মঙ্গলবার, ৭ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা
সংযমের মাসে ভেজালের বিস্তার

ক্ষতিকর ইফতারসামগ্রী থেকে সাবধান

জিন্নাতুন নূর

ক্ষতিকর ইফতারসামগ্রী থেকে সাবধান

ক্ষতিকর রং ব্যবহারে ইফতার সামগ্রী আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কার্বাইড দিয়ে পাকানো কলা ধ্বংস করছে ভ্রাম্যমাণ আদালত —ফাইল ছবি

সিয়াম সাধনার মাসে যেখানে মানুষের আহারে, আচরণে সংযমী হওয়ার কথা সেখানে রোজার মাস এলেই প্রতিবার ঘটে উল্টো ঘটনা। এ মাসে মানুষের নানা রকম মজাদার ইফতারি সামগ্রীর প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। ক্রেতাদের আগ্রহের কথা মাথায় রেখে পাড়া-মহল্লা ছোট ইফতারির দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় রেস্টুরেন্টগুলোতে ভেজাল ও মেয়াদোাত্তীর্ণ খাবার বিক্রি হয়। মনে হয় যেন চারদিকে খাদ্য উৎসব শুরু হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে খাবারে ভেজাল বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাকে বেশ তত্পর দেখা যায়। এরপরেও ভেজালকারীরা খাবারে ভেজাল মেশাতে সক্রিয় থাকে। এবারও রোজা শুরুর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ইফতারে ব্যবহৃত খাদ্য ও পানীয়তে ভেজাল মেশানোর ঘটনা ধরা পড়ছে। সম্প্রতি ইফতারে ব্যবহৃত বিভিন্ন পাউডার দিয়ে তৈরি হওয়া শরবত ও মেয়াদোত্তীর্ণ-ছত্রাকযুক্ত খেজুর বাজারজাত করার দায়ে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে হাতেনাতে ধরে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

র‌্যাবের অভিযান থেকে জানা যায়, কাপড় উৎপাদনে ব্যবহৃত রং ও অননুমোদিত রাসায়নিক উপাদান দিয়ে সফট ড্রিংস তৈরি করার দায়ে সম্প্রতি রাজধানীর শনির আখড়ার একটি খাবার তৈরির কারখানা মালিককে জরিমানা করা হয়। সেখানে স্যাকারিন, ঘন চিনি, গ্লুকোজ পাউডার ও কাপড়ে ব্যবহৃত রং দিয়ে ‘জ্যাংক’ নামে সফট ড্রিংস তৈরি করা হচ্ছিল। এ ছাড়া সম্প্রতি যাত্রাবাড়ীর ফলের আড়তে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুর বিক্রির দায়ে এক ফল ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়। রোজার মাসে ইফতারে ব্যবহৃত খেজুরে এখন থেকেই ভেজাল মেশানো শুরু করেছে ভেজালকারীরা। গত ১৬ মে র‌্যাব ভেজালবিরোধী অভিযান চালায়। অভিযানে পাওয়া তথ্যে, রোজা সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুরের মজুদ করছে। রাজধানীর বাদামতলী এলাকা থেকে শতাধিক বস্তা খেজুরে ছত্রাক ও পোকামাকড় পাওয়া যায়। এ ছাড়া আলজেরিয়া, ইরাক, তিউনিশিয়ার বিভিন্ন নামি-দামি ব্র্যান্ডের মেয়াদোত্তীর্ণ খেজুরের প্যাকেট জব্দ করা হয়। সারাদিন রোজার পর মানবদেহের প্রয়োজন পুষ্টিকর ও নির্ভেজাল খাবার। কিন্তু লোভনীয় সব ইফতার আইটেমের আকর্ষণে মানুষ টাকা দিয়ে কিনে খান বিষ মেশানো সব ইফতার আইটেম। পুষ্টিবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা জানান, বাইরে বিক্রি হওয়া ইফতারি আইটেমে ব্যবহৃত হয় মাত্রাতিরিক্ত কার্বাইড, ফরমালিন, কেমিক্যাল, রং ও মবিলসহ নানা রাসায়নিক পদার্থ, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিষাক্ত এ পদার্থগুলো শরীরে ঢুকে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে জটিল সব ব্যাধিতে। ভেজালবিরোধী অভিযানের তথ্যে জানা যায়, ইফতারের মুখরোচক পিয়াজু, বেগুনি, সবজিবড়া, বিভিন্ন কাবাব, আলুর চপ ও জিলাপির রং আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকারক সিনথেটিক রং। এমনকি খাবার মচমচে করতে যে তেলে এগুলো ভাজা হচ্ছে তাতে মবিল ব্যবহার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, টেক্সটাইল রং কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাছাড়া মবিলে ভাজা খাবার খেলে দেহে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়। এতে ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে এবং পরিপাক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও ক্ষতি হয়। মগবাজারের এক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী জানান, রং ব্যবহার না করলে খাবারের রং সুন্দর হয় না। এতে ক্রেতারাও খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হন না। এ ছাড়া এক শ্রেণির বিক্রেতা চটজলদি জিলাপি বানাতে এতে হাইড্রোজ ব্যবহার করছেন। আকর্ষণীয় করতে অনেক সময় জিলাপিতে লাল ও হলুদ সিনথেটিক রং মেশানো হচ্ছে। অন্যদিকে ছোলা সাদা করতে দোকানিরা হাইড্রোজ দিয়ে তা সিদ্ধ করেন। আর মুড়ি ভাজা হচ্ছে হাইড্রোজ বা ইউরিয়া সার দিয়ে। মূলত আকারে বড় ও সাদা করতেই এমনটি করা হচ্ছে। যাত্রাবাড়ীর এক মুড়ি বিক্রেতা জানান, ইউরিয়া সার ছাড়া মুড়ি ভাজলে তা লাল হয় আর লাল মুড়ির ক্রেতা নেই বলেই তিনি মুড়িতে সার ব্যবহার করেন।

