মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অরক্ষিত ঢাকার ফ্লাইওভার

জয়শ্রী ভাদুড়ী

অরক্ষিত ঢাকার ফ্লাইওভার

ভোরবেলা খিলক্ষেত কাঁচাবাজারের সবজির ভ্যান উঠছে কুড়িল ফ্লাইওভারে, বাড়ছে দুর্ঘটনা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি ছবি : জয়ীতা রায়

সকাল ৭টা। রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যাচ্ছে সারি সারি ভ্যান-রিকশা। খিলক্ষেত থেকে কাঁচা সবজি ভর্তি করে খুচরো বিক্রির জন্য কুড়িল প্রান্তে নামছেন তারা। পাশ দিয়ে যাচ্ছে বাস, পিকআপ এবং মোটরসাইকেল। ধীরগতির এসব যানবাহনে ফ্লাইওভারের ওপরে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। লাগছে যানজট। এ ফ্লাইওভারে যাতায়াতকারী চালক এবং যাত্রীদের কাছে এ দৃশ্য প্রতিদিনের।

রাজধানীতে যানজট নিরসনসহ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আধুনিয়কায়নের জন্য পাঁচটি ফ্লাইওভার এবং দুটি ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। ফ্লাইওভারগুলো হলো- মহাখালী ফ্লাইওভার, খিলগাঁও ফ্লাইওভার, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, কুড়িল ফ্লাইওভার, মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভার। দুটি ওভারপাস হলো, বনানী এবং বিজয় সরণীতে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ফ্লাইওভারগুলো। সড়কবাতি, সিগন্যাল নষ্ট, নোংরা জমে ফ্লাইওভারের মুখে জমছে হাঁটু পানি। নজরদারি না থাকায় ফ্লাইওভারে ঘটছে ছিনতাই, হত্যার মতো ঘটনা। ফ্লাইওভারগুলো কোনো নির্দিষ্ট সংস্থার দায়িত্বে না থাকায় চলছে টানাপোড়েন। সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে সব ফ্লাইওভার না থাকায় নিয়মিত ঝাড়ু দেওয়া হয় না ফ্লাইওভারগুলো। মালিবাগ ফ্লাইওভারের কিছু অংশ উত্তর সিটি করপোরেশনে বাকি অংশ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায়। ফলে কোনো সংস্থা এ ফ্লাইওভারের রক্ষণাবেক্ষণে নজর দেয় না। এ সমন্বয়হীনতায় ফ্লাইওভার ঘিরে তৈরি হচ্ছে অপরাধীদের অভায়ারণ্য।    

মগবাজার ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে দোকান, অবৈধ পার্কিং, ফলের দোকান, মাছের হাট বসিয়ে চলছে সিন্ডিকেট বাণিজ্য। রাজারবাগ স্কুলের সামনে গড়ে তোলা হয়েছে লেগুনা স্ট্যান্ড ও মোটরসাইকেল পার্কিং। এছাড়া সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলের সামনে থেকে মৌচাক মার্কেট পর্যন্ত গাড়ির পার্কিং। শান্তিনগরের কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে, কারওয়ান বাজার এবং ইস্কাটনে ইউটার্ন এবং চৌধুরীপাড়ায় ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে এই তিন অংশে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে। নিউ ইস্কাটনের সড়ক ও ফুটপাথ অনেকটাই গাড়ি ব্যবসায়ীদের দখলে। মগবাজার থেকে বাংলামোটর ফ্লাইওভারের নিচে অস্থায়ী গাড়ির গ্যারেজ বানানো হয়েছে। এছাড়া ফ্লাইওভারে বসেছে চায়ের দোকান। অনেক জায়গায় আবার গভীর রাতে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে ফ্লাইওভারের নিচের অংশ রয়েছে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের দখলে।

মগবাজার, তেজগাঁও এবং চৌধুরীপাড়া-মালিবাগ-শান্তিনগর-রাজারবাগ ফ্লাইওভারে সড়কবাতি না জ্বলায় গভীর রাতে ফ্লাইওভারের ওপরে ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়। মাঝে মধ্যেই গভীর রাতে অন্ধকার ফ্লাইওভারের ওপর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। স¤প্রতি ছিনতাইকারীর অস্ত্রের আঘাতে মিলন নামে এক রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের চালক খুন হয়েছেন। রাতে ফ্লাইওভারে টহল পুলিশও থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে চলাচলকারীদের।

ফ্লাইওভারের মৌচাক-মালিবাগ অংশের সিগন্যাল বাতিও কাজ করছে না। ফ্লাইওভারের ওপরে ধূলাবালি, ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে দিনের পর দিন। সামান্য বৃষ্টিতেই ফ্লাইওভারের ওপরে পানি জমে থাকে। মহাখালী এবং মিরপুর ফ্লাইওভারের মুখে বৃষ্টি হলেই পানি জমে। ফ্লাইওভারগুলোর মুখে বাস থামিয়ে চলে যাত্রী ওঠা-নামা। এতে দ্রæতগতির গাড়িগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনার মুখে পড়ছে। গতকাল মহাখালী ফ্লাইওভারের জাহাঙ্গীর গেট প্রান্তে বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট পরিবহন, বিকাশ পরিবহনের বাসকে থামিয়ে যাত্রী তুলতে দেখা যায়। এ রুটের অন্য বাস যেন তাদের আগে যেতে না পারে এজন্য একপাশে না থামিয়ে রাস্তার মাঝে আড়াআড়ি করে রাখা হয়। এতে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, দ্রæতগতির গাড়ি ব্রেক কষতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা।

কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখল করে বসানো হয়েছে চায়ের দোকান। সকাল বেলা সবজির ভ্যান-রিকশা ওঠে এ ফ্লাইওভারে। এ রুটের রাইদা পরিবহনের চালক মনির হোসেন বলেন, খিলক্ষেতের রেললাইনের পাশের কাঁচাবাজার না সরালে এ সবজি পরিবহনকারীদের সরানো যাবে না। নিচ দিয়ে বিকল্প কোনো রাস্তা না থাকায় তারা ফ্লাইওভারের ওপর দিয়েই খিলক্ষেত থেকে কুড়িল যায়। অনেক সময় ফ্লাইওভারের ওপর একে অন্যকে ওভারটেকও করে। শুধু সকালে নয় দিনের অন্য সময়েও এ ফ্লাইওভারে রিকশা ওঠে বলে অভিযোগ করেন এ চালক।

ফ্লাইওভারগুলো প্রচুর অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব স্থাপনা। এ ব্যাপারে নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য দেশ ফ্লাইওভার ভাঙছে আর আমরা তৈরি করছি। যেহেতু নির্মাণ করাই হয়েছে তাই এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে নজর দেওয়া উচিত। সমন্বয়হীতায় টানাপোড়েন তৈরি না করে সিটি করপোরেশনকে এসব ফ্লাইওভারের দায়িত্ব দেওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘৫৪টি সেবা সংস্থার সমন্বয়হীনতায় এসব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নগর সরকার গঠন করে মেয়রকে এসব বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। এতে সরকারের জনগণের কাছে জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা তৈরি হয়।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর