মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাজধানীতে সারা দিনের স্কুল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

রাজধানীতে সারা দিনের স্কুল

সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সারা দিনের স্কুল। রবিবার দুপুরে তোলা ছবি : জয়ীতা রায়

ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট। সমস্বরে শিশুরা বলছে, ‘আমি বিশ্বাসী, আমি সাহসী, আমি পারি আমি করব আমার জীবন আমি গড়ব।’ এগিয়ে গিয়ে দেখা মেলে পাঁচ বছর বয়সী একদল শিশুর। শৈশব থেকেই শিখছে মনোবল, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানোর অনুশীলন। কোনোরকম ধাক্কাধাক্কি না করে লাইন ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে তারা।

পাশের কক্ষে কাগজ কেটে মানচিত্র বানিয়ে দেশকে চিনছে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। সকাল ৮টায় স্কুল শুরু হয়ে শেষ হয় রাত ৮টায়। পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুরা শেখে মেডিটেশন, ইয়োগা, সাঁতার, চিত্রাঙ্কন, ধর্মীয় শিক্ষা, গান, নাচসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রম। এ যেন এক সারা দিনের মজার স্কুল।

গৎবাঁধা ক্লাস-কোচিংয়ের গণ্ডি ভেঙে শিশুদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ‘ক্লাসে প্রথম জীবনে প্রথম’ বিশ্বাসকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলছে কসমো স্কুল। এক ছাতার নিচে এ যেন বিশ্বমানের মানুষ গড়ার কারখানা। মিরপুর-১২ নম্বরের বি-ব্লকের এক নম্বর সড়কে গড়ে তোলা হয়েছে সারা দিনের চলমান এই স্কুল। এই স্কুলের পাঠদান থেকে শুরু করে শেখানোর ধরন- সবকিছুতেই রয়েছে সুস্থ মানসিকতার শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা।

শিশুদের দৈনন্দিন কর্মতালিকা সম্পর্কে কসমো স্কুলের প্রিন্সিপাল স ম মাহবুব-উল আলম বলেন, সকাল ৮টায় শিশুদের ক্লাস শুরু হয়। প্রাক-প্রাথমিক ১ ও ২ এবং প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ছুটি হয় বেলা ১২টা ৪৫ মিনিটে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণির ক্লাস সকাল ৮টায় শুরু হয়ে শেষ হয় রাত ৮টায়। আমরা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বই পড়িয়ে থাকি। এর পাশাপাশি বাংলা-ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। সকাল থেকে দেড়টা পর্যন্ত ক্লাস চলে। এরপর শিক্ষার্থীরা পোশাক পাল্টে পরিচ্ছন্ন হয়ে হলরুমে দুপুরে একসঙ্গে খেতে বসে। বেশির ভাগ শিশুই খাবার বাসা থেকে নিয়ে আসে। খাবার সরবরাহেরও ব্যবস্থা আছে। শিশুদের প্রতি দিন খাবারের তালিকা করে দেওয়া আছে। বাড়ি থেকে সে অনুযায়ী খাবার আনতে হয়। এরপর নামাজ পড়ে শিক্ষার্থীরা ১৫ মিনিট মেডিটেশন করে। এরপর ১৫ মিনিট বিশ্রাম শেষে ৩টা ১৫ থেকে শুরু হয় সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং পড়াশোনা। সপ্তাহে দুদিন সাঁতার শেখানো হয়। তিনি আরও বলেন, চিত্রাঙ্কন থেকে শুরু করে নাচ, গান, গিটার শেখার ব্যবস্থা আছে। শিশু সহশিক্ষা কার্যক্রম কী শিখবে তা নির্ধারণ করতে শিশুদের সঙ্গে অভিভাবক এবং শিক্ষককে বসিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিশুর আগ্রহ এবং সৃজনশীলতার বিষয়টি শুধু শিক্ষক বুঝলে হবে না, অভিভাবককেও বুঝতে হবে। বিকালে নাস্তার ব্যবস্থাও আছে। আমরা চেষ্টা করি শিশুদের মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি থেকে দূরে রাখতে। শৈশব থেকেই শিশুদের জাঙ্কফুড, কোমল পানীয় কিংবা অস্বাস্থ্যকর খাবার থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা হয়। মেডিটেশনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ কিছু শিক্ষানুরাগী ২০১৩ সালে স্কুলটি গড়ে তোলেন। ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা ভবনে ক্লাস হয়। বনশ্রীতে স্কুলের আরেকটি শাখা খোলা হয়েছে। মিরপুরে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হলেও বনশ্রীতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত চালু হয়েছে। এই স্কুলে বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী ৫০২ জন। শিক্ষক রয়েছেন ১১৭ জন। এছাড়া চিকিৎসক ও স্টাফ মিলিয়ে রয়েছেন ৬৬ জন। শিশুদের বাসায় গিয়ে আর খুব একটা পড়াশোনার প্রয়োজন পড়ে না।

