মঙ্গলবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আলোর খোঁজে হরিজন পল্লীর শিশুরা

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

আলোর খোঁজে হরিজন পল্লীর শিশুরা

খুপরি ঘরের ঘিঞ্জি পরিবেশেই বেড়ে উঠে বেছে নিতে হতো বাপ-দাদার পেশা। এখন হরিজন পল্লীর শিশুরাও স্কুলে যাচ্ছে। নানা সংকট আর অবহেলার মধ্যেই বিদ্যালয়মুখী রাজশাহীর হেতমখাঁ হরিজন পল্লীর শিশুরা।

ঘরে পড়ার পরিবেশ নেই, তবুও লেখাপড়ায় আগ্রহী তারা। এরই মধ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার সিঁড়ি ছুঁয়েছে এ পল্লীর শিশুরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছে কয়েকজন। আগে খুব বেশি হলে তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেত তারা। রাজশাহী নগরীর হেতমখাঁ হরিজন পল্লীতে সরেজমিন বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। রাজশাহী নগরীতে হরিজন সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল ১১ নম্বর ওয়ার্ডের হেতমখাঁ হরিজন পল্লী। প্রায় ৬শ’র বেশি পরিবারের বসবাস এখানে। ছোট ছোট খুপরি ঘর। এক ঘরেই পরিবারের সব সদস্যের বসবাস। কোনো কোনো ঘরে ৫/৬ জন থাকেন একসঙ্গে। কোনোরকমে যেন মাথাগোঁজার ঠাঁই তাদের। নারী-পুরুষ শিশুরা রাতদিন কাজেই ব্যস্ত থাকেন। জন্মের পর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিশুরাও ক্রমেই বাবা-মায়ের কাজে সহযোগিতা করে। এক সময় তারাও শহরের নোংরা আবর্জনা পরিষ্কারের পেশায় লেগে যান। কেউ সিটি করপোরেশনে ঝাড়–দার, কেউ বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন অফিসে পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। মাস্টাররোলেই আটকে থাকে তাদের জীবন। স্থায়ী চাকরির সুযোগও নেই। এখন এ পল্লীর শিশুরা স্কুলমুখী হয়েছে। যেন আঁধার ঘরে বসে শিক্ষার আলো ছোঁয়ার চেষ্টা তাদের।

কথা হয় পল্লীর কিশোরী তানিয়া রানীর সঙ্গে। ১৮ বছরের তানিয়া শত প্রতিকূলতার মাঝেও প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে এখন পড়ছে রাজশাহী নগরীর শহীদ কামারুজ্জামান সরকারি কলেজের ডিগ্রিতে (পাসকোর্স)। তার দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন রাজশাহী বিদ্যালয়ে, একজন আছেন এবি ব্যাংকে মাস্টাররোলে কর্মচারী। তাদের বাবা রামেশ্বর অন্য হরিজন বাসিন্দাদের মতোই কাজ করেন।

তানিয়া জানায়, তাদের পড়া চালিয়ে যেতে হয় নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে। এক ঘরেই বসবাস করতে হয়। পড়ার আলাদা কোনো যায়গা নেই। রাতের বেলা পুরো পল্লীতে গান-বাজনা চলে। এরইমধ্যে পড়াশোনা চালাতে হয় তাকে। ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার সময়ও পড়ার পরিবেশ পায়নি তানিয়া। এখনো একই অবস্থার মধ্যেই পড়াশোনা চলছে তানিয়া রানীর।          শুধু তানিয়া নয়, এ পল্লীর সব ঘরের শিশুরা এখনও ঘিঞ্জি পরিবেশে বেড়ে উঠে স্কুলে যাচ্ছে। তাদের পল্লীতেই আছে হরিজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেই সব ছাত্রই হরিজন পল্লীর। বাসায় বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করে স্কুলেও যাচ্ছে তারা। রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে পড়ছে সোনালি। পাশের মুসলিম উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার জেএসসি পরীক্ষা দেবে এ পল্লীর কিশোর ঋত্বিক। হরিজন পল্লী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমাপনীর প্রস্তুতি নিচ্ছে দিয়া। একই পল্লীর শিশু রুপালি পড়ছে রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীতে। আর রুপালি নামের একজন এবার একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী।

রুপালি, দিয়া, সোনালিরা জানায়, স্কুলে তাদের আলাদা থাকতে হয় শুধু হরিজন পল্লীর বলে। অন্যরা তাদের সঙ্গে মেশে না। তারপরেও তারা পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু নানা করণে শেষ পর্যন্ত প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। কারও বিয়ে হয়ে যায়, কেউ বাপ-মায়ের সঙ্গে কাজে নেমে পড়ে। হেতমখাঁ হরিজন পল্লীর বাসিন্দা ও মহানগর হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি বসন্তলাল জানান, তাদের নানা সমস্যা। আবাসন সংকট, কর্মসংস্থান নেই। ছেলে-মেয়েরা উপযুক্ত হলেও কাজ পাচ্ছে না। এর মধ্যে স্কুলের পরিবেশে মিশতে পারে না অনেকে। তিনি বলেন, এ পল্লীর শিশুরা স্কুলে গেলেও হরিজন পরিচয় পাওয়ার পর তাদের স্কুল থেকেই বের করে দেওয়া হতো। এখনো তাদের আলাদা থাকতে হয়। স্কুলে টিফিন পায় না হরিজনের শিশুরা। 

হরিজন পঞ্চায়েত কমিটির সহকারী মণ্ডল হরিলাল বাবু বলেন, তারা সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের একটি মন্দির আছে সেখানেও মেলে না কোনো অনুদান। স্থানীয় এমপি প্রতিশ্রুতি দিলেও কাজ করেননি তাদের উন্নয়নে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, রাজশাহী নগরীর বস্তি ও হরিজন পল্লীর উন্নয়ন প্রকল্পে এক কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে উন্নয়ন কাজের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর