মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ড্রেনের ওপর ড্রাইভিং স্কুল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ড্রেনের ওপর ড্রাইভিং স্কুল

ড্রাইভিং শিক্ষায় চলছে নৈরাজ্য। নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাবে ফুটপাথে, ড্রেনের ওপর গড়ে উঠছে ড্রাইভিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাজধানীর উত্তরার রবীন্দ্র সরণি থেকে রবিবার তোলা ছবি : জয়ীতা রায়

ড্রেনের ওপর টং দোকান। চারপাশে পোস্টার লাগানো রয়েছে ‘এখানে ড্রাইভিং শেখানো হয়’। এম আর ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার নামের ওই প্রতিষ্ঠানের নাম নেই বিআরটিএর নিবন্ধিত সেন্টারের তালিকায়। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ১৪ নম্বর সড়কের মাথায় গিয়ে দেখা যায় ড্রেনের ওপর পাটাতন ফেলে তৈরি করা হয়েছে এ টু জেড মোটর ড্রাইভিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিবন্ধন ছাড়া ট্রেনিং স্কুল চালানোর বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক শহিদুল ইসলাম সাগর বলেন, নিবন্ধন নেওয়া ঝামেলার কাজ। দোকান থাকতে হয়। আমি এ ড্রেনের ওপরেই ১৫ বছর ধরে ড্রাইভিং স্কুল চালিয়ে আসছি। এখানে জায়গা না থাকায় দিয়াবাড়িতে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শুধু এ দুটি নয়। উত্তরার আজমপুরেই রয়েছে এরকম ৮টি প্রতিষ্ঠান। শহরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এরকম শত শত অবৈধ ড্রাইভিং স্কুল। বিআরটিএর নিবন্ধন তো নেই-ই, উল্টো ফুটপাথ, রাস্তা দখল করে চলছে জমজমাট ব্যবসা।

বিআরটিএর নিবন্ধনের তালিকায় দেখা যায়, দেশজুড়ে বিআরটিএর নিবন্ধিত স্কুল রয়েছে ১৩৪টি। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ৭৮টি এবং ঢাকার বাইরে রয়েছে ৫৬টি। সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির ড্রাইভিং স্কুল রয়েছে ১০টি, রানার ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টারের ৫টি, শ্যামলী আইডিয়ালের ৪টি, সোয়েব’স ওয়ান স্কুল অব ড্রাইভিংয়ের ২টি, মুসলিম এইড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের ২টিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে বাকিগুলো নিবন্ধন রয়েছে।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর ৩০-৩৫ হাজার চালকের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু অনুমোদিত ড্রাইভিং স্কুলগুলো থেকে প্রতি বছর প্রশিক্ষিত হচ্ছেন তিন থেকে পাঁচ হাজার চালক। বাকি চালক কীভাবে তৈরি হচ্ছেন- এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। চালকের এ চাহিদা মেটাতেই একের পর এক গড়ে উঠছে অবৈধ ড্রাইভিং স্কুল। ড্রাইভিং স্কুল চালু করতে বিআরটিএর অনুমোদন পাওয়ার শর্তে উল্লেখ আছে- প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জায়গা থাকতে হবে, লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণ উপযোগী ভালোমানের যানবাহন এবং যথাযথ উপকরণ থাকতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ স্কুলের নিজস্ব জায়গা নেই। অথচ বিআরটিএ থেকে তারাও অনুমোদন পাচ্ছে। শুরুতে বিআরটিএ থেকে লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষকদের দেখিয়ে অনেক স্কুল অনুমোদন নিলেও পরে তাদের দেখা পাওয়া যায় না। তখন ড্রাইভিং জানা যে কাউকে বানানো হয় প্রশিক্ষক। প্রশিক্ষকদের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য ভারী যানবাহন চালানোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং এসএসসি পাসের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অনুমোদনহীন স্কুলগুলো ঘুরে কোনো প্রশিক্ষকেরই লাইসেন্স পাওয়া যায়নি। সব ড্রাইভিং স্কুলের গাড়ি থাকে ভাঙাচোরা। যে গাড়িগুলোর রাস্তায় চলাচলের অনুমতি নেই, সেগুলোকে এ প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হয়। তারা ধরেই নিয়েছে যে রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী গাড়ি দিয়েই ড্রাইভিং শেখাতে হয়। অনুমোদনহীন স্কুলগুলো তাদের সাইনবোর্ড ও পোস্টারে নির্দ্বিধায় সরকার অনুমোদিত কথাটি চালিয়ে দিচ্ছে। বিআরটিএ পত্রিকার মাধ্যমে নোটিস দিয়ে সব অবৈধ স্কুলকে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে লাইসেন্স নিতে প্রায়ই নির্দেশনা দেয়। তা না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। কিন্তু এ বিজ্ঞপ্তি পর্যন্তই বিআরটিএ যেন তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। বিআরটিএর চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসান দেশের বাইরে থাকায় এ ব্যাপারে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অবৈধ ড্রাইভিং স্কুলের বিষয়ে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে কোনো ব্যক্তি ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করলে প্রশিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। তাহলে অবৈধ স্কুলের আর কোনো সুযোগ থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে সর্বস্বীকৃত এ মডেলের বাইরে গিয়ে লাইসেন্স দিয়ে দেওয়া হয়। কে, কোথায়, কার কাছে, কীভাবে শিখছে তার কোনো তথ্যই নেয় না বিআরটিএ। আমরা ভুল পদ্ধতি প্রয়োগ করে সড়ককে বিশৃঙ্খল করে তুলছি। এসব অদক্ষ চালকের জন্য আরও অনিরাপদ হয়ে উঠছে সড়ক। এ সুযোগে ব্যবসা করে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রশমনে সরকার তিন লাখ প্রশিক্ষিত চালক তৈরির একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ডিসেম্বর থেকে এটি শুরু হবে। ৬০ শতাংশ কাজ করবে সেনাবাহিনী। সে জন্য প্রথমে ১৪০০ ট্রেনার তৈরি করা হবে। যার মধ্যে ৮০০ ট্রেনার তৈরি করবে সেনাবাহিনী। বাকিগুলো বেসরকারি ড্রাইভিং ইনস্টিটিউশনগুলো করবে। এ চালক তৈরির প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান সব ড্রাইভিং স্কুলগুলোকে নিয়ে আসা গেলে উদ্যোগটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে। 

 

সর্বশেষ খবর