মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও হাসান ইমন

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু

গত ২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি এখন দেশের হাসপাতালে। ওয়ার্ডে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা। প্রথম ছবিটি মিটফোর্ড হাসপাতালের। ডানে শিশু হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় মশারি টাঙিয়ে রাত কাটান রোগীর স্বজনরা ছবি : আবু তাহের খোকন

মৌসুম শেষে রাজধানীজুড়ে তান্ডব ছড়াচ্ছে ডেঙ্গুজ্বর। ২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। ভাইরাসের বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযান, বিশেষ কর্মসূচিসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। বহুতল ভবনের ছাদের মশক পরিস্থিতি দেখতে ড্রোন উড়ানোর মতো অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কাজে আসছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগই।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এবার বছরজুড়েই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম মূলত মশক নিধন কর্মীর ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে কথাবার্তা হওয়ার পর বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজন কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ দিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু তা মোটেই পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগের জীবাণু বহনকারী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে না পারলে মশা নিয়ন্ত্রণ আদৌ সম্ভব নয়।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় হাজার খানেক রোগী ভর্তি হয় সারা দেশের হাসপাতালে। এর প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ রোগী ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি হয়। অক্টোবরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২২ হাজার মানুষ, মারা গেছে ৮৬ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ। মারা গেছে ১৪১ জন। সাধারণত ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ দেখা যায় এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু দেশে ২০০০ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পরে এবারই সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে অক্টোবরে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সূত্রে জানা যায়, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ মশক অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযানে বাসাবাড়িতে লার্ভা বা মশা জমার উপযুক্ত পরিবেশ থাকলে মামলা দায়ের করে জরিমানা আদায় করছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। নভেম্বরে মাসব্যাপী ডিএনসিসি বিশেষ অভিযান ঘোষণা করেছে। বহুতল ভবনের ছাদবাগানে মশার উৎসস্থল খুঁজে বের করতে ড্রোন উড়িয়েছে ডিএনসিসি। কিন্তু সব উদ্যোগ ব্যর্থ করে মশার কামড়ে বাড়ছে রোগী।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘অসময়ে ঝড়বৃষ্টির ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। ১ নভেম্বর থেকে ডিএনসিসির প্রতিটি ওয়ার্ডে ৩০ দিনের বিশেষ মশা নিধন কর্মসূচি পরিচালনা করা হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরবৃন্দ, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাবৃন্দ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা মাঠে থাকবেন। পুরো মাসজুড়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে মশা নিধনে কাজ করবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এডিস মশার লার্ভার উৎস পেলে কাউন্সিলররা ছবি তুলে স্থান উল্লেখ করে ডিএনসিসির অফিশিয়াল হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপে শেয়ার করবে। ছবি ও লোকেশন দেখে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা  নেবে।’

ডিএসসিসি এডিস মশা নির্মূলে গত দুই সপ্তাহে ১৫টি ওয়ার্ডে বিশেষ চিরুনি অভিযান পরিচালনা করেছে। চলতি সপ্তাহেও ছয়টি ওয়ার্ডে বিশেষ চিরুনি অভিযান চলবে। এ ছাড়া গত চার মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়েছে। এ সময়ে ১৬৭টি বাড়ি, স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ১৬৩টি মামলায় ১২ লাখ ২১ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মশার লার্ভা পাওয়ায় এক ব্যক্তিকে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপে হিমশিম অবস্থা।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরিপে আমাদের যে কয়টি ওয়ার্ড ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলোতে টানা তিন সপ্তাহ ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চলছে। ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর এই সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আশা করি, চলতি সপ্তাহের শেষ দিকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমে যাবে। নভেম্বরের মাঝামাঝি ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘আগস্টে ডেঙ্গু রোগী কম থাকায় দুই সিটির কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে এসেছিল। তারা ভেবেছিল, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে গেছে। কিন্তু থেমে থেমে বৃষ্টি পরিস্থিতি পরিবর্তন করে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা হটস্পট ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়েছি। যে কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। যেখান থেকে ডেঙ্গু রোগী বেশি আসে, সেখানে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে মশক নিধন কর্মসূচি পরিচালনা করতে হয়। তাহলে এক রোগী থেকে অন্য রোগী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। আশা করছি নভেম্বরে কমে আসবে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর