মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

ঘরবন্দী মানুষের দুঃসহ দিনকাল

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঘরবন্দী মানুষের দুঃসহ দিনকাল

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে ওলটপালট চারপাশ। ঘরে ঘরে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। তাই ঘরবন্দী মানুষ সময় কাটছে নানা উপায়ে ছবি : রোহেত রাজীব

করোনাভাইরাস মহামারীর ছোবলে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছে মানুষ। এ সময় প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিনোদনে ঝুঁকছে মানুষ। শিশু, তরুণ, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ ঝুঁকছেন সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, টেলিভিশনের দিকে। মহামারীর কারণে ঘরবন্দী এই দুঃসহ সময়ে অনেকে ছাদবাগান করছেন, শরীরচর্চা, বাহারি রান্না কিংবা ইনডোর খেলাধুলায় সময় পার করছেন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এক বছরের বেশি সময় ঘরবন্দী শিশু, কিশোর ও তরুণরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আলোচনা শুরু হতেই আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় ওলটপালট চারপাশ। চারদিকে মৃত্যুর মিছিল। ঘরে ঘরে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। তাই বাইরে যাওয়া কিংবা মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, আড্ডা, গল্পও বারণ। শহরে স্বল্প জায়গার বাসায় দিনের পর দিন শিশুদের আটকে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। তাই শিশুদের বিনোদন দিতে সহজমাধ্যম হিসেবে বসিয়ে দিচ্ছেন টেলিভিশনের সামনে। কার্টুন দেখতে দেখতে খাওয়া-ঘুম সবই চলে। টেলিভিশনে কার্টুন পছন্দ না হলে মোবাইলে, ইউটিউবে চোখের সামনে চলে ভার্চুয়াল জগতের দৌড়ঝাঁপ। ভার্চুয়াল জগতের গতিকেই বাস্তব মনে করে শিশুরা। অনলাইনে ক্লাস চলায় শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে চলে এসেছে মুঠোফোন। পড়াশোনার থেকে বেশি চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউবে সময় কাটানো। যে ছেলেমেয়েরা সকালবেলা নাস্তা করে হুড়মুড় করে দৌড় দিত স্কুল-কলেজে। তাদের এখন কার্যত কোনো রুটিন নেই। সারা দিন তারা একটা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে দুটি জাগরিত চোখকে সারাক্ষণ নিবদ্ধ রাখে মোবাইল স্ক্রিন, ল্যাপটপ কিংবা টিভির পর্দায়। বই পড়ায়ও নেই আগ্রহ।

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুল সিদ্দিকি বলেন, গ্রামের খোলা জায়গায় শিশুরা তবু হেসে-খেলে কিছুটা সময় কাটাতে পারে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। কিন্তু রাজধানীর এই দুই রুমের বাসায় ঠিকমতো আলো-বাতাস ঢুকে না। দিনের পর দিন ছেলেমেয়েদের কীভাবে আটকে রাখি। ছাদে যাওয়ার অনুমতিও নেই। কিছুদিন ওদের বই পড়তে উৎসাহিত করেছিলাম। কিন্তু অনলাইনে ক্লাস চালু হওয়ার পর বাধ্য হয়েই ফোন হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। শুধু শিশুরা নয়, সব বয়সী মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা। 

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উই আর সোশ্যাল’ এবং কানাডাভিত্তিক ডিজিটাল সেবা প্রতিষ্ঠান হুটস্যুইট ‘সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির ব্যবহার’ শীর্ষক জরিপ পরিচালনা করেছে। বৈশ্বিক এই জরিপে উঠে এসেছে পৃথিবীর যেসব শহরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ঢাকা হচ্ছে দ্বিতীয়। এখানে সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২২ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক অনেকক্ষণ ধরে স্ক্রিনে থাকার কারণে সবার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে থাকে এবং কথা বলতে ভালো লাগে না। চোখ টনটন করতে থাকে, ঘাড় ব্যথা করে, হাত অবশ হয়ে যায় মাঝে মাঝে। ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কিন্তু কম নয়।

এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ডা. এম মোহিত কামাল বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য তরুণকে আমরা চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউবসহ অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। তারা ভার্চুয়াল দুনিয়ার মতো বাস্তবেও সবকিছু ওভাবেই পেতে চায়। এতেই বাধে বিপত্তি। এখন সব বয়সী মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের আসক্তি বেড়েছে। মাদকের চেয়ে কোনো অংশে এই আসক্তি কম নয়। ঘুম কমিয়ে মনকে অসুস্থ করে দিচ্ছে অত্যধিক প্রযুক্তির ব্যবহার। বিভিন্ন রকমের রান্না ও ছাদবাগান করে সময় পার করছেন অনেকে। রাজধানীর আদাবরের বাসিন্দা গৃহিণী রিনা রহমান বলেন, লকডাউনে ঘরে বন্দী আমরা সবাই। করোনার থাবা থেকে বাঁচতে খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আমরা বের হচ্ছি না। তাই সময় কাটাতে বেলকোনি এবং ছাদে লাগানো গাছের পরিচর্যায় সময় পার করছি। আমার ছেলেমেয়েদেরও এ কাজে ব্যস্ত রাখছি। সবুজের মধ্যে থাকায় ওদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকছে। বাকি সময় বই পড়া, রান্না করা এবং ওদের দাদা-দাদির সঙ্গে লুডো, দাবা খেলে কাটাচ্ছে। দীর্ঘ সময় মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকলে নানারকম শারীরিক-মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছিল ছেলেমেয়েদের। এখন ওরা নিয়মিত বই পড়ছে। ঘরে থাকা প্লাস্টিকের সামগ্রীতে টমেটো, কাঁচামরিচ, পুদিনা পাতা এবং বাহারি ফুলের গাছ লাগিয়েছে। 

কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মহসিন আলী বলেন, রোজার সময় আমাদের কাপড়ের দোকানে ব্যবসার মৌসুম। কিন্তু এবার লকডাউনে ঘরবন্দী। ব্যস্ত থাকায় কখনো পরিবারের সঙ্গে ইফতার করা হয় না। তাই এবার প্রতিদিন ইফতারে আমি আর ছেলে মিলে বিভিন্ন রকমের খাবার রান্না করছি। তাতে পরিবারের সবাই খুব খুশি। আর ব্যস্ত থাকায় ব্যবসায়িক ক্ষতি ও নানা দুশ্চিন্তার চাপ কিছুটা কম বোধ করছি।

সর্বশেষ খবর