মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

উপেক্ষায় ভুলে যাই স্মরণীয় নাম

ব্যবহার না হওয়ায় সম্মান দিয়ে সড়কের নামকরণ করলেও চেনে না কেউ। নগর কর্তৃপক্ষ ও সড়ক ব্যবহারকারীদের উপেক্ষার আড়ালে সেই স্মরণীয়-বরণীয় মানুষের নামে করা সড়কগুলোর নাম ভুলে যেতে বসেছে নগরবাসী

জয়শ্রী ভাদুড়ী

উপেক্ষায় ভুলে যাই স্মরণীয় নাম

রাজধানীতে বিভিন্ন সড়কের নামফলকগুলো অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উপেক্ষায় হারিয়ে যাচ্ছে নামকরণের যৌক্তিকতা ছবি : রোহেত রাজীব

ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কটি ভাষাসৈনিক ডাক্তার গোলাম মাওলার নামে নামকরণ করা হয়। এখন বিজ্ঞাপনে ঢেকে গেছে নামফলকের ম্যুরাল। চায়ের দোকানের পাউরুটি, কলা ঝুলিয়ে রাখা হয় ম্যুরালের সঙ্গে। ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের ম্যুরালে শ্বেতপাথরে লেখা কালো রঙের অক্ষরগুলো মুছে গেছে। চারপাশে আবর্জনার স্তূপ। এই সড়কের নামের বদলে আশপাশের বাড়ির ঠিকানা কিংবা দোকানের সাইনবোর্ডে ব্যবহার হয় পুরনো নাম। আরেক ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের জীবদ্দশাতেই তার নামে করা সড়কের নামফলক ভেঙে কাত হয়ে পড়ে আছে। জাতীয় চার নেতার একজন এম মনসুর আলীর নামফলকও ধুলোবালিতে আকীর্ণ। পাঠোদ্ধার করা কঠিন। ব্যবহার না হওয়ায় সম্মান দিয়ে সড়কের নামকরণ করলেও চেনে না কেউ। নগর কর্তৃপক্ষ ও সড়ক ব্যবহারকারীদের উপেক্ষার আড়ালে সেই স্মরণীয়-বরণীয় মানুষের নামে করা সড়কগুলোর নাম ভুলে যেতে বসেছে নগরবাসী।

নগর বিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, সড়কের নামকরণ ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। কিন্তু এসব রোডের নাম এলাকার বাড়ির ঠিকানা, দোকানের সাইনবোর্ডে কিংবা মানুষের মুখে শোনা যায় না। অবহেলায়, অযতেœ অনেক সড়কের নামফলক ভেঙে গেছে, নাম মুছে গেছে। রোডের নাম বাড়ি, দোকানের ঠিকানায় লেখা বাধ্যতামূলক করা উচিত। শ্রদ্ধা, আন্তরিকতার সঙ্গে ওরকম মহৎ হৃদয় মানুষের নাম ব্যবহার করা উচিত। 

জানা যায়, তৎকালীন অভিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা ও খ্যাতিমান রাজনীতিকদের নামে সড়কের নামকরণের উদ্যোগ নেন। বেশ কয়েকটি সড়কের নাম পরিবর্তন করেন তিনি। এরপর ধানমন্ডির ‘ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর’-এর পক্ষ থেকে ভাষাসংগ্রামীদের নামে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের নামকরণের দাবি জানানো হয় মেয়রের কাছে। এরপর ২০০৬ সালে ভাষাসংগ্রামীদের নামে রাজধানীর সড়কের নামকরণ করা হয়।

২০০৬ সালের ৭ ডিসেম্বর ধানমন্ডির ১০ নম্বর সড়ক কাজী গোলাম মাহবুবের নামে নামকরণের মাধ্যমে ভাষাসংগ্রামীদের নামে সড়কের নামকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০৭ সালে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাসে সাত ভাষাসংগ্রামীর নামে সাতটি সড়কের নামকরণ হয়। তবে যে সড়ক যার নামে উদ্বোধন করা হয় সেই ব্যক্তিত্ব কিংবা তার নিকটাত্মীয়কে সেই অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা হয়। আবদুল মতিন, গাজীউল হক ও অলি আহাদ নিজের নামে সড়কের নামকরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার বিরল সম্মান পেয়েছিলেন।

এর মধ্যে অলি আহাদের নামে ধানমন্ডির ৪ নম্বর সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। অন্যান্য সড়কের মধ্যে ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়ককে ‘ভাষাসৈনিক ডা. গোলাম মাওলা সড়ক’, ৩ নম্বর সড়ককে ‘ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান সড়ক’, ৫ নম্বরকে ভাষাসৈনিক ‘আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ সড়ক’, ৬ নম্বরকে ‘ভাষাসৈনিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন সড়ক’, ১৫ নম্বর সড়ককে ‘ভাষাসৈনিক বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী সড়ক’, ১২ নম্বর সড়ককে ‘ভাষাসৈনিক ড. সুফিয়া আহমদ সড়ক’, ১৩ নম্বরকে ‘ভাষাসৈনিক ড. শাফিয়া খাতুন সড়ক’, ৫ এ সড়ককে ‘ভাষাসৈনিক কামরুদ্দীন আহমদ সড়ক’, ৪ এ ‘ভাষাসৈনিক শওকত আলী সড়ক’ এবং ৯ এ সড়ককে ‘ভাষাসৈনিক তোয়াহা সড়ক’ করা হয়েছে। নিউ ইস্কাটন (গাউসনগর) সড়ককে ‘ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক সড়ক’ করা হয়েছে। আহমদ রফিক সড়কের নামফলক ভেঙে পড়ে রয়েছে রাস্তার কোনায়। আশপাশের বাড়ির ঠিকানায় ব্যবহার হয় না ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক সড়কের নাম। ধানমন্ডির রিকশাচালক আলী হোসেন বলেন, সড়কের এই নাম তো শুনিনি। সবাই রোড নম্বর বলে এজন্য রোড নম্বরেই এই এলাকা চিনি। প্রতিটা রোডে ফলক থাকলে আর বাড়ির ঠিকানায় সড়কের নাম ব্যবহার করলে আমরাও সেই নামেই ডাকব।’

মিরপুর টেকনিক্যাল কলেজের মোড় থেকে মিরপুর-১ নম্বর চত্বর পর্যন্ত সড়কের নামকরণ হয়েছে ‘প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম সড়ক’। রাজনীতিবিদ ও লেখক আবুল মনসুর আহমদের নামে নামকরণ করা হয়েছে ধানমন্ডি ১২ এ সড়ক। রাজনীতিবিদ আবদুস সামাদ আজাদের নামে নামকরণ হয়েছে ধানমন্ডি ১৩ এ সড়কের। লেখক-সাংবাদিক ‘এম আর আখতার মুকুল সড়ক’ করা হয়েছে ধানমন্ডি ৭ সড়ককে। রাজনীতিবিদ ‘মির্জা গোলাম হাফিজ সড়ক’ করা হয়েছে ধানমন্ডি ৮ এ সড়ককে। রাজনীতিবিদ ‘মহিউদ্দীন আহমেদ সড়ক’ করা হয়েছে ধানমন্ডি পুরনো ৩৩ নম্বর সড়ককে। সেন্ট্রাল রোডের নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী সড়ক’। ‘কাজী মোতাহার হোসেন সড়ক’ নামকরণ হয়েছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি সংযোগস্থল থেকে শিল্পকলা একাডেমি হয়ে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণি পর্যন্ত সংযোগ সড়ক। ‘জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সড়ক’ নামকরণ হয়েছে দোয়েল চত্বর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের মোড় হয়ে বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত সড়ক। কিন্তু এখনো রাজধানীতে অসংখ্য এলাকা সেক্টর, রোড নামে চিহ্নিত হয়েছে। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে নামকরণের পরিকল্পনা থাকলেও তেমন সাড়া নেই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। যে সড়কের নামকরণ করে ম্যুরাল করা হয়েছে তারও রক্ষণাবেক্ষণ নেই। ভাষাসৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের ম্যুরালের চারদিক ঘিরে গড়ে উঠেছে নার্সারি। অনেক নামফলক ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এসব সংস্কারেও নেই কোনো উদ্যোগ।

সর্বশেষ খবর