই মাসের (মার্চের) ২১ তারিখে ৯ সদস্যের সোভিয়েত অগ্রগামী দল ঢাকায় আসে এবং মাত্র ৩৪ ঘণ্টার মধ্যে উভয়পক্ষ চুক্তি স্বাক্ষর করে। ২ এপ্রিল ১৯৭২-এ রিয়ার অ্যাডমিরাল সারজি প্যাভলোভিচ জুয়েনকোর নেতৃত্বে ১০০ নৌসেনার আরেকটি দল বাংলাদেশে পৌঁছে। আর মে মাসের ৪ তারিখের মধ্যে ২২টি যুদ্ধজাহাজ ও ৭০০ নৌসেনার সোভিয়েত দল বাংলাদেশের জলসীমায় পৌঁছে এবং কাজে নেমে পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ প্রবেশ ও বের হওয়ার মূল চ্যানেল থেকে ৩০টি ডুবন্ত জাহাজ ও অসংখ্য মাইন অপসারণ করে এই রাশিয়ান নৌসেনারা। জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে একাংশ মাইনমুক্ত ঘোষণা করে সোভিয়েত নৌসেনারা। পরবর্তীতে আরও ডুবন্ত জাহাজ, পরিত্যক্ত লোহা বা স্ক্র্যাপ এবং মাইন অপসারণ করে বন্দরসংলগ্ন প্রায় ১০০২ স্কয়ার মাইল জলসীমা ঝুঁকিমুক্ত করে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত করা হয়।

 

শূন্য থেকে যাত্রা করে বিমান বাহিনী

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী তাদের ‘পোড়ামাটি’ নীতি অবলম্বনের অংশ হিসেবে দেশের প্রায় সব বিমান ঘাঁটি, রানওয়ে, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) বিজয় লাভের দুই দিন পর বন্দীদশা থেকে মুক্ত এবং মুক্তি বাহিনীর হাতেগোনা বিমান সেনারা (অফিসার) রেডিও মারফত সব বিমান সেনাকে ঢাকা সেনানিবাসের বর্তমান থার্ড গেট এলাকায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানায়। সমবেত এই বিমান সেনারা জাতির জনকের নির্দেশে শূন্য থেকে বিমান বাহিনীর পুনঃযাত্রা শুরু করেন। প্রথমদিকে তারা নিজেদের বন্দোবস্ত থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে এবং নিজ হাতে মাইনসহ ভগ্নস্তূপ সরিয়ে রানওয়ে প্রস্তুত করে। অকেজো বিমান ও হেলিকপ্টার রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজে ব্যবহার করা হয় পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া ও স্থানীয় ওয়ার্কশপে তৈরি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ। জাতির পিতার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দূরদর্শী চিন্তাভাবনা এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ ভাগে জেনারেল সোজোপের নেতৃত্বে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি দল বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে বিমান, এয়ার ডিফেন্স রাডার ও বিমান পরিচালনার জন্য অত্যাবশ্যকীয় অন্যান্য সরঞ্জাম প্রদানের প্রস্তাব নিয়ে শুভেচ্ছা সফরে আসে। এরই মাঝে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারত তিনটি অ্যালুয়েট থ্রি হেলিকপ্টার এবং একটি অটার বিমান প্রদান করে। এর কিছুদিন পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে দুটি ওয়েসেক্স (হেলিকপ্টার উপহার পাঠায় যুক্তরাজ্য। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তৎকালে অত্যাধুনিক মিগ-২১ সুপার সনিক যুদ্ধবিমান, এএন ২৪ এবং এএন ২৬ পরিবহন বিমান, এমআই ৮ হেলিকপ্টার এবং কিছুসংখ্যক এয়ার ডিফেন্স রাডার সংগৃহীত হয়। এভাবেই শূন্য থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। প্রথমদিকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট কোনো পোশাক বা ইউনিফর্ম ছিল না। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পোশাকই ব্যবহার করত বিমান সেনারা। ১৯৭৪ সালে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে খাকি সেলুলার ও ড্রিল কাপড় আমদানি করে প্রবর্তন করা হয় নিজস্ব পোশাক। একইভাবে প্রথমদিকে বাংলাদেশ বিমান সেনাদের প্রশিক্ষণের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বেশকিছু সংখ্যক নবীন অফিসার (ফ্লাইট ক্যাডেট) নির্বাচন করে তাদের রাশিয়া ও ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে অধিক সংখ্যক অফিসার তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসস্থ কুর্মিটোলায় ‘ক্যাডেট ট্রেনিং ইউনিট’ নামে একটি প্রশিক্ষণ ইউনিট খোলা হয়। ১৯৭২ সালে প্রথম স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ শেষে (২৬ মার্চ) বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে দুটি এফ-২৬ একটি টি-৩৩, তিনটি অ্যালুয়েট ও একটি আটার বিমান আকাশে কসরত করে সবাইকে মুগ্ধ করে। একই দিন (২৬ মার্চ ১৯৭২) বর্তমান বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আয়োজিত সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ছোট সন্তান শেখ রাসেলকে নিয়ে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর যুদ্ধ সরঞ্জাম পরিদর্শন করেন। এর আগে ১২ মার্চ ১৯৭২ সালে মিরপুরস্থ র‌্যাডার ইউনিট চালু করে দেশের আকাশ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

 

চিকিৎসাসেবায় অনন্য নজির

বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব মেডিকেল সার্ভিসেস; সংক্ষেপে ডিজিএমএস, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীখ্যাত মুজিবনগরে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। স্বাধীনতার পর পর ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মাইনুল রোডে এবং পরবর্তীতে ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকার ৫৭ নম্বর বাড়িতে এ মহাপরিদফতর স্থানান্তরিত হয়। এ মহাপরিদফতরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও কারিগরি নিয়ন্ত্রণে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এক মাসেরও কম সময়ে (৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২) আহত ও অসুস্থ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী বিতরণের জন্য আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল স্টোরস ডিপে; সংক্ষেপে এএফএমএসডি  পুনর্গঠিত হয়ে কার্যক্রম শুরু করে। এ সময় চারজন জ্যেষ্ঠ অফিসার (ডাক্তার) কুমিল্লা, যশোর ও রংপুরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) পরিচালনার হাল ধরেন। একইভাবে নিয়োগ পান নৌ ও বিমান বাহিনীর চিকিৎসাবিষয়ক পরিচালক। মুক্তিযুদ্ধের পর পর ডেন্টাল সার্জন মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট মারজুক আহম্মেদ ৪ জন নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অফিসার (ডাক্তার) নিয়ে আর্মি ডেন্টাল কোরের নবযাত্রা শুরু করে। ১৯৭৩ সালে স্বল্পসংখ্যক প্রশিক্ষিত নার্স নিয়ে সেবায় নিবেদিত হয় আর্মড ফোর্সেস নার্সিং সার্ভিস। এ দলের অন্যতম সদস্যা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা কনক প্রভা সরকার। ১৯৭৩ সালের ২৩ জানুয়ারি কুমিল্লায় স্বাধীন দেশের প্রথম মেডিকেল ইউনিট ৫ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা সেনানিবাসে। রংপুরে কার্যক্রম শুরু করে ১০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স যা ১৯৭৪ সালের ১৯ জানুয়ারি সৈয়দপুরে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তথা বঙ্গবন্ধুর আদেশে ঢাকায় গঠিত হয় ১১ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও যশোরে ব্রিটিশ আমল থেকেই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ছিল। জাতির জনক দেশে ফিরে এসব হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ও সেবার মান বৃদ্ধি করেন। ১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারি সিএমএইচ রংপুর প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আহত ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিশেষ ব্যবস্থা করেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পরই এই উদ্যোগ নেন। এ বছরেই তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে ২৪ জন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অনুরোধে এই সংখ্যা বেড়ে ২৬-এ দাঁড়ায়। সদ্য স্বাধীন দেশের এ ২৬ জনের কোনো পাসপোর্টও ছিল না। তথাপি পূর্ব জার্মান সরকার বিশেষ ভাড়া করা বিমানে এ ২৬ জনকে বার্লিনে নিয়ে যায় ও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এ দলের দলনেতা ছিলেন মেজর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমিন আহাম্মেদ চৌধুরী। আর উল্লেখযোগ্য অন্যরা হলেন মেজর (জেনারেল) হারুন আহম্মেদ চৌধুরী, মেজর (পরবর্তীতে পররাষ্ট্র সচিব) সমশের মবিন চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন (মেজর) শরীফুল হক ডালিম (বঙ্গবন্ধুর ঘাতক দলের সদস্য)। প্রায় ২ মাসের টানা চিকিৎসা শেষে এই দল প্রায় সুস্থ ও কর্মক্ষম অবস্থায় দেশে ফিরে আসে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা আজ শান্তিরক্ষী হিসেবে বিশ্বময় বিচরণ করছে। বহিঃবিশ্বে সেনাদল পাঠানোর পথ দেখান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের এক পর্যায়ে ১৯ অক্টোবর মেডিকেল কোরের সাতজন অফিসার ও একুশজন সেনা সদস্য সর্বপ্রথম বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব ও দক্ষতা প্রমাণ করে।

বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে মাত্র সাড়ে তিন বছর মেয়াদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়। জাতির জনকের দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল পূর্ব পরিকল্পনা মতো ২৫ মার্চের পর ভারতে পাড়ি জমান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। শেখ কামাল ভারতীয় সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অন্য বাঙালি নবীন অফিসারদের (ক্যাডেট) সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করেন। এরপর একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং জেনারেল ওসমানীর এডিসি বা বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন। তার দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামাল ও অন্যদের সঙ্গে যোগ্যতার মানদ-ে উন্নীত হয়ে ১৯৭৪ সালে ইংল্যান্ডের স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। তার ছোট ছেলে শেখ রাসেলেরও শখ ছিল সেনা অফিসার হওয়ার, যা বঙ্গবন্ধু বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায় সেনাবাহিনীর প্রতি জাতির পিতার আগ্রহ ও মমত্ববোধ।

পাকিস্তানে ৯ মাসের বন্দীদশা শেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ওইদিনই রেসকোর্স ময়দানে এক আবেগময় ভাষণে তিনি সেনানায়কের মতো আহত, নিহত ও সুস্থ-অসুস্থ সব মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সম্মান জানান। এ ভাষণে তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত সব ভারতীয় বাহিনী ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। যা বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে তিনি সব বিরোধীপক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান।

বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও ভূমির গঠন বিবেচনায় দেশের সেনাবাহিনী যে পদাতিক বাহিনী নির্ভর করা প্রয়োজন, শুরুতেই উপলব্ধি করেন জাতির পিতা। তাই দেশের ঊষালগ্নে (১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল) এক সরকারি আদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংগঠনিক কাঠামো ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস’ ভেঙে স্বতন্ত্রভাবে বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী গড়ার নির্দেশ দেন। একই বছর ২৮ আগস্ট ‘কমান্ড হেডকোয়ার্টার্স’ নামে এবং ১৯৭৪ সালে সেনাবাহিনী সদর দফতর’ নামে সেনাবাহিনীর মূল কমান্ড কাঠামো তৈরি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই এ সদর দফতরের বিভিন্ন শাখা, দফতর, পরিদফতর ও উইং প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে।

সৈন্য সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জাম বিবেচনায় তখন দেশে কোনো পদাতিক ডিভিশন প্রতিষ্ঠার সুযোগ ছিল না, তাই জাতির পিতার পরিকল্পনায় স্বাধীনতার পরপরই ঢাকায় ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড ও যশোরে ৫৫ পদাতিক ব্রিগেড যাত্রা শুরু করে। ১৯৭২ সালের ১৩ মার্চ রংপুরে ৭২ পদাতিক ব্রিগেড এবং ১৬ জুলাই কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয় ৪৪ পদাতিক ব্রিগেড। এসব যোদ্ধা ব্রিগেডকে প্রশাসনিক ও লজিস্টিক সহায়তা দিতে ১৯৭২ সালে কুমিল্লায়, ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে এবং ১৯৭৪ সালে রংপুর, ঢাকা ও যশোরে স্টেশন সদর দফতর গড়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গোয়েন্দা সংস্থা ডাইরেক্টরেট অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (২ নভেম্বর), আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি (২৮ ফেব্রুয়ারি) এবং তৎকালীন ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স পার্চেজ (৪ জানুয়ারি)।

সেনা প্রশিক্ষণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে আটজন সেনা ও একজন বিমান বাহিনী অফিসারকে তিনি ভারতে পাঠান নতুন অফিসার (ক্যাডেট) নির্বাচন প্রক্রিয়া শেখার জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের হাতেই গড়ে ওঠে ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ড (আইএসএসবি)। এ সময় পূর্ব জার্মান প্রতিবছর বাংলাদেশের ১০০ জন করে নতুন অফিসার (ক্যাডেট) প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তার অফিসাররা আগে এদেশে যুদ্ধ করার ও দেশ রক্ষার কৌশল শিখুক। তাই ১৯৭২ সালেই ঢাকা সেনানিবাসের বর্তমান সেনাবাহিনী প্রধানের বাসস্থানের বিপরীত দিকে ‘ব্যাটেল স্কুল’ নামে দেশের প্রথম অফিসার প্রশিক্ষণ একাডেমি খোলার ব্যবস্থা করেন। একপ্রকার শূন্য থেকে যাত্রা করা এ প্রতিষ্ঠানে প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত ৫৫ জন তরুণ অফিসারকে (ক্যাডেট) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ দেখার কথা থাকলেও অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার উদ্দেশে হঠাৎ লন্ডন চলে যাওয়ায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী উক্ত অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালের ২৯ নভেম্বর কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি, যা পরে ভাটিয়ারিতে স্থানান্তরিত হয়, ১৯৭৪ সালের ৯ জানুয়ারি ৭০ জন তরুণ নতুন অফিসার (ক্যাডেট) নিয়ে এ একাডেমি যাত্রা শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি জাতির পিতা স্বয়ং প্রথম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন এবং এই একাডেমি সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার আশা ব্যক্ত করেন, যা আজ পূরণ হয়েছে।

১৯৭২ সালের ২০ এপ্রিল কুমিল্লা সেনানিবাসে আর্টিলারি রেকর্ডস গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গোলন্দাজ (আর্টিলারি বা কামান ব্যবহারকারী) বাহিনী প্রতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে আর্টিলারি সেন্টারকে ‘কম্বাইন্ড আর্মস স্কুল’ হিসেবে যশোরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘ইঞ্জিনিয়ারিং উইংও খোলা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৯ মার্চ পদাতিক বাহিনীর জন্য কুমিল্লা সেনানিবাসে ‘স্কুল অব ইনফেন্ট্রি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ স্কুল ও পরে যশোরে কম্বাস এর সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৯৭৪ সালের ২১ জানুয়ারি ‘স্কুল অব ইনফেন্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস্’ এর ‘রণকৌশল’ শাখা যাত্রা শুরু করে। একই বছর (১৯৭৪) ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধের এক বধ্যভূমি ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টার’ চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আগের স্থানেই নতুন উদ্যমে গড়ে ওঠে।

প্রশাসনিক দিকেও নজর ছিল জাতির জনকের।

 

