শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মাথার ওপর বিপদ তবু মাথাব্যথা নেই

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মাথার ওপর বিপদ তবু মাথাব্যথা নেই

এভাবেই নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলে নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজ ছবি : রোহেত রাজীব

রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় নির্মাণাধীন সাততলা ভবনে বাঁশের মইয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করার সময় ওপর থেকে নিচে পড়ে যান নির্মাণশ্রমিক মোহাম্মদ মঞ্জু (২৫)। গত ২ নভেম্বর কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করতে গিয়ে ওই নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু হয়। ভবনে কাজ চলাকালীন শুধু শ্রমিকদের নয় পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিধান থাকলেও তার কোনো তোয়াক্কা নেই। ওপর থেকে ইট, রড পড়ে মারা যাচ্ছেন নির্মাণাধীন ভবনের নিচ দিয়ে যাতায়াতকারী পথচারী।

গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের প্রেমতলায় নির্মাণাধীন একটি ভবনের পাঁচতলা থেকে ৩৭ কেজি ওজনের লোহার রড পড়ে নাহার বেগম (৩৯) নামে এক নারী মারা গেছেন। এ ঘটনায় নিহতের স্বামী বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করেছেন।

নিহতের স্বামী পল্টু জানান, আমার স্ত্রী বাসার পাশে একটি নারিকেল গাছের নিচে বসেছিলেন। হঠাৎ পাশের নির্মাণাধীন পাঁচতলা ভবন থেকে ৩৭ কেজি ওজনের একটি লোহার রড আমার স্ত্রীর মাথায় পড়ে। রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই দীর্ঘদিন ধরে তারা কাজ করছেন। এ জন্য আমার স্ত্রীকে প্রাণ দিতে হলো। আমি আমার স্ত্রীর মৃত্যুর বিচার চাই। যাতে কেউ বাড়ি বানাতে গেলে প্রথমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, দেশের নির্মাণ খাতে গত বছর ১৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। বিলসের পরিসংখ্যান বলছে, পরিবহন খাতের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এ খাতে। গত বছর আহত হয়েছেন ১১৭ জন নির্মাণশ্রমিক। ২০১৮ সালে মারা গেছেন ১০০’র বেশি শ্রমিক। ২০১৭ সালে নির্মাণাধীন ভবনে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৩৪ জন। ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৩৭৭ জন নির্মাণশ্রমিক। এ মৃত্যুর বাইরে শ্রমিকদের পঙ্গু হওয়ার পরিসংখ্যানও বেশ উদ্বেগজনক। আহত হয়েছেন ৫২৫ জন শ্রমিক। এ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব এবং শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এ আইনের দুর্বলতার কারণে এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণও পান না ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের সদস্যরা। শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়োগকারীর। শ্রমিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া নিয়োগকারী কাউকে কাজে নিয়োগ করতে পারবেন না।

আইনে এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাজধানীর একাধিক নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করে দেখা গেছে হেলমেট, গামবুট, নিরাপত্তা বেল্টসহ নিরাপত্তা উপকরণ ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিকরা

আইনে এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাজধানীর একাধিক নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করে দেখা গেছে হেলমেট, গামবুট, নিরাপত্তা বেল্টসহ নিরাপত্তা উপকরণ ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিকরা। খিলক্ষেতে পাঁচতলা ভবনে চলছে নির্মাণকাজ। সাইফুল অ্যান্ড সোহেল ট্রেডার্সের ব্যানার লাগানো নিচে। ছাদ ঢালাইয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই এক কোনায় ঢালাইয়ের সামগ্রী নিচ থেকে তুলে রাখা হচ্ছে। মাত্র একজন শ্রমিকের পায়ে গামবুট। তাও তার নিজের টাকায় কেনা। নিরাপত্তা ছাড়া কেন কাজ করছেন জিজ্ঞাসা করলে কর্মরত শ্রমিক সিরাজুল ইসলাম ও হাজেরা খাতুন বলেন, ‘পেটের দায়ে কাজ করছি। দিন শেষে মজুরি পেলে তাই দিয়ে সংসার চলবে। নিরাপত্তার সামগ্রী চাইলে আমাদের কাজে নেবে না।’

এ সম্পর্কে ইমারত নির্মাণশ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রম আইনে মালিক, শ্রমিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘ত্রিপক্ষীয় কমিটি’ গঠন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই কমিটি গঠিত হয়নি। ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্রমিক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা মালিকপক্ষকে চাপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইনসাবের তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক। ২০০৮ সালে কাকরাইলের আইরিশ নুরজাহান টাওয়ারে সংঘটিত দুর্ঘটনায় চার শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় হাই কোর্টের নির্দেশে প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে ৮ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু এরকম প্রতি বছর শত শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটলেও নিরাপত্তা কিংবা ক্ষতিপূরণ কোনোটাই নিশ্চিত করছে না মালিকপক্ষ। শুধু শ্রমিকই নয়, নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া কাজ করায় ওপর থেকে ইট, রড পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন পথচারীও। ২০১১ সালের ১৬ জুলাই অসুস্থ মাকে হাসপাতালে দেখে ফেরার পথে পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালের সামনে একটি নির্মাণাধীন ১৮ তলা ভবন থেকে ইট পড়ে মারা যান তেজগাঁও কলেজের ছাত্র হাবিবুর রহমান। এ ঘটনার পর হাই কোর্ট বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রিট জারি করে। পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছিল নির্মাণপ্রতিষ্ঠানকে। দেশে ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ প্রচলিত আছে। এ ছাড়া ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। এই আইন ও বিধিমালা অনুসারে ভবন নির্মাণে পথচারীদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অহরহ ভবন নির্মাণ হচ্ছে এসব নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই।

 

সর্বশেষ খবর