মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাকার গণপরিবহন দৃষ্টিপীড়ক

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঢাকার গণপরিবহন দৃষ্টিপীড়ক

নগরীর রাজপথে যাত্রীবাহী বাসের রেষারেষি নিত্যদিনের ঘটনা। রংচটা চলমান বাসের দৃশ্যদূষণ নিয়ে ভুগছে নগরবাসী। গুলশানে চলাচলকারী বাসগুলো উজ্জ্বল ব্যতিক্রম (ডানে) ছবি : শিমুল মাহমুদ

মতিঝিল ও গুলিস্তান থেকে মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা হয়ে উত্তরা রুটে চলাচল করে তুরাগ পরিবহন। রামপুরা ব্রিজে যাত্রী তোলার জন্য দাঁড়ানো তুরাগ পরিবহনের বাসে দেখা যায় এর পেছনের অংশে কোনো বাতি নেই। বাসের রং কোথাও উঠে গেছে, কোথাও মরচে ধরা, অসংখ্য ফুটো। বাসের বিভিন্ন জায়গায় এলোমেলোভাবে লাগানো ছেঁড়াফাটা পোস্টার।

রাজধানীজুড়ে চলছে ভাঙাচোরা, লক্কড়ঝক্কড় গণপরিবহন। কোনোটির রং চটা, কোনোটির ছাল ওঠা। কোনোটির জানালার গ্লাস ভাঙা, কোনোটার আবার দরজাই নেই। এরকম দৃশ্যদূষণে বছরের পর বছর চলছে রাজধানীর গণপরিবহন। কিছু বাসের আসনেরও করুণ অবস্থা। বাসের ভাঙা সিটে অনেক সময় যাত্রীদের জামাকাপড় ছিঁড়ে গিয়ে লজ্জাকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেক বাসের ভিতরে প্রস্রাবের দুর্গন্ধ, সিটে বাসা বেঁধেছে ছাড়পোকা। ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ এসব যানবাহনে চলাচল যেমন বিপজ্জনক তেমনি নগরীর সৌন্দর্যহানিও করছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘আমি চালকদের দোষ দেব না। দোষ দেব তাঁদের, যাঁরা বাস রুটের অনুমোদন দিয়ে থাকেন। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি তাঁরাই তৈরি করে দিচ্ছেন। গুলশানে ঢাকা চাকা নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাস চালাচ্ছে। সেখানে তো যাত্রীরা নিয়ম মেনে বাসে চড়ছেন। ঢাকা চাকার বাসগুলোয় তো আঁচড় পড়ছে না, দুর্ঘটনাও ঘটছে না। গুলশানে এটি সম্ভব হলে রাজধানী ঢাকায় বাকি অংশে কেন অসম্ভব হবে না। আসলে প্রয়োজন উদ্যোগ।’

রাজধানীর নতুনবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা চাকা, গুলশান চাকা পরিবহনের বাসগুলো। ঝকঝকে বাসে নেই কোনো ঘষা কিংবা আঁচড়ের দাগ। টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে নির্ধারিত সময়ে বাসে উঠছেন যাত্রীরা। যাত্রী ওঠা শেষ হলে দরজা লাগিয়ে যাত্রা শুরু করছেন চালক। নির্ধারিত গন্তব্যে গিয়ে যাত্রী নামিয়ে দিচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই বাসগুলো। মাঝরাস্তায় দৌড়ঝাঁপ করে যাত্রী নামানোর কোনো নিয়ম নেই এই সার্ভিসের। নতুনবাজার থেকে গুলশান-২ যাচ্ছিলেন শিরিন আনোয়ারা। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স ৫৫ বছর। মাঝরাস্তায় দৌড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করে বাসে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওভাবে ঝুঁকি নিয়ে বাসে উঠতে গিয়ে রাজধানীতে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই বাসগুলোর মতো নিয়ম মেনে চললে অনেক সমস্যা এড়ানো সম্ভব। বাসগুলো দেখতেও চোখে শান্তি লাগে। পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে পরিবহন, ভিতরেও পরিষ্কার।’

সরকারের নীতিমালা না থাকায় এই সুযোগ নিচ্ছেন বাসমালিকরা। দুই দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় রুট অনুযায়ী গণপরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট রং নির্ধারণ করত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বাসের রং উঠে গেলে সেটি চলাচলের অনুপযোগী হবে। বিআরটিএর সেই সার্কুলার পরবর্তী সময় নতুন করে জারি করা হয়নি। বর্তমানে রাজধানীর ২৯১টি রুটে চলাচলকারী প্রায় ৩০ হাজার বাসের অধিকাংশই এখন রং চটা অবস্থায় চলছে।

গত তিন দিনে রাজধানীর গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর এবং গাবতলী রুটে সরেজমিন এমনই দৃশ্য চোখে পড়েছে। লোকাল সার্ভিস, সিটিং সার্ভিস এমনকি টিকিট সার্ভিসের গাড়িতেও একই অবস্থা। ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিআরটিএ থেকে রং চটা বাসগুলোকে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। এ কারণে আটক করেও জরিমানা করা যায় না। আর জরিমানা করলেও বাসমালিক ও শ্রমিকরা একজোট হয়ে আন্দোলন করেন, বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেন। তখন যাত্রীরা উল্টো ট্রাফিক বিভাগের ওপর চড়াও হন। বাসের রং চটা বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কারণে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে দুর্ঘটনার হার বাড়ছে। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছি। কিছুদিনের মধ্যেই একটি রুটে পুরনো বাসগুলো দিয়েই একটি পাইলট প্রকল্প চালু হবে। সেখানে পুরনো বাসগুলো মেরামত করে রাস্তায় নামানো হবে।

তিনি আরও বলেন, কোম্পানিভিত্তিক বাস চালু হলে এরকম বাস আর থাকবে না। কিন্তু তা সময়ের ব্যাপার। বাসমালিকদের জন্য ব্যাংক থেকে অল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা, এসব বাস মেরামত করা- এসবে কিছুটা সময় লাগবে। সরকারেরও টার্মিনাল, ডিপো নির্মাণ করতে সময় লাগবে। আমরা এই উদ্যোগে সার্বিক সহযোগিতা করছি।

সর্বশেষ খবর