মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আরামদায়ক চেয়ারে প্রাণঘাতী রোগ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

আরামদায়ক চেয়ারে প্রাণঘাতী রোগ

প্রতিদিন ৪৫ মিনিট মোটরসাইকেল চালিয়ে অফিসে যান বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা সজীব রায়হান। এরপর কমপক্ষে আট ঘণ্টা চেয়ারে বসে কাজ করতে হয় তাকে। চাকরির বয়স দুই বছর পার হতেই কোমর এবং পিঠের ব্যথা নিত্যসঙ্গী হয়েছে তরুণ এই কর্মকর্তার।

তিনি বলেন, আগে কখনই আমি এ ধরনের ব্যথায় ভুগিনি। ব্যাংকে চাকরিতে দীর্ঘসময় বসে কাজ করতে হয়। এরপর বাসা থেকে মোটরসাইকেলে যাওয়া-আসায় প্রায় ৯০ মিনিট সময় লাগে। চাকরি শুরুর ছয় মাস পার হতেই কোমরে ব্যথা শুরু হয়। আস্তে আস্তে ব্যথার প্রকোপ বাড়ছে। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে কিছুদিন ফিজিওথেরাপি নিতে বলেছিলেন। এ ছাড়া কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো মেনে চলছি। চেয়ারে দীর্ঘ সময় বসে না থেকে মাঝে মাঝে উঠে ২-৪ মিনিট হাঁটি। বাসায় ফিরে কিছু ব্যায়াম করি।

সজীব রায়হানের মতো দেশের কর্মজীবীদের একটু বড় অংশ পিঠ কোমরের ব্যথায় ভুগছেন। দীর্ঘসময় চেয়ারে বসে কাজ করে পড়ছেন শারীরিক সমস্যায়। কর্মজীবীদের মধ্যে ব্যাকপেইনে বা পিঠ, কোমরের ব্যথায় ভোগেন না এমন মানুষ কম। দীর্ঘ মেয়াদি এই ব্যথার সমাধান না হলে প্রভাব পড়ছে মেরুদন্ডের হাড়ে। অপারেশন পর্যন্ত করাতে হয় অনেক রোগীকে। কর্মক্ষেত্রে আরামের চেয়ার ডেকে আনছে প্রাণঘাতী রোগ। দেশের

অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়ছে নির্বাহী কর্মকর্তা। তাদের নিত্যদিনের ট্রেস, আরাম চেয়ারে দীর্ঘসময় বসে কাজ করার কারণে বিপদ বাড়ছে।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ এক প্রাণঘাতী ব্যাপার। ২০১০ সালে চিকিৎসা সাময়িকী সার্কুলেশন এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়- সাত বছর ধরে ৮ হাজার ৮০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, এদের মধ্যে যারা দিনে চার ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় বসে কাটান তাদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি ৪৬ শতাংশ বেশি তাদের চেয়ে, যাদের ক্ষেত্রে এটি সাকল্যে দুই ঘণ্টার বেশি নয়। গবেষকদের মতে, দিনের অর্ধেকেরও বেশি সময় যারা বসেই কাটান তাদের ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক দ্বিগুণ। এবং সবমিলিয়ে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে শতকরা ৫০ ভাগ। সব দেখেশুনে মনে হয়, চেয়ারই বুঝি হয়ে উঠেছে এক মৃত্যুফাঁদ!

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) অর্থোপেডিক সার্জারি অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘসময় বসে কাজ করলে ঘাড়ে, পিঠে, কোমরে ব্যথা হতে পারে। অনেকে অফিসে বসে কাজ করে, নারীরা অনেক সময় নিচু হয়ে বসে সবজি কাটা কিংবা রান্নার কাজ করে। অনেকে দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোর কারণে কোমরের ব্যথায় ভোগেন। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, এ জন্য তিনটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। একভাবে না থেকে মাঝে মাঝে অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। হালকা স্ট্রেসিংয়ের কিছু ব্যায়াম আছে সেগুলো করতে হবে। ব্যথা হলে নরম কাপড় দিয়ে ছেঁক দেওয়া যেতে পারে কিংবা হট ওয়াটার ব্যাগে উষ্ণ গরম পানি দিয়ে ব্যথার জায়গায় দেওয়া যেতে পারে। ব্যথা বাড়লে চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যথানাশক জেল ও ওষুধ সেবন করতে হবে। অনেকের ফিজিওথেরাপিরও প্রয়োজন পড়ে। নিয়ম মেনে চললে এ সমস্যা পুরোপুরি সেরে যায়। কিন্তু সময় গড়াতে থাকলে সমস্যা আরও বাড়ে। অনেকের অপারেশন প্রয়োজন পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র মায়ো ক্লিনিক। এ প্রতিষ্ঠানের মেদস্থূলতা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কার্যক্রমের সহ-পরিচালক জেমস লেভিন। পেশায় এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট লেভিন কয়েক দশক ধরে মেদস্থূলতা এবং দীর্ঘক্ষণ বসে কাটানোর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তার মতামত হলো, দীর্ঘসময় বসে থাকা যাবে না।

সুস্থতার জন্য দিনের বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়ে থাকার বা দৈহিকভাবে সক্রিয় থাকার অভ্যাস করতে হবে। লেভিনের মতে, চেয়ারে বসে কাজ কিংবা নিছক আলস্যবশত বসে সময় কাটালে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, মেদস্থূলতাসহ নানা জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এ সময়টাই যদি কাজ করা যায় দাঁড়িয়ে বা হাঁটাচলা করা যায়, তবে কমে আসে এসব রোগঝুঁকি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার (নিউরোসার্জারি) ডা. মুহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দীর্ঘসময় বসে কিংবা শুয়ে থাকলে শরীরের পেছন অংশের মাংসপেশিতে ব্যথা হয়। বেশি সময় ধরে নিয়মিত বসে কাজ করলে মেরুদন্ডের পাঁচটি হাড়ের মাঝে থাকা ডিস্কগুলো সরে যায়। বয়স বাড়তে থাকলেও ডিস্কের ইস্ট্রালিসিটি নষ্ট হয়ে ব্যথার কারণ হয়। অভ্যাসমতো না বসে হঠাৎ ধরন পাল্টালে অনেক সময় ব্যথা হয়। এটাকে মেকানিক্যাল পেইন বলে। পেশাজীবীদের একটি বড় অংশ এ সমস্যায় ভোগেন।

এই চিকিৎসক আরও বলেন, এ সমস্যা সমাধানে চেয়ারে বসার সময় মেরুদন্ড সোজা করে বসতে হবে। ঘণ্টাখানেক টানা বসে কাজ করলে উঠে দুই মিনিট মতো হাঁটাচলা করতে হবে। এতে মাংসপেশিতে রক্ত সঞ্চালন ভালো হবে, ব্যথা থাকবে।

এর প্রতিকারে অব্যর্থ চর্চার বিষয় হতে পারে বঙ্গাসন। আরাম চেয়ার ছাড়ুন, বঙ্গাসনের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কমে যায়। মেঝেতে বা ম্যাটে হাঁটু থেকে পা ভাঁজ করে বসুন। পায়ের পেশির সঙ্গে ঊরুর পেশি লেগে থাকবে এবং নিতম্ব মেঝে স্পর্শ করবে না। এই বঙ্গাসনই হতে পারে আরাম চেয়ারে ডেকে আনা বিপদ থেকে মুক্তির পথ।

সর্বশেষ খবর