মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

হেলমেট যেন প্লাস্টিকের বাটি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

হেলমেট যেন প্লাস্টিকের বাটি

দেশের ৩১ লাখ নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আরোহীর একটি বড় অংশ ব্যবহার করেন নিম্নমানের হেলমেট। এতে দুর্ঘটনায় মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে -রোহেত রাজীব

রাজধানীজুড়ে মানহীন হেলমেটে চলছে যাত্রী সুরক্ষা। রাইড শেয়ারিংয়ে ব্যবহৃত যাত্রীদের হেলমেটগুলো যেন প্লাস্টিকের বাটি। প্রায়ই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন চালক ও যাত্রী। দুর্ঘটনায় কাজে আসছে না এসব হেলমেট। উল্টো প্লাস্টিকের পাতলা হেলমেট ফেটে মাথায় ঢুকে যাত্রীদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। এর আগে রাজধানীর বিজয় সরণিতে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী আকলিমা আক্তার জুঁই। রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবারের মোটরসাইকেলে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় কাজে আসেনি হেলমেট। এ রকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে সারা দেশে। চালক ও যাত্রীর হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক হলেও হেলমেটের মান যাচাই করছে না কেউ।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার খবর সংকলন করে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনটি।। নিসচার হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ২৩২টি, যার ১ হাজার ১২৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ ট্রাক ও ২২ শতাংশ বাস দুর্ঘটনার। বুয়েটের এআরআইয়ের হিসাবে, ২০১৬ সালে ২৮৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জন মারা যান। ২০২০ সালে দুর্ঘটনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৮টিতে, মারা যান ১ হাজার ৯৭ জন। বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে। এতে উঠে আসে, ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেন। একই সংস্থার করা আরেক জরিপে এসেছে, চালকের ৩০ শতাংশ অতি নিম্নমানের হেলমেট পরেন। মাত্র ২ শতাংশ ক্ষেত্রে আরোহীদের ‘ফুলফেস’ হেলমেট দেওয়া হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০০৬ সালের একটি গবেষণা বলছে, ভালো মানের একটি হেলমেট পরলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হওয়ার ঝুঁকি কমে ৭০ শতাংশ। আর মৃত্যুঝুঁকি কমে ৪০ শতাংশ। মগবাজার মোড়ে বাইকারস কর্নার প্রতিষ্ঠানের মালিক তানভীর আহমেদ রুবেল বলেন, আমাদের এখানে ভালো মানের হেলমেটের দাম ৪ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে। চালকরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য এসব হেলমেট কিনছেন। কিন্তু রাইড শেয়ারিংয়ের চালকরা নিজেদের জন্য মোটামুটি মানের হেলমেট কিনলেও যাত্রীদের জন্য সাধারণত ২৫০-৩০০ টাকা দামের ক্যাপ কেনে। ওগুলোকে হেলমেট বলা চলে না। ট্রাফিক সার্জনের মামলা থেকে বাঁচতে এগুলো কেনেন তারা। দুর্ঘটনায় এসব হালকা হেলমেট সুরক্ষা তো দূরের কথা বিপদ আরও বাড়ায়।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) পরিচালক অধ্যাপক আবদুল গণি মোল্লাহ বলেন, আমাদের হাসপাতালে দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় ৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। রাজধানীর বাইরে থেকে রোগী বেশি আসে। সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং বাড়ায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাও বেড়েছে। তিনি বলেন, আগে মোটরসাইকেল চালকরা ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন রাস্তায় বের হলে রাইড শেয়ারিংয়ে যাত্রীদের মাথায় হেলমেটের নামে প্লাস্টিকের বাটি ঝুলতে দেখি। দুর্ঘটনায় এগুলো ফেটে মাথায় লাগলে আঘাত আরও গুরুতর হয়। এজন্য দুর্ঘটনাস্থলে মৃতদের সংখ্যা বাড়ছে। গত এক মাসে প্রায় ৫৭ জন দুর্ঘটনাস্থলে মারা গেছেন। হেলমেটের মান নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। আইনকানুন মেনে নিরাপদে মোটরসাইকেল চালাতে হবে। নতুন বছরের প্রথম মাসে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪২৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৪৮৪ জন। আহত হয়েছেন ৬৭৩ জন। দুর্ঘটনার ৩৭ দশমিক ৩৪ ভাগ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ছিল মোটরসাইকেল। নিহতদের ৩৭ দশমিক ২৩ ভাগ অর্থাৎ ১৬৮ জন মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। সম্প্রতি রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এ ব্যাপারে বুয়েটের এআরআইয়ের পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, সম্প্রতি আমরা এক জরিপে দেখেছি মোটরসাইকেল চালকদের ১০ শতাংশ ও যাত্রীদের মাত্র ২ শতাংশ ফুলফেস হেলমেট ব্যবহার করে। হাফফেস হেলমেট ব্যবহার করায় যাত্রাপথে তাদের মুখ পুরোপুরি অরক্ষিত থাকে। কোনো ধারালো বস্তু মুখে লাগলেই দুর্ঘটনা ঘটে। দেশে কেমন ধরনের হেলমেট ব্যবহৃত হবে তার মান ঠিক করেছে বিএসটিআই। বিডিএস ১১৩৬ স্ট্যাডার্ড অনুযায়ী হেলমেট উৎপাদন ও বিক্রি হতে হবে। কিন্তু বিএসটিআইর মনিটরিং না থাকায় হেলমেটের নামে প্লাস্টিকের বাটিতে সয়লাব হয়েছে বাজার। ভালো মানের হেলমেট ৫০ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি ও ৭০ শতাংশ গুরুতর আহত হওয়ার ঝুঁকি কমায়। প্রতিদিন বাড়ছে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর সংখ্যা। সতর্ক না হলে সামনে বিপদ আরও বাড়বে।

সর্বশেষ খবর