মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

ছাদে ঝুঁকছে ঘরবন্দী মানুষ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ছাদে ঝুঁকছে ঘরবন্দী মানুষ

করোনাকালে নগরীর অবসাদগ্রস্ত ঘরবন্দী মানুষ বাসা-বাড়ির ছাদের প্রতি ঝুঁকছে। ছাদই হয়ে উঠেছে খেলা, আড্ডা কিংবা সময় কাটানোর অন্যতম স্থান। ছবি : রোহেত রাজীব

ছাদে দাগ কেটে চলছে গোল্লাছুট, বৌছুট খেলা। করোনাভাইরাসের থাবায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। তাই বিকাল হতেই ছাদের স্বল্প পরিসরে খেলায় মেতে ওঠে রুমি-সুমি দুই বোন। তাদের মা ফাহমিদা আক্তার মাঝে মাঝে মেয়েদের খেলার মুহূর্তগুলোর ভিডিও দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

বাইরে বেরুতে করোনার ভয়। ঘরের চার দেয়ালে স্বেচ্ছাবন্দী জীবন। তাই খোলা আকাশের নিচে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে ছাদই মানুষের শেষ ভরসা। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের অবসর সময় কাটছে ছাদে। কেউ ছাদে লাগাচ্ছেন ফুল, ফলসহ বাহারি গাছ। কেউ ঝড়ো বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছেন বাহারি রং নকশার ঘুড়ি। অনেকে ছাদে ব্যায়াম করছেন। অনেকে ছাদের চারকোণ ছুঁয়ে প্রতিদিনের হাঁটার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করছেন। ছাদে দাবা, লুডু, ক্যারাম খেলা জমে উঠেছে। বৃষ্টিতে মন ভেজাতে শহুরে বাসিন্দাদের প্রিয় জায়গা ছাদ।

মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের কয়েকটি বাসার ছাদে বিকাল হলেই শিশুদের দৌড়াদৌড়ি চোখে পড়ে। ব্যাট-বল নিয়ে ক্রিকেট খেলায় মেতে ওঠে তারা। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সাব্বির রহমান বলেন, প্রায় তিন মাস ধরে করোনার ভয়ে ছেলেমেয়েদের বের হতে দেই না। ঘরে বসে ছবি আঁকা, গল্পের বই পড়া, গান, নাচ অনুশীলন করে দিন কাটছিল ওদের। কিন্তু সারা দিন শুয়ে বসে থেকে শিশুরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। তাই খেলাধুলার জন্য ছাদে পাঠিয়ে দেই। আমার দুই ছেলে-মেয়ে আর ভাইয়ের দুই ছেলে মিলে বিকালে ছাদে ক্রিকেট খেলে। সাব্বির রহমানের মুঠোফোনেই কথা হয় তার সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলে ফাহিম বিন সাব্বিরের সঙ্গে। সময় কীভাবে কাটছে জানতে চাইলে সে জানায়, দুপুর পর্যন্ত অনলাইনে বিভিন্ন ক্লাস করি। এরপর বিকালের সময়টুকু ছাদে ক্রিকেট খেলি। আগে মাঠে নিয়মিত খেলতে যেতাম। কিন্তু এখন করোনাভাইরাসের কারণে মাঠে যাওয়া বন্ধ। ছাদে নেট লাগিয়ে ভাই-বোন মিলে ক্রিকেট খেলি। মাঝে মাঝে দাবা, লুডুও খেলি আমরা। মাঠের মতো মজা তো হয় না। তবু বাসায় বসে থাকার চেয়ে এই ভালো। আমাদের দেখাদেখি এখন আশপাশের অনেক বাসার ছেলেমেয়েরা নিজেদের ছাদে খেলাধুলা করে।

আজিমপুর এলাকায় মাঝরাতে আকাশে ভাসতে দেখা যায় আলোকোজ্জ্বল একটা ঘুড়ি। ঘুড়ি তো অনেক দেখা যায় কিন্তু তাতে ছোট্ট হলুদ আলো লাগানোয় মনে হয় যেন এক ঝাঁক জোনাকি উড়ছে। ঘুড়ি কে ওড়ায় খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া যায় আজিমপুরের বাসিন্দা হাবিব রিজভীকে। ঘুড়ি কোথায় ওড়ান জানতে চাইলে হাবিব বলেন, আমাদের বাসার আশপাশে তেমন উঁচু দালান না থাকায় ছাদে দারুণ বাতাস লাগে। আমি ছোটবেলা থেকেই ছাদে ঘুড়ি ওড়াই। করোনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই হালকা পড়াশোনার ফাঁকে বাহারি ঘুড়ি বানিয়েই আমার সময় কাটে। ঘুড়িতে আলোর ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা কীভাবে আসল জানতে চাইলে বলেন, রাতে ঘুড়ি ওড়ালে অন্ধকারে বুঝতে পারতাম না কোনদিক যাচ্ছে। ঝড়ো বাতাসে অনেক ঘুড়ি ছিঁড়ে চলেও গেছে। তাই ভাবলাম ব্যাটারির সাহায্যে আলোর ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? ঘুড়ি তৈরি করে রাতে উড়িয়ে দেখলাম দারুণ দেখাচ্ছে। সবাই দেখে বেশ প্রশংসাও করছে। 

মধুমাস শুরু হতেই নিজের ছাদ বাগানের আমের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়াবিদ এবং উদ্যোক্তা শিরিন সুলতানা। ছাদে আমের পাশাপাশি লিচু, মাল্টা, লেবু গাছ লাগিয়েছেন তিনি। আছে ঢেঁড়সসহ কিছু সবজিও। তিনি বলেন, এই গাছগুলো আমার সন্তানের মতো। করোনার সময়ে ছাদে গাছের পরিচর্যা, ব্যায়াম করে আমার সময় কাটে। ছাদে সবুজ গাছের সান্নিধ্য আর খোলা হাওয়া এই দুঃসময়ে মন ভালো করার মহৌষধ। 

আষাঢ়ের আকাশ মানে এই রোদ এই বৃষ্টি। কার্নিশ চুইয়ে পড়া জলে মন না ভিজলে বৃষ্টি অনুভবের প্রিয় জায়গা ছাদ। করোনার চোখ রাঙ্গানিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অনেকেই ছাদে পাখির মতো ডানা মেলে জাপটে ধরেন বৃষ্টিকণাকে। মহামারীর জীবাণুকে ধুয়ে মুছে ধরাকে শুচি করতে এ যেন বৃষ্টিকে দুই হাত তুলে সম্ভাষণ জানানো। ছাদে অলকানন্দা ফুল গুঁজে বৃষ্টি ভেজার মুহূর্তের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছেন আনিকা রহমান। তিনি বলেন, বৃষ্টিতে ভিজতে আমি ভীষণ পছন্দ করি। স্কুল-কলেজ থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি নামলে আমি ভিজেই বাড়ি ফিরতাম। করোনায় বাইরে যাওয়া বন্ধ। এ বছর কদম ফুলও হাতে ওঠেনি। তাই কদম ফুল আঁকানো শাড়ি পরে ছাদেই বৃষ্টিতে ভিজলাম। প্রিয় ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দিয়েছি। করোনাকালে ছাদেই আমাদের পরিবারের বেশিরভাগ সময় কাটে।

সর্বশেষ খবর