মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

জেব্রা ক্রসিংয়ে পিষে মারার স্বাধীনতা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

জেব্রা ক্রসিংয়ে পিষে মারার স্বাধীনতা

বাস থেমে আছে জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর। মানুষ পার হচ্ছেন বাসের ফাঁক গলিয়ে। এই ঝুঁকির যাতায়াত বন্ধ হবে কবে? ধানমন্ডি থেকে তোলা ছবি : রোহেত রাজীব

গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর ‘জেব্রা ক্রসিংকে অবহেলা নয়’ নামে নগর পরিক্রমায় শীর্ষ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। প্রত্যাশা ছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ও যাত্রীদের সচেতনতায় জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারের সুফল মিলবে। রাস্তা পারাপারে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু ছয় মাস পরও এই স্বাধীনতার মাসেই জেব্রা ক্রসিংয়ে এক দুরন্ত স্বপ্ন পিষে মারার স্বাধীনতা দেখা গেল। জেব্রা ক্রসিংয়ের নিরাপদ সাদা-কালো পিচের ওপরই লাল তাজা রক্তের ছাপ রাঙিয়ে খুন করা হলো বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-এর ছাত্র আবরার আহম্মেদ চৌধুরীকে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন আবরার। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায়ই তার মর্মান্তিক মৃত্যু হলো। রাজধানীর প্রগতি সরণিতে ১৯ মার্চ সকালে সুপ্রভাত স্পেশাল সার্ভিসের একটি বাস আবরারকে চাপা দেয়। অথচ শিক্ষার্থী আবরার দাঁড়িয়েছিল জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা ছিল তার। সুপ্রভাতের হেলপার চালাচ্ছিল তখন বাসটি। এই অমানবিক হত্যাকাণ্ডের পর শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনে সুপ্রভাত পরিবহনের ৩৫০টি বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) আবরারের মৃত্যুর জায়গাটিতে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের ঘোষণা দেয়। রাজধানীর সড়কে এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অন্তত জেব্রা ক্রসিংয়ে রাস্তা পারাপার নিরাপদ হবে-নগরবাসী এটা আশা করতেই পারে।    

দেড় কোটি মানুষের রাজধানীতে অফিস এবং স্কুল শুরু ও শেষের সময় রাস্তায় গিজ গিজ করে মানুষ। একসঙ্গে অনেক মানুষ যখন ফুটপাথ, ফুটওভারব্রিজ রেখে রাস্তা দিয়ে এলোমেলোভাবে হাঁটে তখন সড়ক নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। গত বছর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর রাজধানীর জেব্রা ক্রসিংগুলো নতুন করে রং করা হয়। অনেক জায়গায় স্কাউটরা পথচারীদের জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারের অনুরোধ জানায়। দীর্ঘ অনভ্যস্ততায় পথচারীরা অবশ্য ভুলেই গেছেন এর সঠিক ব্যবহার। যানবাহনের ফাঁকে ফাঁকে ঝুঁকি নিয়েই সড়ক পার হন তারা। অন্যদিকে ড্রাইভাররাও জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামাতে চান না। পথচারী পার হচ্ছেন দেখেও দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে যেতে চান তারা। ড্রাইভারদের এই প্রবণতারই নির্মম বলি হলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আবরার। নগরীতে বেশির ভাগ জায়গায় সিগন্যালের জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে  দেখা যায়। বাস্তবতা হলো, ড্রাইভাররাই সড়ক শৃঙ্খলার মূল ব্যক্তি। সেই ড্রাইভারদের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো খুবই কঠিন। পথচারীদের নিরাপদে সড়ক পার হওয়ার জন্য সড়কের কালো পিচের ওপর সাদা দাগ কেটে জেব্রা ক্রসিং তৈরি করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, হাসপাতাল, বিপণিবিতানসহ জনসমাগমের জায়গাগুলোতে সহজ ও নিরাপদে পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং দেওয়া হয়। সাধারণ নিয়ম হলো, জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে সাদা দাগ সামনে রেখে গাড়ি থামতে হবে। কিন্তু কেউ  সে নিয়ম মানছে না। রাজধানীর বিভিন্ন সিগন্যাল এলাকা এবং অন্য যেসব জায়গায় জেব্রা ক্রসিং রয়েছে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার হলে সড়কের বিশৃঙ্খলা রোধ করা সম্ভব। জেব্রা ক্রসিংগুলোই হতে পারে সড়ক নৈরাজ্যের মোক্ষম সমাধান।

সম্প্রতি নগরীর রাস্তায় বিদ্যমান জেব্রা ক্রসিংগুলো ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ ও সিটি করপোরেশন। পথচারীদের  জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারের অনুরোধ জানানো হচ্ছে। কিন্তু নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যেসব স্থানে জেব্রা ক্রসিং আছে, সেখানে এর ব্যবহার তেমন নেই। অনেক জায়গায় ক্রসিংয়ের সাদা দাগের ওপরেই যানবাহন থেমে থাকছে। জেব্রা ক্রসিংয়ের কাছাকাছি এলে গাড়ির গতি কমানোর নিয়ম। কিন্তু অধিকাংশ ড্রাইভার সেটা মানেন না। অধিকাংশ ড্রাইভার জানেনই না জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামাতে হয়। জেব্রা ক্রসিংয়ে পথচারীদের পারাপারের সময় কিংবা হাত দিয়ে ইশারা দেওয়া হলেও গাড়ির গতি কমে না। অথচ ভুটানে দেখা যায় এর বিপরীত চিত্র। জেব্রা ক্রসিংয়ের কাছে পথচারী এসে দাঁড়ালেই চলমান গাড়ি থেমে যায়। চালক দূর থেকেই লক্ষ্য রাখে পথচারীর গতিবিধি। পথচারী রাস্তা পার হতে পারেন এই ভেবে চালক আগে থেকেই গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। এই বিরল দৃশ্য দেখা যায় প্রশান্তির দেশ ভুটানের রাস্তায়। দেশটিতে ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়া শুধু জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর ভর চলছে পুরো পরিবহন ব্যবস্থা। আমাদের মতো কেউ ব্যস্ত রাস্তায় দৌড় দেয় না। চালকদেরও আগে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পথচারীদের রাস্তা পারাপারে কোন জায়গাগুলোতে ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখানকার ফুটপাথগুলো ঢালু করতে হবে। শুধু জেব্রা ক্রসিং তৈরি করলে হবে না তার আগে সীমারেখা টেনে গাড়ি থামানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পথচারী কতক্ষণ ধরে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হতে পারবেন সেই সময় নির্ধারণ করতে হবে। এর পাশাপাশি কতক্ষণ পর পর মানুষের পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং এ গাড়ি দাঁড়াবে সেটাও সিগন্যালের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিতে হবে। গাড়ি সীমারেখা লঙ্ঘন করলে কঠোর জরিমানার ব্যবস্থা রাখতে হবে। জেব্রাক্রসিং ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এই উদ্যোগগুলো নিলে মানুষের আগ্রহ বাড়বে কমবে      দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

 

সর্বশেষ খবর