স্কুলের ভাইস-প্রিন্সিপাল বুশরা খানম বলেন, কোচিং সেন্টার এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পুরো উল্টো স্রোতে আমরা চেষ্টা করছি। সীমিত খরচে শিশুদের সুশিক্ষিত করে তোলা আমাদের দায়িত্ব। কোচিং না করে, ইন্টারনেটে আসক্ত না হয়েও যে পরীক্ষায় ভালো করা যায় তার প্রমাণ মিলেছে গত সাত বছরে। ২০১৭ সালে জেএসসির ফলাফলে ২৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে, পিএসসিতে ২৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৪ জন। অন্য বছরগুলোতেও ফলাফল এরকমই।

তিনি বলেন, বিকালে রুটিন অনুযায়ী শিশুরা সহশিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি পড়াশোনা করে। প্রতি ছয়জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন একজন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয়ে সমস্যা থাকলে তারা সমাধান করে দেন। লাইব্রেরিতে রয়েছে পড়াশোনার ব্যবস্থা, পাশের খেলার মাঠে খেলাধুলার ব্যবস্থাও রয়েছে। শিশুদের ‘সাইন্স অব লিভিং’ ক্লাসে আমরা জোর দিই। গুরুত্ব দিই নৈতিক শিক্ষার ওপর। অটোসাজেশনের মাধ্যমে শৈশব থেকে ভালো ধারণাগুলো শিশু মননে গেঁথে দেওয়া হয়। যেমন- ‘অন্যের ভুল ধরার আগে নিজের ভুল খুঁজে দেখব।’ শিশুদের বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাদুঘর, নভোথিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের স্বপ্নকে আরও স্পষ্ট করতে।

স্কুলের শিক্ষক উম্মে কুলসুম বলেন, হোম ইকোনমিক্স ক্লাসের জন্য শিক্ষার্থীদের বাজার করতে নিয়ে যাই। তারা নিজেরা বাজার করে নিয়ে আসে। তরকারি কেটে এখানেই তারা অল্প কিছু রান্না করে সবাই মিলে মজা করে খাওয়া-দাওয়া করে। এছাড়া সেলাইও শেখানো হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো, কোনো কাজকে ছোট না ভাবা এবং নিজের কাজ নিজে শেখানোর অভ্যস্ততা তৈরি করানোর জন্য এসব টাস্ক করানো হয়।

সারা দিন স্কুলে থাকতে কেমন লাগে জানতে চাইলে শিক্ষার্থী তাওছিয়া তারিন বলেন, সারা দিন কীভাবে কেটে যায় মনেই থাকে না। ক্লাস, হাসি, গল্প, নাচ করতে করতেই সময় পার হয়ে যায়। স্কুল বন্ধ থাকলেই বরং বাসায় মন খারাপ লাগে।

কর্মজীবী অনেক অভিভাবক নিশ্চিন্ত নির্ভরতায় সন্তানকে সারা দিনের স্কুলে পাঠিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিতে পারেন। স্কুলটিতে ভর্তির সেশন জানুয়ারি থেকে। তবে ভর্তি নিশ্চিত করতে বেশ আগে থেকেই যোগাযোগ করতে হয়। কসমো স্কুলের www.cosmoschools.org এই ওয়েবসাইটে বিস্তারিত জেনে শিশু সন্তানকে নিয়ে যে কোনো কর্মদিবসে বেরিয়ে আসা যায় এই স্কুল থেকে।

সর্বশেষ খবর