মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাজপথ যেন মৃত্যুফাঁদ

শামীম আহমেদ

রাজপথ যেন মৃত্যুফাঁদ

ফুটওভারব্রিজ খালি পড়ে আছে। নিচে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বাংলামোটর থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি : রোহেত রাজীব

রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে গলিপথগুলো যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। সম্ভাবনাময় প্রাণের বিনিময়ে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ হলেও থামছে না রাজপথে যানবাহনের বেপরোয়া ড্রাইভিং। সড়ক থেকে সরছে না ফিটনেসবিহীন গাড়ি। লাইসেন্স ছাড়াই রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লাখো ভুয়া ড্রাইভার। রাস্তা ছেড়ে বাস ফুটপাথে উঠে কেড়ে নিচ্ছে পথচারীর প্রাণ। বিকল্প ব্যবস্থা না করে সারাবছর বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়িতে ভাঙাচোরা সড়কে ঘটছে নিত্য দুর্ঘটনা। কখনো দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে সড়কে উঁচু-নিচু ম্যানহোলের ঢাকনা, রংবিহীন অপরিকল্পিত গতিরোধক। অধিকাংশ পার্শ্বরাস্তায় মৃত্যুফাঁদ হয়ে আছে শত শত ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল। ফলে সকালে সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর পর তার অক্ষত ফিরে আসা নিয়ে উদ্বেগে

থাকছেন মা। পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটি দিনশেষে সুস্থ ফিরবেন কিনা সেই আতঙ্ক দিনভর তাড়া করে স্বজনদের।

ঢাকাবাসীকে প্রতিনিয়ত আতঙ্ক নিয়ে চলতে হচ্ছে রাস্তায়, ফুটপাথে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও মানুষের সঙ্গে কথা বলে সড়কের দুরবস্থা ও মানুষের আতঙ্কের চিত্রই চোখে পড়েছে
ঢাকাকে যানজটমুক্ত আধুনিক, পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ নগরী গড়ার অসংখ্য পরিকল্পনা এখন কাগজে-কলমে। কিছু কাজ চলছে। তবে কমছে না মানুষের ভোগান্তি। ঢাকাবাসীকে প্রতিনিয়ত আতঙ্ক নিয়ে চলতে হচ্ছে রাস্তায়, ফুটপাতে। ১১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১টা। রাজধানীর শাহজাদপুর থেকে হাতিরঝিলে যাওয়ার বাঁশতলা গলিপথটির মাঝ বরাবর ভাঙা ম্যানহোলে পড়ে যায় ঢাকা মেট্রো-চ ৫৩-৫৫২৮ নম্বরের মাইক্রোবাসের চাকা। সরু রাস্তাটির দুই পাশে আটকে যায় অনেক গাড়ি। স্থানীয়রা ধরাধরি করে মাইক্রোবাসটি গর্ত থেকে টেনে তোলেন। একইভাবে বিমানবন্দর সড়কে গত মাসে উচ্চগতিতে চলা একটি প্রাইভেটকার সড়ক থেকে উঁচু ম্যানহোলের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশে গিয়ে পড়ে। গাড়িটির একপাশ দুমড়ে-মুচড়ে যায়। সরেজমিন দেখা গেছে, বিমানবন্দর থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার রাস্তায় ৯টি ম্যানহোলের ঢাকনা সড়ক থেকে উঁচু-নিচু। অথচ এই সড়কটিতে অধিকাংশ সময় গাড়ির গতি থাকে ৭০-৮০ কিলোমিটার। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। শাহজাদপুর থেকে উত্তর বাড্ডা পর্যন্ত সড়কের ডান লেনে অসংখ্য গর্ত। বিপরীত দিকের সড়কে এমন অনেক ম্যানহোল পাওয়া গেছে যার কোনোটি সড়ক থেকে দুই ইঞ্চি নিচু। তুরাগ পরিবহনের চালক সাইফুল বলেন, এসব গর্তে চাকা পড়লে গাড়ি মুহূর্তে উল্টে যায়। তবে জায়গাগুলো মুখস্থ থাকায় আমরা সাবধানে চালাই। বাড্ডা-গুলশান লিংক রোডের গুদারাঘাটে তিনটি ম্যানহোলের ঢাকনা সড়ক থেকে এক-দেড় ইঞ্চি নিচু। একই সঙ্গে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীতে সিগন্যাল বাতি বসানো হলেও জ্বলে না সবগুলো। যেসব স্থানে জ্বলে সেখানে ট্রাফিক পুলিশ হাত উঁচু না করলে গাড়ি দাঁড়ায় না। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর জেব্রা ক্রসিংয়ে যানবাহনগুলোকে গতি কমাতে দেখা গেলেও ফের বদলে গেছে সে নিয়ম। জেব্রা ক্রসিংয়ে দাঁড়ায় না গাড়ি। ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে সড়ক পার হওয়ার পুরনো প্রথা ফিরে এসেছে। সড়ক থেকে উঁচু-নিচু বা ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল, তরুণ প্রজন্মের পাগলাটে ড্রাইভিং, যাত্রী তোলা নিয়ে গণপরিবহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, ভাঙাচোরা রাস্তা, মাদকাসক্ত চালকদের অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা গাড়ি চালানোর কারণে রাজধানীতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। রাজধানীর প্রতিটা সড়কের একাধিক স্থানে আইল্যান্ড ভেঙে গেছে গাড়ির ধাক্কায়। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বা জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হতে গিয়েও প্রাণ দিতে হচ্ছে পথচারীদের। গত ২৭ আগস্ট বাংলামোটরে ফুটপাথে উঠেই বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক কৃষ্ণা রানী রায়কে (৫২) চাপা দেয় একটি বাস। ১৯ মার্চ প্রগতি সরণিতে বাসের চাপায় শিক্ষার্থী আবরার আহমেদের মৃত্যু হয় জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপরেই।  গত বছর বিমানবন্দর সড়কে যাত্রী তোলা নিয়ে দুই বাসের প্রতিযোগিতার বলি হন বাসের অপেক্ষায় থাকা শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম। একই কারণে মৃত্যু হয় তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীবের। রাতে ঢাকার সড়কগুলো হয়ে উঠছে আরও ভয়ঙ্কর। এক শ্রেণির কিশোর মাদকাসক্ত হয়ে  মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামছে রাজপথে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ছিনতাইয়ে জড়িত। এদিকে রাজধানীর পার্শ্বরাস্তা ও গলিগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। সরেজমিন বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, অধিকাংশ সড়কে রয়েছে একাধিক ঢাকনাবিহীন ম্যানহোল। কোথাও এক-দেড় বছর আগে তৈরি নতুন সড়কের ম্যানহোলের স্লাবগুলোও ভেঙে গেছে। দুর্ঘটনা এড়াতে এলাকাবাসী ভাঙা স্লাবের কোনোটিতে বাঁশ, কোনোটিতে লাঠির মাথায় কাপড় বেঁধে নিশানা দিয়ে রেখেছে। ভাটারা এলাকার ছোলমাইদে খালেক ঢালী মার্কেটের সামনের সড়কের ঠিক মাঝখানে এমন এক খোলা ম্যানহোলে বাঁশ দিয়ে নিশানা দিয়ে রাখা হয়েছে। পুরো সড়কের প্রায় সব ম্যানহোলের স্লাবের অবস্থাই ভঙ্গুর। এসব এলাকার অনেক স্থানেই সড়কবাতি জ্বলে না। প্রতি রাতেই পথচারী বা যানবাহন এসব ম্যানহোলে পড়ছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর