মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

নষ্ট সিগন্যাল বেসামাল যানজট

সড়কে গাড়ির চাপে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে

জয়শ্রী ভাদুড়ী

নষ্ট সিগন্যাল বেসামাল যানজট

দুর্বল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাপনা, বেহাল রাস্তা ও ফুটপাত এবং নিয়ন্ত্রণহীন পার্কিংয়ে রাজধানীতে দুর্বিষহ যানজট। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাস্তবায়নে গত দুই দশকে অপচয় ১৫০ কোটি টাকা। গতকাল কাকরাইল মোড় থেকে তোলা ছবি : রোহেত রাজীব

যানজট পিছু ছাড়ছে না ঢাকাবাসীর। রাজধানীর যানজট নিরসন ও নাগরিক দুর্ভোগ লাঘবে একে একে ছয়টি ফ্লাইওভার এবং দুটি ওভারপাস তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু যানজটের কোনো সুরাহা হয়নি। ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। অবকাঠামো সুবিধা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি। একই সঙ্গে বাড়ছে যানজট। সড়কে গাড়ির চাপে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের নামে কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। কিন্তু হাতের ইশারাতেই চলছে রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। ফলে নানা কাজে রাস্তায় বেরিয়ে কে কখন গন্তব্যে পৌঁছানো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে দেশের আনুমানিক ৫৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবাস্তব প্রকল্প এবং রাস্তার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত নতুন যানবাহনের অনুমতি দেওয়াকে দায়ী করেছেন।

রাস্তার বেহাল দশা, দুর্বল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাপনা, বেহাল ফুটপাত এবং নিয়ন্ত্রণহীন রিকশা এই যানজট পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে। অনেক ক্ষেত্রে, যানবাহনের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং রাস্তার অবস্থা বিবেচনা না করেই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। রাজধানীতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাস্তবায়নে গত দুই দশকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা অপচয় করা হয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক ব্যবস্থায় কোনো শৃঙ্খলা ফিরেনি। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এখন ক্লান্ত। যানবাহন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পর্যায়ে চলে গেছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট না বাড়িয়ে ব্যক্তিগত গাড়ির বিস্তারের কারণে নগরীর অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যালের নামে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু উচ্চাভিলাষী প্রকল্প নেওয়া হয়। সিগন্যাল লাইট ডিজিটালকরণ এবং কিছু ব্যস্ততম মোড়ে টাইমার কাউন্টডাউন ও ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন এবং রিমোটের মাধ্যমে সিগন্যাল বাতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু কোনো পরিকল্পনায় কাজ হয়নি।

এই অব্যবস্থাপনার মধ্যেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৫৩ ইন্টারসেকশনে আর্টিফিশিয়াল ট্রাফিক সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগে ডিএসসিসি নগর ভবনে কন্ট্রোল রুম থাকবে। কন্ট্রোল রুম থেকে ট্রাফিক সিগন্যাল মনিটরিং করা হবে। এ ছাড়া প্রতিটি সিগন্যালে সার্ভার থাকবে, যে সার্ভার সড়কের কোন পাশে গাড়ির চাপ বেশি সেটা অটো নিয়ন্ত্রণ করবে। সে অনুযায়ী লাল ও সবুজ সিগন্যাল দেবে। এ বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণে খুব শিগগির আর্টিফিশিয়াল ট্রাফিক সিস্টেম প্রকল্প নেওয়া হবে। আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। পরামর্শক সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিলে যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প তৈরি করা হবে। মূলত ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে ট্রাফিক বিভাগ। তাদের সম্পৃক্ত করেই যে কোনো প্রকল্প নিতে হবে। সিটি করপোরেশন পৃথকভাবে কোনো প্রকল্প নিলে সেটার সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ঢাকা শহরকে সচল করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা নিজেদের মতো করে প্রকল্প নিয়েছে। কিন্তু কোনোটি সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ, তারা নিজেদের স্বার্থে প্রকল্পগুলো নিয়েছে। অথচ কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) ২০০৫ সালে এবং সংশোধন হয়েছে ২০১৫ সালে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এই এসটিপির পরিকল্পনা যদি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা যেত তাহলে ঢাকা শহরের আজ এ অবস্থা হতো না। তিনি আরও বলেন, আমরা রাস্তার ধারণক্ষমতা বিবেচনা না করেই নতুন নতুন যানবাহন চলাচলের অনুমতি দিচ্ছি। যানবাহনের চাপে কোনো সিগন্যাল সিস্টেমই কাজ করবে না। আমাদের আগে রাস্তার ধারণক্ষমতা এবং যানবাহনের সংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখার কথা ভাবতে হবে।

সর্বশেষ খবর