মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রযুক্তিজালে বন্দী নাগরিক জীবন

জয়শ্রী ভাদুড়ী

প্রযুক্তিজালে বন্দী নাগরিক জীবন

করোনাকালে সামাজিকতা কমে গিয়ে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার। প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে নগরবাসী ছবি : রোহেত রাজীব

করোনাভাইরাস মহামারীর ছোবলে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছে মানুষ। এ সময় প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিনোদনে ঝুঁকছে মানুষ। শিশু, তরুণ, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ ঝুঁকছেন সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, টেলিভিশনের দিকে। নিজেদের সময় দেওয়ার বদলে মোবাইল, ল্যাপটপের স্ক্রিনে বেশি সময় দিচ্ছেন। প্রযুক্তির জালে বন্দী হয়ে পড়েছে নাগরিক জীবন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চার মাস ধরে ঘরবন্দী শিশুরা। মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, আড্ডা, গল্পও বারণ। শহরে স্বল্প জায়গার বাসায় দিনের পর দিন শিশুদের ঘরে আটকে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। তাই শিশুদের বিনোদন দিতে সহজমাধ্যম হিসেবে বসিয়ে দিচ্ছেন টেলিভিশনের সামনে। কার্টুন দেখতে দেখতে খাওয়া-ঘুম সবই চলে। টেলিভিশনে কার্টুন পছন্দ না হলে মোবাইলে ইউটিউবে চোখের সামনে চলে ভার্চুয়াল জগতের দৌড়ঝাঁপ। ভার্চুয়াল জগতের গতিকেই বাস্তব মনে করে শিশুরা। অনলাইনে ক্লাস চলায় শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে চলে এসেছে মুঠোফোন। পড়াশোনার থেকে বেশি চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউবে সময় কাটানো। যে ছেলেমেয়েরা সকালবেলা নাশতা করে হুড়মুড় করে দৌড় দিত স্কুল-কলেজে। তাদের এখন কার্যত কোনো রুটিন নেই। সারাদিন তারা একটা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে দুটি জাগরিত চোখকে সারাক্ষণ নিবদ্ধ রাখে মোবাইল স্ক্রিন, ল্যাপটপ কিংবা টিভির পর্দায়। বই পড়াতেও নেই আগ্রহ।

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুল সিদ্দিকি বলেন, গ্রামের খোলা জায়গায় শিশুরা তবু হেসে-খেলে কিছুটা সময় কাটাতে পারে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। রাজধানীর এই দুই রুমের বাসায় ঠিকমতো আলো-বাতাস ঢুকে না। দিনের পর দিন ছেলেমেয়েদের কীভাবে আটকে রাখি। ছাদে যাওয়ার অনুমতিও নেই। কিছুদিন ওদের বই পড়তে উৎসাহিত করেছিলাম। কিন্তু অনলাইনে ক্লাস চালু হওয়ার পর বাধ্য হয়েই ফোন হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। শুধু শিশুরা নয়, সববয়সী মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা। 

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশাল’ এবং কানাডাভিত্তিক ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান হুটস্যুইট ‘সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির ব্যবহার’ শীর্ষক জরিপ পরিচালনা করেছে। বৈশ্বিক এই জরিপে উঠে এসেছে পৃথিবীর যেসব শহরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ঢাকা হচ্ছে দ্বিতীয়। এখানে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারী আছেন ব্যাংকক শহরে, ৩ কোটি। তৃতীয় স্থানে আছে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা। এই হিসাব এ বছরের এপ্রিল মাসের।

এ বছর জানুয়ারি মাসেও ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়। তখনো প্রথমে ছিল ব্যাংকক। সেখানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৪০ লাখ। দ্বিতীয় স্থানে ছিল মেক্সিকো সিটি, ১ কোটি ৯০ লাখ। আর তৃতীয় স্থানে ছিল ঢাকা, ১ কোটি ৬০ লাখ।

দেশের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মোট ২১ কোটি ৪০ লাখ। দ্বিতীয় স্থানে ভারত, ১৯ কোটি ১০ লাখ। এই জরিপ অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটছে চীনে। সেখানে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি, প্রবৃদ্ধির হার ২১ ভাগ। দ্বিতীয় স্থানে ভারত, সেখানে সাড়ে ৫ কোটি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী, প্রবৃদ্ধির হার ৪০ শতাংশ। আট নম্বরে আছে বাংলাদেশ। একই জরিপে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জনসংখ্যার ইন্টারনেট ব্যবহারের ৭৮ শতাংশই মোবাইল সংযোগনির্ভর। পৃথিবীতে প্রায় ২৭০ কোটির বেশি লোক সক্রিয়ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি লোক এখন একটি শক্তিশালী মোবাইল ফোন সঙ্গে নিয়ে চলে। এই জরিপটিতে যে চিত্র উঠে এসেছে তা সব বয়সের মানুষের, শুধু অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের নয়।

অনেকক্ষণ ধরে স্ক্রিনে থাকার কারণে সবার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে থাকে এবং কথা বলতে ভালো লাগে না। চোখ টনটন করতে থাকে, ঘাড় ব্যথা করে, হাত অবশ হয়ে যায় মাঝে মাঝে। এতে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কিন্তু কম নয়। ২০১৪ সালে অস্ট্রিয়ার একদল গবেষক কয়েক হাজার নারী-পুরুষের ওপর গবেষণা চালান। এদের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে না, অন্য অংশ বিশেষভাবে এর প্রতি আসক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ব্যবহার করেন না তাদের চেয়ে যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়মিত ব্যবহার করেন তাদের মেজাজ বেশি খিটখিটে এবং অস্থির মনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিরিনা রহমান বলেন, অনেক সময় চিন্তা করি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাব না।

কিন্তু একবার চালাতে শুরু করলে আর বের হতে পারি না। বাবা ল্যাপটপে অফিসের কাজ করেন, মা আর ভাই নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখেন। খাওয়ার টেবিল ছাড়া আমাদের কথাই হয় না। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা অসামাজিক হয়ে পড়ছি। সব বুঝতে পারি তবুও এই আসক্তি থেকে বের হতে পারছি না। 

এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ডা. এম মোহিত কামাল বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য তরুণকে আমরা চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউবসহ অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। তারা ভার্চুয়াল দুনিয়ার মতো বাস্তবেও সবকিছু ওভাবেই পেতে চায়। এতেই বাধে বিপত্তি। এখন সববয়সী মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের আসক্তি বেড়েছে। মাদকের চেয়ে কোনো অংশে এই আসক্তি কম নয়। ঘুম কমিয়ে মনকে অসুস্থ করে দিচ্ছে অত্যধিক প্রযুক্তির ব্যবহার। 

 

সর্বশেষ খবর