মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

মৃত্যুর ক্ষণ গুনছে কাটাসুর খাল

শামীম আহমেদ

মৃত্যুর ক্ষণ গুনছে কাটাসুর খাল

বাঁধাই করা খালের পাড়। বাতাসে দুলছে টলমলে পানি। সেই পানিতে তরতর করে চলছে ছোট ছোট ডিঙি। সাঁতার কাটছে শিশু-কিশোররা। সকাল-বিকাল খালের পাড়ে ঝিরিঝিরি বাতাসে হাঁটাহাঁটি করছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। বৃষ্টি এলেই আশপাশের সব পানি খাল দিয়ে গিয়ে পড়ছে নদীর বুকে। দৃশ্যটা হওয়ার কথা ছিল এমনই। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। নামের মতোই সুর কেটে গেছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও বসিলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কাটাসুর খালের। খাল ভরাট করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। নেই প্রবাহ। আবর্জনায় ভরে আছে খালের বেশিরভাগ অংশ। সেই আবর্জনায় জন্মেছে বড় বড় ঘাস। কুচকুচে কালো পচা পানি ছড়াচ্ছে উৎকট গন্ধ।

গেল ২৯ বছরে রাজধানীর ৩৬টির বেশি খাল বিলীন হয়ে গেছে। বাকি ২৬টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও তা এখন সরু নালা। অবৈধ দখল, আবর্জনার স্তূপ অধিকাংশ খালের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে ঢাকা। অস্তিত্ব হারাতে বসা সেসব খালের একটি কাটাসুর। ডিএনসিসির ৩৩ ও ৩৪নং ওয়ার্ডের বিশাল অংশজুড়ে এ খালের অবস্থান। গত রবিবার পশ্চিম কাটাসুর এলাকার বসিলা রোডের কাছে গিয়ে কাটাসুর খালের যে অংশটি পাওয়া গেল তাতে নেই কোনো প্রবাহ। দেখে মনে হতে পারে পুরনো ময়লার ভাগাড়। ময়লার ওপর জন্মেছে এক-দেড় ফুট লম্বা ঘাস। কালো পানি থেকে বের হচ্ছে উৎকট গন্ধ। খালের ওই অংশে আঁধা কিলোমিটারের মধ্যেই তিন জায়গায় খাল বন্ধ করে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। আছে দুটি কালভার্ট। রাস্তার নিচে বসানো সরু পাইপ দিয়ে কোনোরকমে ময়লা পানি এক পাশ থেকে আরেক পাশে যাচ্ছে। খাল বন্ধ করে তৈরি করা প্রতিটা রাস্তার পাশে ময়লা ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে অনেকটা অংশ। ভরাট অংশে (খালের ওপরে) রাখা হয়েছে রিকশা, ভ্যানসহ বিভিন্ন মালামাল। একটি রাস্তা ভেঙে তৈরি করা হচ্ছে বক্স কালভার্ট। খালের জায়গা দখল করে দুই পাড়েই গড়ে উঠেছে অসংখ্য বহুতল ভবন ও দোকান। পশ্চিম কাটাসুর থেকে কাদেরাবাদ হাউজিং ও বছিলা সড়কের দক্ষিণ পর্যন্ত হেঁটে দেখা গেছে, খালের ওপর দিয়ে চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে একাধিক কালভার্ট। কালভার্টগুলোর নিচে রাখা সরু পথ দিয়ে আস্তে আস্তে বের হচ্ছে আবর্জনা পচা কালো পানি। পুরো খালই আবর্জনায় ঢাকা। গতিহীন খালটি বছিলা সড়কের নিচ দিয়ে চলে গেছে উত্তরে। এখান থেকে রামচন্দ্রপুর খালের শুরু বলে জানান স্থানীয়রা।

পশ্চিম কাটাসুরের বাসিন্দা খলিলুর রহমান (৬৮) বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে এ এলাকায় থাকি। এখানে আগে নদী ছিল। কাটাসুর খালটি পরে হয়েছে। তবে খালটি আরও অন্তত তিনগুণ বড় ছিল। ঘরবাড়ি উঠে এখন ছোট হয়ে গেছে। সারা দিন মানুষ ময়লা ফেলে। কে কাকে নিষেধ করবে? খাল দিয়ে এখন পানি যেতেই পারে না। একটু বর্ষা হলেই এলাকা ডুবে যায়। খালের সব ময়লা ঘরবাড়িতে ঢোকে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব বলেন, মাঝে-মধ্যেই খাল পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু, সকালে পরিষ্কার করলে দুপুরের মধ্যে ময়লায় ভরে যায়। পলিথিনের ব্যাগ, প্লাস্টিকের বোতলে খাল-স্যুয়ারেজ লাইনগুলো আটকে যাচ্ছে। মানুষ নিজের ভালো না বুঝলে কত পরিষ্কার করে পারা যায়? খাল বন্ধ করে রাস্তা ও নিচু কালভার্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো সব ভেঙে উঁচু করে করা হচ্ছে। খালটিকে পাকা করে ড্রেনের মতো করা দরকার। সাবেক মেয়র আনিসুল হক খালগুলো সংস্কার ও উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আন্তঃবিভাগীয় বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন সেনাবাহিনীকে খাল উদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।

মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী রোডের চায়ের দোকানদার মো. আব্বাস বলেন, আমার বয়স এখন ৪২। ৫-৬ বছর বয়স থেকে এ এলাকায় থাকি। আমার দোকানের এখানে এক সময় ফল, সবজি, ধান নিয়ে বড় বড় নৌকা ভিড়ত। এটা ছিল বুড়িগঙ্গার অংশ। বর্ষায় পানি থইথই করত। বেড়িবাঁধ দেওয়ার পর জলাশয় ভরাট করে লোকালয় হয়ে গেছে।

 

সর্বশেষ খবর