মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

মুটিয়ে যাচ্ছে ঘরবন্দী শিশু

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মুটিয়ে যাচ্ছে ঘরবন্দী শিশু

স্কুল ছুটির অখ- অবসর, খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ম আর শারীরিক পরিশ্রমের অভাব শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে স্থূলতার দিকে ছবি : মানিক মুনতাসির

‘আমার যেতে ইচ্ছে করে, নদীটির ওই পারে/যেথায় ধারে ধারে, বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকো, বাঁধা সারে সারে’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মাঝি’ কবিতা আবৃত্তির চেষ্টা করছে ছয় বছরের রাইয়ান সামির। তার মা সাজিদা আক্তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাইয়ানের এই আবৃত্তির ভিডিও দিয়েছেন। করোনায় প্রায় তিন মাস ধরে ঘরবন্দী থেকে আবৃত্তি, অঙ্কন আর অনলাইনে অল্পবিস্তর পড়াশোনায় দিন কাটছে রাইয়ানের। খেলাধুলা, স্কুল না থাকায় ঘরে বসে ছেলের ওজন বেড়ে যাচ্ছে, বলছিলেন সাজিদা আক্তার।

গত ১৬ মার্চ করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ঘরে থাকা সর্বোত্তম উপায়। শিশুদের নিরাপত্তায় তাই পরিবারও তাদের ঘরে রাখার চেষ্টা করছে। দীর্ঘদিন স্কুল, মাঠের বাইরে, ঘরের চার দেয়ালে কাটছে শিশুদের বন্দী জীবন। করোনা প্রতিহত করতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। শিশুরা পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হওয়ায় তাদের সুরক্ষিত রাখতে ঘরে বিভিন্ন ধরনের খেলা, কম্পিউটার গেমসে ব্যস্ত রাখছে বাবা-মা। কিন্তু এভাবে ঘরবন্দী থাকতে থাকতে শিশুরা শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিকভাবেও অনেক সময় অবসাদে ভুগছে। ঘরে বসে খাওয়া, ঘুম আর মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। ঘরে থাকার কারণে বাইরের খাবার খাওয়ার সুযোগ না থাকলেও ঘরে বসেও তাদের নানা খাবারের আবদার মেটাতে গিয়ে বাড়ছে ওজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ম আর শারীরিক পরিশ্রমের অভাব শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে স্থূলতার দিকে। লকডাউনে বাইরের কাজ না থাকায় ঘুম, খাওয়ার সময়েও অনিয়ম দেখা দিয়েছে সব বয়সের মানুষেরই, যা স্থূলতার ঝুঁকি আরও বাড়াচ্ছে বলে জানা গেছে গবেষণায়। ‘শৈশবে ওজন বৃদ্ধির কারণে কুপ্রভাব পড়তে পারে পরিণত বয়সে’ শিরোনামে এই গবেষণার সহ-লেখক, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অ্যাট বাফেলো’র মাইলস ফেইথ। তিনি বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারীর ক্ষতিকর প্রভাব শুধু ভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। লকডাউনের কারণে শিশু, কিশোর সবাই স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস অনুসরণের ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার। সাধারণত স্কুলের গরমের ছুটিতে শিশু, কিশোরদের ওজন বাড়তে দেখা যায়। এ থেকেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, এই লম্বা সময় ঘরে আটকে থাকায় তাদের স্বাস্থ্যগত অবস্থা কি হতে যাচ্ছে?’ এই গবেষণার জন্য খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রম আর ঘুম সম্পর্কিত তিন সপ্তাহের তথ্য সংগ্রহ করা হয় ইতালির বাধ্যতামূলক দেশব্যাপী লকডাউনের সময়। আর তার তুলনা করা হয় ২০১৯ সালে নেওয়া তথ্যের সঙ্গে। বৈদ্যুতিক পর্দার সামনে সময় কাটানোর মাত্রা, মাংস, স্ন্যাকস, ফল এবং সবজি খাওয়ার মাত্রা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় এই গবেষণায়। ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব প্রমাণিত হয়। দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গৎবাঁধা রুটিনের মাঝেও যে শিশুরা ইতিমধ্যেই স্থূলতায় ভুগছিল তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার সমস্যাগুলো স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এক বছর আগে স্বাভাবিক সময়ে শিশুদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে সংগ্রহ করা তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, লকডাউনে শিশুরা বাড়তি একবেলা খাবার খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে প্রতিদিন আধাঘণ্টা বেশি। আর বৈদ্যুতিক পর্দার সামনে সময় কাটানোর পরিমাণ বেড়েছে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ ঘণ্টা। সেই সঙ্গে মাংস, চিনিযুক্ত পানীয় আর তেলেভাজা খাবার খাওয়ার পরিমাণও বেড়েছে মারাত্মক হারে। অপরদিকে শরীরচর্চা কমেছে সপ্তাহে দুই ঘণ্টা। তবে সবজি খাওয়া পরিমাণে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। ফেইথ বলেন, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ঘরে থাকতে গিয়ে এই ক্ষতিকর দিকটা নিয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। ঘরে আবদ্ধ থাকাকালে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা ওজন লাগামছাড়া হয়ে যাওয়ার হতাশা মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। আর এই হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি তাদের আরও আসক্ত করে তুলতে পারে। পরিণত বয়সে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিও বাড়াবে এই বাড়তি ওজন। কারণ শৈশব ও কৈশোরের স্থূলতা পুরো জীবনের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে আনে।’ ওজন বাড়ার পাশাপাশি ঘরে থাকতে থাকতে শিশুদের মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরির আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্ক ও উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। কেননা বেশিদিন হতাশার মধ্যে থাকলে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাসহ অসহিষ্ণু আচরণ বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় শিশু-কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দুটি গাইড লাইন তৈরি করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর