মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশৃঙ্খল পার্কিংয়ে বেহাল রাজপথ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বিশৃঙ্খল পার্কিংয়ে বেহাল রাজপথ

অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে ঢাকার রাস্তার আয়তন প্রায় অর্ধেক কমে যাচ্ছে। বাড়ছে যানজট, বাড়ছে দুর্ঘটনা। ছবিটি গুলশান থেকে তোলা -রোহেত রাজীব

রাজধানীর অপরিকল্পিত ও বিশৃঙ্খল পার্কিংয়ের কারণে দুঃসহ হয়ে উঠেছে যানজট পরিস্থিতি। রাস্তার দুই পাশ দখল করে গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে নগরীতে স্বাভাবিক যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে এই শহরের ৯০ ভাগ ভবনে পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা নেই। বহুতল বাণিজ্যিক ভবনেও প্রয়োজনের তুলনায় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা সীমিত। শপিং মল, সুপারমার্কেটগুলোতে গ্রাহকরা যে পরিমাণ গাড়ি নিয়ে কেনাকাটা করতে যান সেসব গাড়ি রাস্তা দখল করে পার্কিং করা হয়। ফলে, সড়কজুড়ে অবৈধ পার্কিংয়ে নগরীতে বাড়ছে যানজট, ঘটছে দুর্ঘটনা, স্থবির হয়ে পড়েছে রাজপথ। নগরীর অধিকাংশ মার্কেট, শপিং মল নিজেদের পার্কিংয়ের জায়গায় দোকানসহ নানা স্থাপনা গড়ে তুলে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছে। রাজউক এবং সিটি করপোরেশনের নির্লিপ্ত ভূমিকার কারণে সড়কই এখন গাড়ি পার্কিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হয়ে উঠেছে।

উল্লেখ্য, সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও দেশে একটি কার্যকর পার্কিং পলিসি তৈরি হয়নি। রাজউক, ডিটিসিবি, সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময় পার্কিং নিয়ে কাজ করলেও একটি গ্রহণযোগ্য পার্কিং পলিসি তৈরি হয়নি। ফলে, নগরীর রাস্তায় প্রতিবছর লাখ লাখ নতুন গাড়ি নামছে। কিন্তু সেসব গাড়ির পার্কিংয়ের কোনো নির্দেশনা নেই। ২০০৭-০৮ সালে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমলের প্রায় ২ হাজার পার্কিংয়ের জায়গা দখলমুক্ত করা হয়েছিল। তদারকি না থাকায় আবার বেদখল হয়ে যায় স্থাপনাগুলো।  

দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের (এআরআই) ২০২০-২১ সালে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, একটি আদর্শ শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় আছে মাত্র ৮ শতাংশ। যার মধ্যে যান চলাচলের জন্য ব্যবহার হয় মাত্র ৫ শতাংশ। রাজধানীর ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ যানজটের জন্য অবৈধ গাড়ি পার্কিং দায়ী করা হয়। গবেষণার তথ্য বলছে, রাজধানীর যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। আর রাজধানীর ২৫ শতাংশ যানজটের জন্য দায়ী অবৈধ গাড়ি পার্কিং। সে হিসেবে শুধু রাজধানীতে অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে ঢাকার রাস্তার আয়তন প্রায় অর্ধেক কমে যাচ্ছে। চালককে পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, এতে জ্বালানি খরচও বেশি হচ্ছে। ফলে পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। সব মিলিয়ে আর্থিক ক্ষতি হিসাব করা হয়ে থাকে। এমন বাস্তবতায় রাজধানীর পার্কিং ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতে নাজেহাল হতে হচ্ছে ট্রাফিক বিভাগকে। এদিকে, ট্রাফিক পুলিশ নগরীর কয়েকটি সড়কে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করলেও তা কাজে আসছে না। আবার অধিকাংশ সড়কেই কোনো পার্কিং ব্যবস্থাই নেই। অন্যদিকে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়কের ওপরই দিনের পর দিন রাখা হচ্ছে বড় পরিসরের গণপরিবহন। একই অবস্থা মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকাতেও। সেগুনবাগিচা ও অফিসপাড়া হিসেবে পরিচিত মতিঝিলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে মামলা দিয়েও সড়কে পার্কিং ঠেকানো বন্ধ করা যাচ্ছে না। কারণ, মতিঝিল, দিলকুশার অফিস পাড়ায় ৯০ শতাংশ ভবনেই পার্কিং সুবিধা নেই। দুটি বহুতল পার্কিং ভবন গড়ে তোলা হলেও সেগুলোর কার্যকর ব্যবহার নেই। রাজধানীতে যেভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে তাতে আগামী ১০/১৫ বছর পর ঢাকার মূল সড়কের সমান জায়গা লাগবে শুধু গাড়ি পার্কিংয়ে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি ব্যক্তিগত গাড়ি রেজিস্ট্রেশন পাচ্ছে। ফলে ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি পার্কিং এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সরকারকে প্যাটারনস্টার পার্কিংয়ের দিকে মনোযোগ দিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। এটা অনেকটা নাগরদোলার মতো। তাদের মতে, ঢাকায় যেহেতু জায়গা কম, তাই এ পদ্ধতি শহরের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী হবে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান জানান, সাধারণত দুটি গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য যে জায়গা লাগে, প্যাটারনস্টার পদ্ধতিতে একসঙ্গে সেই জায়গাতেই ১৮ থেকে ২০টি গাড়ি পার্ক করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, এ পদ্ধতিতে খরচ কম। তিন থেকে পাঁচ দিনে এটি তৈরি করা সম্ভব। এখানে চালককে পার্কিং লটে থাকতে হয় না বা তাকে ঘুরে ঘুরে পার্কিংয়ের জায়গাও খুঁজতে হয় না। স্টিল কাঠামো দিয়ে তৈরির ফলে এই পার্কিং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুততম সময়ে সরিয়ে নেওয়া যায়। আমাদের সেদিকেই যেতে হবে।

সর্বশেষ খবর