মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

ফ্লাইওভারের নিচে দখল দূষণ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ফ্লাইওভারের নিচে দখল দূষণ

রাজধানীর ফ্লাইওভারগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। ফ্লাইওভারের নিচের অংশ দখল করে ব্যবসা এবং ময়লা-আবর্জনা, ইট-বালু রেখে ডাম্পিং স্টেশন গড়ে তোলা হয়েছে। মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচের দৃশ্য ছবি : রোহেত রাজীব

রাজধানীর যানজটের ভোগান্তি কমাতে পর্যায়ক্রমে ছয়টি ফ্লাইওভার গড়ে তোলা হলেও এসব ফ্লাইওভারের প্রায় সবকটির নিচের জায়গা চলে গেছে বেদখলে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ফ্লাইওভারের নিচের অংশ ব্যবসাকেন্দ্র এবং আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এসব ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে গাড়ি চললেও এর নিচটা হয়ে উঠেছে নিত্য ভোগান্তির নতুন নিদর্শন।

ফ্লাইওভারগুলোর নিচে গাড়ির গ্যারেজ, ভাতের দোকান থেকে শুরু করে মাংস, মুরগির দোকান, টংঘর, ঘোড়া রাখার স্থান, নানা পণ্যের গোডাউন, শৌচাগার-এমনকি থাকার ঘরও তৈরি করা হয়েছে। কোথাও বসেছে বালু-ইট-পাথরের মহাল। ময়লা, আবর্জনা রাখার ডাম্পিং স্টেশন। এসব ফ্লাইওভারের দখলে জড়িত রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে স্থানীয় কাউন্সিলর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এমনকি এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সিটি করপোরেশনের লোকজনও।

রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচের বিভিন্ন অংশ দখল করে নানা স্থাপনা বানানো হয়েছে। বসেছে দোকান। গড়ে তোলা হয়েছে থাকার জায়গা, গাড়ির গ্যারেজ, ডাম্পিং স্টেশন। মৌচাক ও ইস্কাটন এলাকায় প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে মাছবাজার বসে। শনির আখড়া থেকে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে বকশীবাজার পর্যন্ত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের বিভিন্ন অংশ অরক্ষিত। গুলিস্তান এলাকায় ফ্লাইওভারটির নিচে ঘর তৈরি করে বসবাস করছে অনেকে। বঙ্গবাজার এলাকায় ঘোড়া রাখার জায়গা তৈরি করা হয়েছে। ঘোড়ার মলমূত্র ছড়িয়ে পড়ছে সড়কে। গড়ে তোলা হয়েছে সারি সারি থাকার কক্ষ। এ ছাড়া বাকি অংশে ফলের দোকান, রিকশাভ্যানের স্ট্যান্ড, চায়ের দোকান, ভাঙারির দোকান বসানো হয়েছে। ফ্লাইওভারের যেসব জায়গা লোহার বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, সেখানে ভিতরে মাদকাসক্তদের অবস্থানের নানা চিহ্ন, ভাঙারির স্তূপ, বাক্স, ডাবের খোসা, পলিথিন পড়ে আছে।

হানিফ ফ্লাইওভারের কাপ্তানবাজার অংশে মুরগির খাঁচা ও বর্জ্যরে দুর্গন্ধে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে চলাচলে দম বন্ধ হয়ে আসে। সেখানে ফ্লাইওভারের নিচে বাসচালকদের ক্লাবঘরও গড়ে উঠেছে। টিকাটুলীতে ফ্লাইওভারের নিচেই ছোট ছোট ট্রাক ও পিকআপ রাখা হয়েছে।

কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচের বিভিন্ন অংশ এখন মিনিট্রাক ও ভাড়ার গাড়ির দখলে। মহাখালী ফ্লাইওভারের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে নানা স্থাপনা। খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচেও একই অবস্থা। সেখানে ফ্লাইওভারের নিচে মুরগি, শাক, সবজি, খাবারের দোকান বসানো হয়েছে। শুক্র ও শনিবার সপ্তাহে দুই দিন দীর্ঘ এলাকাজুড়ে জমজমাট হাট বসে। একটি অংশে গোডাউনের মতো করে ফার্নিচারের দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

ফ্লাইওভারের এসব দখল করা স্থান নিয়ে চলছে নানা ধরনের বাণিজ্য, দৈনিক আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এর ভাগ যায় পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্মকর্তা পর্যন্ত। ফলে দখলকারীদের দাপটে নানা সমস্যা পোহাতে হয় পথচারী ও এলাকাবাসীকে। কোথাও কোথাও তৈরি করা হয়েছে ভাগাড়, স্থানে স্থানে জমেছে ময়লার স্তূপ। দিনে বা রাতে অনেক জায়গায়ই বসে মাদকাসক্তদের আড্ডা, চলে মাদকের বিকিকিনি, রাতের নির্জনে যৌনকর্মীদের আনাগোনা, সময়ে-অসময়ে অবস্থান নেয় ছিনতাইকারীরা। ফ্লাইওভারগুলোর কোনো কোনো স্থানে রাস্তার পাশ পর্যন্ত দখল করে নির্মাণসামগ্রী রাখা হচ্ছে। কোথাও আবর্জনার             স্তূপ। তবে ছয়টি ফ্লাইওভারের মধ্যে শুধু ভিন্ন চিত্র বনানী-মিরপুর জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের। স্থানটি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এখানে দখল-দূষণের কোনো চিহ্ন নেই। বরং এর নিচের অনেক অংশই সবুজে ঘেরা, পরিচ্ছন্ন।

মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এলাকা থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত নিচের প্রায় সবটুকু জায়গাই দখলে। পুলিশের অস্থায়ী গাড়ি রাখার স্থান করা হয়েছে ফ্লাইওভারের এই অংশে। পথচারীরা জানান, এখানে গাড়ি রাখায় এ এলাকায় যানজট সবসময়ই লেগে থাকে। অপরদিকে মগবাজার থেকে বাংলামোটর যেতে ফ্লাইওভারে নিচে দখল করে গ্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। এফডিসি এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে মাছ রাখার বড় বড় বাক্স, ঝুড়ি রাখা হয়েছে। লোহার বাক্স রাখা হয়েছে মাঝখানে।

নগরবিদরা বলছেন, শত শত কোটি টাকা খরচ করে দৃষ্টিনন্দন এসব ফ্লাইওভার গড়ে তোলা হয়েছে। অথচ কার্যকর তদারকির অভাবে ফ্লাইওভারের নিচটা দখলে-দূষণে আবর্জনার জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এটা অবশ্যই রোধ করতে হবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কোনো স্থাপনাই চাঁদা ছাড়া রাখা যায় না। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা চাঁদায় ভাগ বসায়।

মুরগি বিক্রি করতে হলেও প্রতিদিন ৪০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এসব চাঁদা তোলার জন্য নির্দিষ্ট লাইনম্যান রয়েছে। চাঁদা দিতে দেরি হলে পুলিশ এসে উচ্ছেদের ভয় দেখায়। ফ্লাইওভারের নিচের দখল-দূষণ সম্পর্কে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ফ্লাইওভারের নিচ এমন করে দখল হয় না। ফ্লাইওভারের নিচে কোনো স্থাপনা থাকতে পারে না। ফ্লাইওভারের ওপর ও নিচ দুটোই গণমানুষের সম্পত্তি। পুলিশ বক্স বা টয়লেট, গাড়ি গ্যারেজ, দোকানপাট বসানো পুরোটাই অবৈধ, অন্যায়।

সর্বশেষ খবর