মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

উন্নয়ন উৎসবে ফুটপাথ উধাও

জয়শ্রী ভাদুড়ী

উন্নয়ন উৎসবে ফুটপাথ উধাও

মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাথ রাস্তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোপখানায় সচিবালয়সংলগ্ন ফুটপাথটি ভেঙে ফেলার ঝুঁকি নিয়ে চলছে পথচারী ছবি : শিমুল মাহমুদ

রাজধানীর ব্যস্ত এলাকার মধ্যে অন্যতম শাহবাগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম হাসপাতালে সবসবময়ই থাকে রোগী ও স্বজনদের ভিড়। এর মধ্যে ওই সড়কে চলছে মেট্রোরেলের কাজ। এ জন্য উধাও হয়ে গেছে ফুটওভারব্রিজ ও ফুটপাথ। ফুটপাথ না থাকায় যানবাহনের ভিড়ে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত এবং একপাশ থেকে আরেক পাশে যেতে ঝক্কির অন্ত থাকে না রোগী ও স্বজনদের। মাঝে মাঝে রাস্তার কাছে পানি জমে থাকলে বিপদ আরও ঘনিয়ে আসে। লাফিয়ে ডিঙিয়ে পার হতে হয় মানুষকে। অনেক জায়গায় পিচ উঠে বড় বড় গর্তও তৈরি হয়েছে। গর্তে পড়ে দুর্ঘটনাও ঘটেছে।

এ রকম দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন সায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাস দুয়েক আগে করোনাভাইরাস টেস্ট করার জন্য বেতার ভবনে গিয়েছিলাম। বৃষ্টি হওয়ায় প্রায় হাঁটুপানি জমে ছিল বারডেম হাসপাতালের সামনে। বেতার ভবন থেকে বেরিয়ে পানির মধ্য দিয়ে হেঁটে শাহবাগ মোড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে দ্রুত গতিতে এসে একটি গাড়ি হর্ন দিলে লাফ দিয়ে সরতে গিয়ে গর্তে পড়ে যাই। পায়ে ভীষণ ব্যথা পাই। পরে চিকিৎসকের কাছে গেলে জানতে পারি পায়ের লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফুটপাথ থাকলে আমরা নির্বিঘ্নে হাঁটতে পারতাম। এ পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

উন্নয়ন কাজ করতে গিয়ে এবং অবহেলায় রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ফুটপাথ উধাও হয়ে গিয়েছে। পথচারীর নিরাপদে হাঁটার রাস্তাটুকুও নেই। কোথাও কোথাও একটু পর পরই ফুটপাথে ভাঙা, ড্রেনের ঢাকনা খোলা থাকে। একবার ফুটপাথের ওপরে একবার নিচে নেমে যেতে হয়। ঝকঝকে ফুটপাথ কিছু জায়গায় থাকলেও অধিকাংশই হকারদের দখলে। ফাঁকা ফুটপাথে মোটরসাইকেল চালকদের উৎপাতও পোহাতে হয় পথচারীদের।   

ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকা বলে পরিচিত তেজগাঁও শিল্পএলাকা। লিংক রোড পার হয়ে নাবিস্কো মোড় দিয়ে সাতরাস্তার মোড় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারের মতো রাস্তা হবে। এই রাস্তাটুকু একজন সুস্থ মানুষের পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগার কথা সর্বোচ্চ ২০ মিনিট। কিন্তু এই রাস্তা পার হতে সময় লাগে ৪৫ মিনিটের বেশি। তেজগাঁওয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রাহেলা ইয়াসমিন বলেন, ফুটপাথ দিয়ে নির্বিঘ্নে হেঁটে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। এটুকু রাস্তার মধ্যে কয়েকবার ভাঙা-এবড়ো খেবড়ো ফুটপাথ। একবার ফুটপাথে উঠতে হয় আরেকবার নামতে হয়। মাঝে মাঝে নোংরার ঢিপি। মানুষ প্রস্রাব করে রাখে ফুটপাথ ঘেঁষা দেয়ালে। দুর্গন্ধের কারণে নাকে রুমাল চেপে যেতে হয়। কিছু কিছু জায়গায় সে পরিস্থিতিও নেই। ফুটপাথ ছেড়ে অন্য পাশ দিয়ে যেতে হয়।

নগরীতে অধিকাংশ জায়গায় চলছে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ। এর মধ্যে মেট্রোরেল মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে রাজধানীর অনেক এলাকা ঘিরে। পল্টন এলাকায় চার ভাগে ভাগ হয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ। মেট্রোরেল প্রকল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে রাস্তার মাঝে ঘিরে চলছে কাজ। এ জন্য দুই পাশে রাস্তা একলেনে নেমে এসেছে। গাড়ির চাপ থাকে দিনভর। পল্টন থেকে প্রেস ক্লাবে আসার পথে দেখা যায় একপাশে ফুটপাথ পুরো উধাও হয়ে গেছে। দেয়াল ঘেঁষে যানবাহন চলে। যানবাহনের পাশ দিয়ে যাতায়াত করতে হয় পথচারীদের। এর মধ্যেও কিছু জায়গায় ময়লা ফেলে রাখা হয়েছে। সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁষে ময়লার স্তূপ। কিছু জায়গায় প্রস্রাব করে নোংরা করে রাখা হয়েছে। নাকে রুমাল চেপে যাওয়ার পরিস্থিতিও নেই। বাসের চাপ কমলে দৌড়ে যাতায়াত করেন মানুষ। সিগন্যালে বাস আটকালে রাস্তা পারাপারে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।

সরকারি কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, সকাল ১০টায় অফিস ধরতে প্রায় দুই ঘণ্টা যানজটে কাটত। এ ভোগান্তি কমাতে পল্টন এলাকায় বেশি ভাড়ায় বাসা নিয়েছিলাম। হেঁটে আসতে ১৫ মিনিট সময় লাগত। কিন্তু এখন হেঁটে আসার রাস্তাই নেই। সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁষে ডানপাশে ফুটপাথ নেই। দেয়ালের সঙ্গে লেপটে পার হতে হয় ওই আধা কিলোমিটার রাস্তা। তার মধ্যে বাস চেপে আসলে এখনই দেয়ালের সঙ্গে পিষে ফেলবে। দুর্গন্ধে শরীর গুলিয়ে বমি আসে। আরেক পাশে যৎসামান্য ফুটপাথ থাকলেও হকারদের দখলে।

মেট্রোরেলের কাজে সরিয়ে ফেলা হয়েছে প্রেস ক্লাবের সামনের ফুটওভার ব্রিজ। ওপার থেকে এপারে আসতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ১৫ মিনিট।

নগরবিশ্লেষক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মডেল শহরে মানুষের নিরাপদে হাঁটার ফুটপাথ থাকবে। পরিচ্ছন্ন ফুটপাথ থাকলে মানুষ কাছের দূরত্ব হেঁটেই অনায়াসে পাড়ি দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এ রীতি নেই। অধিকাংশ ফুটপাথের পরিস্থিতি খারাপ। উন্নয়ন করলে সেগুলোও চলে যায় হকারদের দখলে। ফুটপাথ দিয়ে চলে মোটরসাইকেল। তাহলে মানুষ হাঁটবে কোথায়? ফুটপাথ পরিচ্ছন্ন হলে যানবাহনের ওপরেও চাপ কমে। নগরবাসীর স্বাস্থ্যের ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 

সর্বশেষ খবর