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে ভেজাল হচ্ছে সেমাইয়ে। সেমাই কারিগররা অপরিষ্কার পা দিয়ে মাড়িয়ে নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সেমাই তৈরি করছে। এক শ্রেণির অসাধু কারখানা মালিক নামিদামি কোম্পানির ব্র্যান্ডের প্যাকেট ছাপিয়ে তাতে নকল সেমাই ভরে বাজারজাত করছে। সেমাই তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের আটা, পাম তেল, ডালডা ও ক্ষতিকর রং ইত্যাদি।

বিএসটিআইএ’র মহাপরিচালক ইকরামুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রোজা উপলক্ষে ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে আমরা বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করছি। পুরো রোজায় আমাদের অভিযান চলবে। বর্তমান আইনে শাস্তির মেয়াদ কম হওয়ায় বিএসটিআই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে রমজান মাসজুড়ে খাদ্যে ভেজাল এবং পণ্যদ্রব্য ক্রয়ে প্রতারণা রোধে সরকার জিরো টলারেন্সের নীতি নিয়েছে। বিশেষ করে ফলমূল, সেহেরি-ইফতারে ব্যবহৃত খাদ্য দ্রব্যে ফরমালিনসহ অন্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার প্রতিরোধ ও মাছ-মাংসসহ নিত্যপণ্য নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি বন্ধে কঠোর নজরদারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এজন্য রমজান মাসজুড়ে মাঠে থাকবে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো। র‌্যাব-১০ এর  কমান্ডিং অফিসার (সিও) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রোজা উপলক্ষে র‌্যাবের সম্প্রতি পরিচালিত অভিযানে ১২ লাখ টাকার ২০০ মণ পচা ও ভেজাল খেজুর নষ্ট করা হয়। এ ছাড়া মধুমাসে ব্যবসায়ীরা ফলে রাসায়নিক মেশাচ্ছেন কিনা তা দেখতে অভিযান চালানো হচ্ছে। বড় ব্যবসায়ীরা ফলে যাতে ভেজাল না মেশান তার জন্য এখন থেকেই তাদের ‘মোটিভেট’ করার কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর