বুধবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

নারী যাত্রীর নিত্য ভোগান্তি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

নারী যাত্রীর নিত্য ভোগান্তি

রাজধানীর গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। অনেকেই শিকার হন যৌন হয়রানির। কিছু বাসে সিট নেই বলে হেলপাররা নারী যাত্রীদের বাসে উঠাতে চায় না; নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসে থাকেন পুরুষ যাত্রী

কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি স্তরে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও প্রতিদিনের যাতায়াতে পরিবহন সমস্যায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন তারা। অফিসে কর্মক্ষেত্রে যাওয়া-আসার পথে ভিড় ঠেলে বাসে উঠতে দুর্ঘটনা এবং যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন কর্মজীবী নারীরা। রাজধানীতে নারীদের জন্য বিআরটিসির ১৫টি বাস বরাদ্দ থাকলেও রাস্তায় কখনো চোখে পড়ে না সেই বাস সার্ভিস।

সরেজমিন দেখা যায়, সকাল ৯টায় মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে আগারগাঁওগামী বাসগুলোতে পুরুষ দৌড়ে ভিড় ঠেলে গাদাগাদি করে যাচ্ছেন। কিন্তু নারীরা বাসে উঠতে চাইলে সিট খালি নেই বলে একের পর এক বাস ফিরিয়ে দিচ্ছে কর্মজীবী নারীদের। অথচ এই বাসগুলোর অধিকাংশ সংরক্ষিত আসনে পুরুষ যাত্রীদের বসে থাকতে দেখা যায়। বাসে উঠতে না পেরে কর্মস্থলে পৌঁছতে দেরি হয় নারীদের। আর এই ভোগান্তি এড়াতে অনেক বেশি সময় হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হয় তাদের। প্রতিদিনের এই ভোগান্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী লায়লা আক্তার বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে সবার মাথা ব্যথা কিন্তু নারীদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে যে পরিবহন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা নিয়ে কারও চিন্তা নেই। প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এভাবে হয়রানি সহ্য করে অফিসে পৌঁছে কাজ করার ইচ্ছাই নষ্ট হয়ে যায়।

কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা নিয়ে বেসরকারি একটি সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, সারা দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির ৪৫০টি বাসের মধ্যে নারীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ১৭টি বাস। এর মধ্যে রাজধানীতে ১৫টি এবং চট্টগ্রামে চলছে ২টি বাস। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রুটে বাস সার্ভিস চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অন্য রুটে এই বাসের অনুমতি না থাকায় দুর্ভোগ কমেনি নারী যাত্রীদের। আর যে রুটে চালু আছে সেখানেও চোখে পড়ে না তাদের কার্যক্রম।

শাহবাগ থেকে উত্তরার রাস্তায় নিয়মিত যাতায়াত করেন সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী শরীফা বেগম। বাসে ওঠার জন্য দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে। নারীদের জন্য বরাদ্দ করা বাসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করি। মাসে একদিন নারীদের জন্য বরাদ্দ করা বাসকে রাস্তায় দেখতে পাই। এভাবে চলাচল করলে আমাদের কোনো উপকারেই আসবে না এই বাস। খাতা-কলম আর বক্তৃতায় বাস না থেকে রাস্তায় থাকলে প্রতিদিন এত ধাক্কা খেয়ে গণপরিবহনে যেতে হতো না। শুধু ধাক্কা নয় বেশি ভিড় থাকলে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় অনেক সময়। প্রতিবাদ করলে আশপাশের লোকের দৃষ্টিতে মনে হয় বলেই ভুল করে ফেলেছি।

বাসে যাতায়াতের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মিরপুর কলেজের শিক্ষার্থী ফারিয়া রহমান বলেন, কিছুদিন আগে বই কেনার জন্য বাসা থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছি। ব্যাগের পেছন পকেটে মোবাইল এবং টাকা রেখে ভিড় ঠেলে বাসে উঠার কিছুক্ষণ পরেই দেখি টাকা এবং ফোন কোনোটাই নেই। নারীদের সংরক্ষিত সিট থেকে শুরু করে সব সিটে পুুরুষ যাত্রীরা বসে এবং দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু আমার বসার বা দাঁড়ানোর মতো কোনো অবস্থা নেই। আবার আমার ফোন এবং টাকা হারানোর ব্যাপারেও নির্বিকার সবাই।

নারীদের সংরক্ষিত সিটে পুরুষ যাত্রী বসলে কিছু না বলার কারণ জিজ্ঞেস করলে তুরাগ পরিবহনের হেলপার মারুফ হোসেন বলেন, বাসে উঠে যে সিট ফাঁকা থাকে সেখানেই যাত্রীরা বসে পড়েন। সিট না থাকলে আমরা সাধারণত নারীদের তুলি না। আর পুরুষ যাত্রী যদি সংরক্ষিত আসনে বসে তাদের তো আর উঠিয়ে দেওয়া যায় না। তারাও তো রাস্তায় ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করেন। নারী যাত্রী না থাকলে আমরা তো আর সিট ফাঁকা রেখে ব্যবসার ক্ষতি করব না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারী যাত্রীদের ভোগান্তি দূর করতে রাজধানীতে যে বাসগুলো চলাচল করছে তা অধিকাংশ সময় ফাঁকা থাকে। এজন্য শুধু সকাল এবং বিকালে চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কর্মজীবী নারীরা হয়তো এই বাসে যাতায়াত করেন কিন্তু যেসব নারী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যাতায়াত করেন তারা এই বাসে উঠেন না। এজন্য এখন কোনো বাস বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। প্রয়োজন হলে বিষয়টি ভেবে দেখা হবে।

সর্বশেষ খবর