বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা
২৫ বছরে গ্রামীণফোন

গ্রাহকরাই আমাদের এগিয়ে রাখবে

ইয়াসির আজমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, গ্রামীণফোন

সাইফ ইমন

গ্রাহকরাই আমাদের এগিয়ে রাখবে

গ্রামীণফোনের সিইও হিসেবে আপনার কাছে প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির হিসাবটা কেমন?

গ্রামীণফোনের সব কর্মীর জন্য গ্রাহকদের চাহিদা পূরণে কাজ করতে পারাটা অনেক সম্মান ও দায়িত্বের। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি ভবিষ্যৎ উপযোগী করে আমাদের নেটওয়ার্ককে ঢেলে সাজাতে। এ কাজটি কভিডের কারণে কিছুটা কঠিন হলেও ত্বরান্বিত হয়েছে বহুগুণে, যার সুফল আমাদের গ্রাহকরা ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছেন। আর দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে বলতে পারি বাংলাদেশ এখন দুর্বার, অদম্য। এত বড় মহামারি আমরা শক্তভাবে মোকাবিলা করে চলেছি। আরও অনেকের মতো আমরা প্রযুক্তিসেবা আর সহমর্মিতা নিয়ে মানুষের পাশে থাকতে পেরেছি। আমার সহকর্মীরা কখনো হাল ছাড়েননি, এ ক্ষেত্রে ব্র্যাকের সঙ্গে আমাদের যৌথ উদ্যোগে ‘ডাকছে আমার দেশের’ কথা না বললেই নয়; একই সঙ্গে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের দিক-নির্দেশনা পেয়ে একসঙ্গে কাজ করছি। এই কঠিন সময়েও বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে এবং শক্ত ভিত্তির অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে; এ সময়েই আমরা সারা দেশে ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছি। বাংলাদেশের ৫০ আর গ্রামীণফোনের ২৫ বছর পূর্তিতে, এ অনেক বড় পাওয়া।

 

একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, গ্রাহক বিবেচনায় গ্রামীণফোন এগিয়ে থাকে এটি কেন? মার্কেটিং না অন্য কিছু এর পেছনে ভূমিকা রাখছে?

আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো দেশজুড়ে গ্রাহকদের আস্থা। গত ২৫ বছরে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে গেছি শহর আর গ্রামের মানুষের মাঝে যে ডিজিটাল ডিভাইড আছে তা কমিয়ে আনতে। এর সঙ্গে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী নিত্যনতুন উদ্ভাবনী সেবা দেওয়ার মাধ্যমেই আমরা মানুষের আস্থা অর্জন করেছি, ৮ কোটির পরিবারে পরিণত হয়েছি। আর পথ চলাতে গ্রাহকের চাহিদা, তাঁদের আবেগ এমনকি সমালোচনা আমাদেরকে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে, আরও ভালো করতে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

টেলিযোগাযোগ খাতে হাজারো সমস্যার মাঝেও আমরা প্রতিদিন আমাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছি, সেবার মান বৃদ্ধি করছি এবং নিত্যনতুন ডিজিটাল সেবা নিয়ে গ্রাহকদের পাশে রয়েছি।

 

ইতোমধ্যে সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। আমরা সেখানে আমাদের মতামত দিচ্ছি। কারণ ফাইভজি প্রযুক্তি থ্রিজি বা ফোরজির মতো নয়।  সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে যতটা তার চেয়ে বেশি এটি মূলত শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে।  তাই এর ব্যবহারিক দিক বিবেচনা করলে আমাদের দেশে এ প্রযুক্তির এসব ক্ষেত্রে সীমিত ব্যবহার প্রত্যাশা করছি

 

আপনারা সম্প্রতি স্পেকট্রাম কিনেছেন কিন্তু গ্রাহক ভোগান্তির কথা সেবার মান বারবার ঘুরেফিরে আসছে কেন?

২০২১ সালে সর্বশেষ নিলামে আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ ১০.৪ মেগাহার্টজ তরঙ্গ রেকর্ড মূল্যে কিনেছি। কিন্তু শুধু স্পেকট্রাম কিনলেই তো হবে না। স্পেকট্রাম সবার কাছে পৌঁছে দিতে লাগবে টাওয়ার। যদিও আমাদের ১৮ হাজার ৬০০ টাওয়ার আছে; তার পরও আমাদের টাওয়ার দরকার। আপনারা জানেন আমরা নিজেরা টাওয়ার নির্মাণ করতে পারি না, এখানে আমাদের টাওয়ার নির্মাণ কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। যেটি কিছুটা হলেও আমাদের কাজের গতিকে কমিয়ে দিচ্ছে। আবার ঢাকা পৃথিবীর সব থেকে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের প্রয়োজন মতো টাওয়ার দিতে পারছে না টাওয়ার কোম্পানিগুলো। টাওয়ারগুলোতে ফাইবার কানেক্টিভিটি সেবার মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। যেটি আমাদের দেশে অনেক কম, মাত্র ১৭%। এই ফাইবারের জন্যও আমাদেরকে নির্ভর করতে হয় ফাইবার কোম্পানিগুলোর ওপর। এত সীমাবদ্ধতার মাঝেও সম্প্রতি ঢাকা, খুলনা ও বরিশালে আমাদের সেবার মান বেড়েছে।

 

ইন্টারনেট স্পিড নিয়েও বেশ আলোচনা হচ্ছে, বৈশ্বিক কোনো মানদণ্ডেই গ্রামীণফোন ভালো অবস্থানে নেই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আমি এটির সঙ্গে একমত হতে পারছি না। স্মার্টফোনে আমাদের ভিডিও দেখা, ব্রাউজ করা, গেমস খেলা মিটিং করার জন্য ২-৩ মেগাবাইট অনেক ভালো স্পিড। আপনি সব করতে পারবেন। তার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ৭ মেগাবাইট স্পিড দেওয়ার চেষ্টা করছি। এশিয়া বা ইউরোপে ২-৩ এমবিপিএসের বেশি সর্বনিম্ন ডাউনলোড স্পিড বেঁধে দেওয়া হয় না। আমরা একটি সমীক্ষা থেকে দেখছি ২০১৬ সালের তুলনায় ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ১২ গুণ আর আমাদের রেভিনিউ ২.৭ গুণ। বোঝাই যাচ্ছে এই খাতে আমাদের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এর থেকে বেশি স্পিড দিলে ইন্টারনেট গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। ফোরজি ডিভাইস মাত্র ৩৬% আর এখনো বেশির ভাগ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসেনি। আমাদের এখানে করপোরেট ট্যাক্সও অনেক বেশি প্রায় ৪০-৪২%। এটিও পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এবার যদি আপনার প্রশ্নের প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যা দিতে চাই, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে কীভাবে মোবাইল সেবা গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছায়। এখানে নানা পর্যায়ে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি মোবাইল সেবার মান আইআইজি, আইসিএক্স, আইজিডব্লিউ, টাওয়ার পরিচালনার ওপরও নির্ভর করে। আমাদের দেশে কিন্তু এগুলোর জন্য আলাদা লাইসেন্স দেওয়া আছে। আমরা মনে করি, সবাই যদি সবার অবস্থান থেকে সেবার মান রক্ষা করে এবং প্রয়োজনীয় সেবা ও মান নিশ্চিত করে তবেই মোবাইল সেবায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে যাব। তবে এসব সমস্যাকে আমলে নিয়েই আমরা কাজ করে চলেছি।

 

বেশ কিছুদিন ধরেই ফাইভজি নিয়ে আলোচনা চলছে বাংলাদেশে ফাইভজির বিষয়টিকে আপনারা কীভাবে দেখছেন?

কয়েক বছর ধরে আমরা আমাদের কোর নেটওয়ার্কের আধুনিকায়নে ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছি। ফাইভজির প্রস্তুতির এটি একটি বিশাল কাজ। সারা দেশে সব টাওয়ার ইতোমধ্যে ফোরজি করাও আমাদের ফাইভজি প্রস্তুতির একটি অংশ। ফাইভজি চালু হওয়ার পরে গ্রাহক পর্যায়ে ফোরজির চাহিদা থাকবে। এখানে আমরা এগিয়ে আছি। ইতোমধ্যে সরকার আমাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। আমরা সেখানে আমাদের মতামত দিচ্ছি। কারণ ফাইভজি প্রযুক্তি থ্রিজি বা ফোরজির মতো নয়। সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে যতটা তার চেয়ে বেশি এটি মূলত শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে। তাই এর ব্যবহারিক দিক বিবেচনা করলে আমাদের দেশে এ প্রযুক্তির এসব ক্ষেত্রে সীমিত ব্যবহার প্রত্যাশা করছি। টুজি, থ্রিজি বা ফোরজির মতো এটির কাভারেজ প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। বরং যেখানে প্রয়োজন সেখানে ব্যবহার করা উচিত।

 

২০২২ সালে গ্রামীণফোনের লক্ষ্য কী?

আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে, গ্রাহকের ফোরজি ইন্টারনেট সেবার অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করা ও সেবার মান উন্নয়ন করা, যার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, ছোট ও মাঝারি ব্যবসাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারব। একই সঙ্গে আমাদের পার্টনারশিপের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল সেবা চালু করার লক্ষ্যও রয়েছে। ফাইভজি যুগে পার্টনারশিপ ও অ্যানালিটিকসের মাধ্যমে কানেক্টিভিটি ও সল্যুশনই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই এ ইকোসিস্টেম প্রস্তুত করতে আমরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। ইন্টারনেট বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষমতায়নের অনেক বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট হাতে থাকলে যে কেউ তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে ব্যবসায়িক বা সামাজিক সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে পারে। আমাদের তরুণরা ইতোমধ্যে এসব কাজ করে দেখিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, ইন্টারনেটভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আমরা শুধু প্রবেশই করিনি বরং অনেক দূর এগিয়ে গেছি। শুরুর দিকে নানা ধরনের প্রশ্ন, উন্নয়নের সুযোগ থাকবে এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের দায়িত্ব অনেক। বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশে আর ডিজিটাল অর্থনীতির দেশ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আমি মনে করি, সবাই মিলে কাজ করলে ২০৪১ সালে ডিজিটাল অর্থনীতিনির্ভর উন্নত বাংলাদেশে পরিণত হওয়া খুবই সম্ভব। আমরা সেখানে আরও অবদান রাখতে চাই। নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবার ওপর আমরা ২০২২ সালে গুরুত্বারোপ করব। ডিজিটাল বাংলাদেশের কানেক্টিভিটি পার্টনার হিসেবে দেশের মানুষের সম্ভাবনা উন্মোচনের মাধ্যমে সমাজের ক্ষমতায়নে একই রকম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবে গ্রামীণফোন।

 

সর্বশেষ খবর