মঙ্গলবার, ১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ডিজিটাল ডিভাইসে ক্ষীণ হচ্ছে শিশুর দৃষ্টি

অনেক শিশুর চশমার পাওয়ার খুব দ্রুত বাড়ছে। অনেকের চোখে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখ চুলকাচ্ছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, এলার্জি দেখা দিচ্ছে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডিজিটাল ডিভাইসে ক্ষীণ হচ্ছে শিশুর দৃষ্টি

গবেষণা রিপোর্ট বলছে, রাজধানীর শিশুদের দৃষ্টিত্রুটির হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪০ শতাংশ। চোখের ত্রুটি সংশোধনে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ চিকিৎসকদের ছবি : মানিক মুনতাসির

করোনাভাইরাস মহামারীর ছোবলে এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনার ভয়ে মাঠে খেলতে যেতেও পারছে না শিশুরা। তাই অনেকটা স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হচ্ছে। অনলাইনে পাঠদান ও বিনোদনের খোঁজে ডিজিটাল ডিভাইসে ঝুঁকছে শিশুরা। এতে ক্ষীণ হচ্ছে দৃষ্টি, নষ্ট হচ্ছে শিশুদের চোখ।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু চক্ষু বিভাগের প্রধান ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনাকালে মাঠের খেলাধুলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে শিশুরা। সময় কাটাতে শিশুদের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার বাড়ছে। গত বছরের জুন-জুলাই মাস থেকে আমাদের কাছে অনেক শিশু আসছে চোখের সমস্যা নিয়ে। এদের অনেকেরই আগে চোখে সমস্যা ছিল না। এখন চশমা দিতে হচ্ছে। অনেক শিশুর চশমার পাওয়ার খুব দ্রুত বাড়ছে। অনেকের চোখে পানি শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখ চুলকাচ্ছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, এলার্জি দেখা দিচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে আমাদের শিশু চক্ষু বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৬৯ হাজার শিশু। ২০২০ সালে চিকিৎসা নিয়েছে ৪৪ হাজার ৫১৯ জন। মার্চে করোনা শুরুর পরে হাসপাতালে খুব কম শিশু চিকিৎসা নিতে এসেছে। কিন্তু জুন-জুলাইয়ের দিকে অনেক শিশু চোখের সমস্যা নিয়ে আসতে শুরু করে। ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে তাদের চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জুলাই মাসে চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ৯৭৮ শিশু, আগস্টে তিন হাজার শিশু, সেপ্টেম্বরে দেখেছি ৪ হাজার ৫৩৬ জন শিশুকে। গত এপ্রিলে চিকিৎসা নিয়েছে ৮২৫ জন।’

দীর্ঘ সময় ডিজিটাল ডিভাইস স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় শিশুদের চোখের সমস্যা বেড়েছে বলে জানান এই চিকিৎসক। শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা। মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা, আড্ডা, গল্পও বারণ। শহরে স্বল্প জায়গার বাসায় দিনের পর দিন শিশুদের ঘরে আটকে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। তাই শিশুদের বিনোদন দিতে সহজমাধ্যম হিসেবে বসিয়ে দিচ্ছেন টেলিভিশনের সামনে। কার্টুন দেখতে দেখতে খাওয়া-ঘুম সবই চলে। টেলিভিশনে কার্টুন পছন্দ না হলে মোবাইলে ইউটিউবে চোখের সামনে চলে ভার্চুয়াল জগতের দৌড়ঝাঁপ। অনলাইনে ক্লাস চলায় শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে চলে এসেছে মুঠোফোন। পড়াশোনার থেকে বেশি চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউবে সময় কাটানো। সারা দিন তারা একটা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে দুটি চোখকে সারাক্ষণ নিবদ্ধ রাখে মোবাইল স্ক্রিন, ল্যাপটপ কিংবা টিভির পর্দায়। বই পড়াতেও নেই আগ্রহ।

ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের স্কুলশিক্ষার্থীদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ১৪ জনের দৃষ্টিত্রুটি রয়েছে। এই শিশুদের চোখের ত্রুটি সংশোধনের জন্য চশমা ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। ঢাকা, বরিশাল, জামালপুর ও নওগাঁর বিভিন্ন স্কুলের ৩২ হাজার ৭৪৮টি শিশুর চোখ পরীক্ষা করে এই তথ্য পেয়েছেন তারা। তাদের গবেষণা অনুযায়ী, চার জেলার মধ্যে রাজধানী ঢাকার শিশুদের দৃষ্টিত্রুটির হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪০ শতাংশ। গবেষণাটির শিরোনাম ‘বাংলাদেশের কিছু এলাকায় স্কুলের শিশুদের দৃষ্টিত্রুটি পরিস্থিতি’। গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, সবচেয়ে বেশি ত্রুটি দেখা গেছে রাজধানী ঢাকার শিশুদের মধ্যে। ঢাকার ১৯টি স্কুলের ৬ হাজার ৪০১ জন শিশুশিক্ষার্থীর চোখ পরীক্ষা করে মোট ২ হাজার ৫৫১ জনকে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। হার প্রায় ৪০ শতাংশ। বরিশালে পরীক্ষার আওতায় আসা প্রায় ১২ শতাংশ এবং নওগাঁ ও জামালপুরে প্রায় ৫ শতাংশ করে শিশুকে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। করোনাকালে দীর্ঘসময় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করায় শিশুদের দৃষ্টি ত্রুটি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।

ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেটিনা ও ইউভিয়া বিভাগের কনসালটেন্ট ও সহকারী অধ্যাপক ডা. মোমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘খুব কাছে থেকে ডিভাইসের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকায় শিশুদের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। দূরের দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মাইয়োপিয়ায় ভুগছে শিশুরা। এ জন্য শিশুদের দীর্ঘ সময় ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দূরের কোনো জিনিস কিংবা সবুজ গাছপালায় তাকানোর অভ্যাস করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনলাইন ক্লাসে শিশুরা হয়তো ডিভাইসের সামনে থাকছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি সময় কার্টুন, ভিডিও গেমসে বেশি সময় ডিভাইস ব্যবহার করছে। এতে দৃষ্টি সমস্যার পাশাপাশি মাথাব্যথা, চোখ ব্যথায়ও ভুগছে শিশুরা। শিশুদের পড়াশোনা টেবিল-চেয়ারে করলে চোখ ঠিকঠাক দূরত্বে থাকে। কিন্তু বিছানায় শুয়ে বই কাছে নিয়ে পড়লে চোখের ক্ষতি হয়। শিশুদের পড়াশোনার কাজে সবসময় উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর