মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

রক্ত সঞ্চয় হোক দুঃসময়ের জন্য

আজ বিশ্ব রক্তদাতা দিবস, র‌্যালি, ব্লাড ক্যাম্প, সম্মাননার আয়োজন

জয়শ্রী ভাদুড়ী

রক্ত সঞ্চয় হোক দুঃসময়ের জন্য

নিজ দেহে রক্ত সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই। তাই রক্ত সঞ্চয় করতে হবে রক্তদানের মাধ্যমে। এই প্রচারণার মধ্য দিয়ে আজ দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস ছবি : সংগৃহীত

আমাদের ১৮ কোটি মানুষের দেশে বছরে রক্তের চাহিদা প্রায় ৮-৯ লাখ ইউনিট। সচেতনতার অভাবে তাও পূরণ করা যায় না। প্রয়োজনীয় রক্তের একটি বড় অংশ আসে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। রক্তের প্রয়োজন রক্ত দিয়েই মেটাতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনা, শিল্প দুর্ঘটনা, অগ্নিদুর্ঘটনা, থ্যালাসেমিয়া, রক্তস্বল্পতা, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি রোগীর রক্তের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া প্রসূতির রক্তক্ষরণ, অপারেশনেও রক্ত লাগে। মানবদেহে রক্তের ঘাটতিপূরণে রোগীর স্বজনরা রক্তের জন্য ছুটে বেড়ান। অনেক সময় কাক্সিক্ষত গ্রুপের রক্ত পেতে সীমাহীন ভোগান্তি হয়। এই বাস্তবতা সামনে রেখে আজ ১৪ জুন বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ২০০৪ সাল থেকে প্রতি বছর নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন নিশ্চিত করতে দিবসটি পালিত হচ্ছে বাংলাদেশেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত রক্তদাতা দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য- ‘রক্তদান সংঘবদ্ধতারই প্রকাশ, এ কাজে যুক্ত হোন, জীবন বাঁচান’।

রক্ত পরিসঞ্চালনবিদ প্রফেসর ডা. মুজিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ১৯৭২ সালের ১০ জুন জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম নিজে রক্ত দিয়ে দেশে স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের সূচনা করেন। পরে সন্ধানী (১৯৭৮), রেড ক্রিসেন্ট (১৯৮১), অরকা (১৯৮২), বাঁধন (১৯৯৭) বা লায়ন্স ক্লাবের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এটি এগিয়ে নেয়। একসময় প্রয়োজনীয় রক্তের বড় অংশ আসত মাদকাসক্ত পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। দূষিত রক্ত নিয়ে রোগীরা আক্রান্ত হতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের সূচনা হয়। এটি পূর্ণতা পায় ২০০০ সালে আধুনিক ল্যাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কোয়ান্টামের আড়াই দশকের চেষ্টায় সারা দেশে স্বেচ্ছা রক্তদান নিয়ে  তৈরি হয়েছে সচেতনতা। কোয়ান্টাম ল্যাব গড়ে তুলেছে ৪ লক্ষাধিক রক্তদাতার একটি ডোনার পুল। এই সময়ে প্রায় ১৪ লাখ ইউনিট রক্ত ও রক্ত উপাদান সরবরাহ করে মানুষের জীবন বাঁচাতে সহায়তা করছে তারা। নিরাপদ রক্তের ব্যাপারে কোয়ান্টাম ল্যাব এখন চিকিৎসক এবং রোগীদের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক।

দুর্যোগে, দুর্ঘটনায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় কোয়ান্টাম ল্যাব। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকদের চিকিৎসায় বিনামূল্যে রক্ত সরবরাহ, পুরান ঢাকার নিমতলীর কেমিক্যাল গোডাউনের অগ্নিদুর্ঘটনাসহ বার্ন ইউনিটে আসা আগুনে পোড়া রোগীদের জরুরি রক্ত উপাদান সরবরাহ করছে কোয়ান্টাম। ২০১৪ সালে রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে আগুনে পোড়া রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় উপাদান ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমার (এফএফপি) একটি বড় অংশ (২০,৮৮৪ ইউনিট) সরবরাহ করে কোয়ান্টাম ল্যাব। ২০১৯ সালে ঢাকায় ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১২ হাজার ৯৬৭ ইউনিট প্লাটিলেট সরবরাহ করে কোয়ান্টাম ল্যাব। ২০২০ সালের করোনাকালে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও কোয়ান্টাম ল্যাব ২৪ ঘণ্টা খোলা রেখে সরবরাহ করেছে ৮৫ হাজার ৩৫৭ ইউনিট জরুরি রক্ত ও রক্ত উপাদান। এ সময় করোনা আতঙ্কের মধ্যে রক্তদাতাদের বাসা থেকে ল্যাবে এনে রক্তদানের পর বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত দুস্থ রোগীদের বিনামূল্যে প্রায় ৪৮ হাজার ইউনিট রক্ত দিয়েছে কোয়ান্টাম। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের দিয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ইউনিট রক্ত। ন্যূনতম প্রসেসিং খরচে অসচ্ছল রোগীদের দিয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ইউনিট রক্ত।

একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিয়মিত তিন থেকে চার মাস অন্তর রক্ত দিতে পারে। এতে রক্তদাতার শারীরিক-মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধি পায়। রক্তদানের মাধ্যমে শরীরের পাঁচটি রোগের টেস্টও হয়ে যায় বিনামূল্যে। বাংলাদেশের মোট চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ করছে কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম। সংগঠনটির আলোচিত স্লোগান, ‘দুঃসময়ের জন্য রক্ত সঞ্চয় করুন’। এই রক্ত আপনার দেহের অপরিহার্য উপাদান হলেও এটি নিয়মিতই নানা প্রক্রিয়ায় দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। তৈরি হয় নতুন রক্ত কণিকা। নিজ দেহে রক্ত সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই। তাই রক্ত সঞ্চয় করতে হবে রক্তদানের মাধ্যমে। কোয়ান্টাম ল্যাব সেই সুযোগ করে দিয়েছে। আপনি যত ব্যাগ রক্ত দান করবেন তার সমপরিমাণ রক্ত আপনি নিজের প্রয়োজনে কোনো সার্ভিস চার্জ ছাড়াই ফেরত পাবেন। আপনার স্বজনদের প্রয়োজনে পাবেন সার্ভিস চার্জে ছাড়। পরীক্ষিত সত্য হচ্ছে, যিনি অন্যের প্রয়োজনে রক্তদান করেন তার শরীরে রক্ত নেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতিই তৈরি হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মেই তিনি বেঁচে যান অনেক দুর্ঘটনা থেকে।

বিশ্বজুড়ে প্রয়োজনীয় রক্তের জোগান দেন স্বেচ্ছা রক্তদাতারা। তাদের প্রতি সম্মান ও মানুষকে রক্তদানে সচেতন করা এ দিবসের উদ্দেশ্য। এ বছর বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজক দেশ মেক্সিকো। ঢাকায় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস পালনে একাধিক বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে সকাল ১০টায় শাহবাগ থেকে রক্তাদাতাদের পদযাত্রা, জাতীয় প্রেস ক্লাবে ব্লাড ক্যাম্প ও রক্তদাতা সম্মাননা অনুষ্ঠান। অন্তত ৫০ বার এবং ২৫ বার রক্ত দিয়েছেন এমন প্রায় ২০০ স্বেচ্ছা রক্তদাতা এ পদযাত্রায় অংশ নেবেন। বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের রক্তদাতা সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

সর্বশেষ খবর