১৯৭২ সালের ১১ মার্চ থেকে অনুষ্ঠানিকভাবে সরবরাহ ও যান পরিদফতর এবং এর অধীনে পাঁচটি স্টেশন সাপ্লাই ডিপো এবং দুটি মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট প্লাটুন যাত্রা শুরু করে। সেনাবাহিনীতে গোলাবারুদ সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ২০ নভেম্বর অ্যামুনিশান ডিপো গড়ে ওঠে রাজেন্দ্রপুরে। আর ঢাকাস্থ সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপোতে ২৭ নভেম্বর গড়ে ওঠে অর্ডন্যান্স স্কুল। ১৯৭৪ সালে এ ঢাকাতেই ৬০১ কম্বাইন্ড ওয়ার্কশপে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ট্রেনিং সেল’। অপরদিকে সেনাবাহিনী সদর দফতরের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (এমআই) পরিদফতরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গোয়েন্দা প্রশিক্ষণের কার্যক্রম শুরুর মধ্য দিয়ে ‘আর্মি স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স’ এর যাত্রা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর সময়েই খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় নতুন সেনানিবাস নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১৯৭২ সালে গাজীপুরে মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসপ্রায় বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানা নব উদ্যমে অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মূল চালিকাশক্তি হলো পদাতিক বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ২৩ বছরে পদাতিক বাহিনীর ৮টি পূর্ণাঙ্গ ইউনিট বা রেজিমেন্ট গড়ে উঠেছিল, যা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে অধিক পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গড়ে ওঠে আরও ৪টি ইউনিট। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসন আমলে এ রেজিমেন্টের আরও ৭টি ইউনিট (১৩ থেকে ১৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে ওঠে)। গোলন্দাজ (আর্টিলারি) পরিবারে জন্ম নেয় ৫টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ইউনিট, একটি এয়ার ডিফেন্স রেজিমেন্ট এবং আর্টিলারি পরিদপ্তর। জাতির পিতা যুগোশ্লাভিয়া থেকে এসব ইউনিটের জন্য কামান ও অন্যান্য যুদ্ধসামগ্রী সংগ্রহ করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে সাড়া দিয়ে মিসরের তৎকালীন সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত ১৯৭৩ সালে রাশিয়ায় নির্মিত ৩০টি টি ৫৪ ট্যাংক উপহার দেন। এ ট্যাংক নিয়েই পরবর্তীতে সাঁজোয়া (ট্যাংক) বাহিনী গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পরপরই দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে ৫টি ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় যা ক্রমান্বয়ে পরিপূর্ণ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন হিসেবে গড়ে ওঠে। এরমধ্যে ১ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ন সালের ১ মার্চ যাত্রা শুরু করে। যোগাযোগের জন্য ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ (বিজয় দিবসেই) ঢাকার সিগন্যাল গেটে ০১ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন এবং ১৯৭৪ সালের ১১ জানুয়ারি আর্মি স্ট্যাটিক সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন যাত্রা শুরু করে। এভাবেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ফুল, ফল, শাখা, প্রশাখা ও পাতায় পাতায় ভরে ওঠে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ নামের মহাবৃক্ষ যা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী সৈন্য প্রেরণকারী দেশ।

আজ একথা ভাবতেও ঘৃণা হয় যে, একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার আরও একটি পরিচয় তিনি ছিলেন দুজন সেনা অফিসারের জন্মদাতা পিতা। অবাক লাগে যখন ভাবি ঘাতকদের একজন ছিলেন মেজর শরফুল হক ডালিম, যাকে বঙ্গবন্ধু জার্মানি পাঠিয়ে চিকিৎসা করান। নিয়তির নির্মম পরিহার হত্যাকান্ডের সময় ভয়ভীতি দেখানোর জন্য যে ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল, তা-ও ছিল বঙ্গবন্ধুর সৌজন্যে মিসর থেকে প্রাপ্ত।

 

[বি: দ্র: এই প্রবন্ধের সব তথ্য বিভিন্ন গ্রন্থ ও সবার জন্য উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার থেকে নেওয়া হয়েছে।]

সর্বশেষ খবর