বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বহির্বিশ্ব এখন অর্থনীতির নতুন বাংলাদেশকে চেনে

সাক্ষাৎকারে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন

রুহুল আমিন রাসেল, আবুধাবি থেকে ফিরে

বহির্বিশ্ব এখন অর্থনীতির নতুন বাংলাদেশকে চেনে

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক নতুন বাংলাদেশকে তুলে ধরছে। বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়ন, অবকাঠামো, বিনিয়োগের পরিবেশসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তুলে ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোড শোয়ের আয়োজন করেছে।

এক বছর ধরে এই রোড শো করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। যা আরও কয়েকটি দেশে করার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব দেশের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান করা হয়েছে। রোড শোয়ের পর বিনিয়োগের জন্য ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশের উদ্যোক্তারা আসছেন বাংলাদেশে। সম্প্রতি এমন একটি বিনিয়োগ রোড শো ছিল দুবাইয়ে।

বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশের দেশ- এটি তুলে ধরার মূল কারিগর বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। ২০২০ সালের মে মাসে বিএসইসির চেয়াম্যানের দায়িত্ব নেন করোনা মহামারির কঠিন পরিস্থিতির মুখে। দায়িত্ব নেওয়ার পর একটি স্থিতিশীল শেয়ারবাজার গড়তে নানা পদক্ষেপ নেন।

শুধু শেয়ারবাজার নয়, দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ নিরাপত্তার পরিবেশ, আর্থিক কাঠামো খাতে সংস্কারে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। দুবাইয়ে বসে এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা চলছে। যার প্রভাব আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়েছে। এই নেতিবাচক প্রচারণার কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশে কম এসেছে। এই প্রচারণা কাটাতে বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরতে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। এসব পদক্ষেপ বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশের বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন করে তুলে ধরছে বাংলাদেশকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ও হেয় করে বিভিন্ন সময় অনেক মাধ্যমে অপপ্রচার হয়েছে। সেটা থেকে বের হওয়া, ভুল ধারণা দূর করার জন্য আমাদের এই পদক্ষেপ। ব্যবসায় সম্প্রসারণ, নেটওয়ার্কিং, বাংলাদেশের সঠিক অর্থনীতি ও সামাজিক অর্থনীতির তথ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ জানে না এই তথ্যগুলো। যা করেছি তাতে তারা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে। তারা এখন নুতন চমক হিসেবে বাংলাদেশকে চেনে ও জানার চেষ্টা করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ১২/১৩ বছর কী করেছেন এই তথ্যগুলো আমরা দিচ্ছি।

শেয়ারবাজারে বা আর্থিক কাঠামোর ক্ষেত্রে সুশাসন ইস্যুটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই সুশাসন নিশ্চিত করতে। আমরা চাই না সব কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসুক। সুশাসন আছে এবং সাসটেইন্যাবল এমন কোম্পানি বাজারে আসুক। আমরা চাই এমন কোম্পানি আসুক যে কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদে মানুষকে মুনাফা দিতে পারবে।  তাদের বিনিয়োগের রাইট রিটার্ন দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। এই গুণসম্পন্ন কোম্পানি বাজারে আনতে চাই

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, পুঁজিবাজারে গুজব আছে। এই গুজব রোধে আইনকানুন তৈরি হয়েছে। আমরা নিয়মিত বিভিন্ন খাতের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ যেমন বিটিআরসি, ল-ইনফোর্সিং এজেন্সির সাহায্য নিচ্ছি। যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাংলাদেশ সম্পর্কে বা বাজার সম্পর্কে বিভিন্নভাবে মিথ্যা প্রচার করে বিব্রত করে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন লেখালেখি করে বাজার প্রভাবিত করে, তাদের বিষয়ে কাজ করছি। আইনের সাহায্যে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আমরা নিয়মিত সার্ভিল্যান্স করে থাকি। বাজারে আস্থার সংকট বলে একটি কথা শোনা যায়। কিন্তু আস্থা ব্যাপারটা বা বিষয়টি কী? বা এর পরিমাপক কী? পুঁজিবাজারে বেচা-কেনা করে শেয়ারের মালিকরা। কে কবে কোনটা বেশি কিনবে, বেশি বিক্রি করবে তা আমরা জানি না। আমরা তো সেটা রেগুলেট করতে পারি না। বেশি বিক্রি করলে ইনডেক্স কমে যায়, বেশি ক্রয় করলে ইনডেক্স বেড়ে যায়। আমরা কোনো অ্যাবনরমালিটি থাকলে সেটা দেখি এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই।

করোনা মহামারির সময় বাজার একটি সংকটময় সময় পার করেছে। সে সময় কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। বর্তমান যুদ্ধের কারণেও কিছু প্রভাব পড়েছে। সেজন্য আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি। স্বাভাবিক হলে ইনশা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারে বা আর্থিক কাঠামোর ক্ষেত্রে সুশাসন ইস্যুটা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা চাই সুশাসন নিশ্চিত করতে। আমরা চাই না সব কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসুক। সুশাসন আছে এবং সাসটেইন্যাবল এমন কোম্পানি বাজারে আসুক। আমরা চাই এমন কোম্পানি আসুক যে কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদে মানুষকে মুনাফা দিতে পারবে। তাদের বিনিয়োগের রাইট রিটার্ন দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। এই গুণসম্পন্ন কোম্পানি বাজারে আনতে চাই। এ বছর ভালো ও বড় কোম্পানি বাজারে আসবে।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, যুদ্ধের কারণে কিছু সমস্যা আমরা দেখছি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আমাদের দেশে জ্বালানির দর বেড়েছে। তেলের ওপর আমাদের সেচ নির্ভরশীল, তাছাড়া উৎপাদন ও সাপ্লাই চেইনে প্রভাব পড়বে। পুরো যাতায়াত ব্যবস্থা তেলের ওপর নির্ভরশীল। তাই এই যুদ্ধের প্রভাবে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, মূল্যস্ফীতি হবে। বিভিন্ন কোম্পানির মুনাফা কমে আসবে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ যা আমাদের সামনের দিনে মোকাবিলা করতে হবে। অন্যান্য চ্যালেঞ্জ যা আছে সেটা বৈশ্বিক সমস্যার কারণে। সেগুলো মোকাবিলা করার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে।

শিবলী রুবাইয়াত বলেন, এখন পুঁজিবাজার প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরতে প্রস্তুত। আমাদের বাজারে নতুন পণ্য, নতুন বন্ড, সুকুকবন্ড, মুনিবন্ড, অবকাঠামোবন্ড, গ্রিনবন্ড, আসছে। এসব জায়গায় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। আমাদের পুঁজিবাজার এখন বিনিয়োগের অন্যতম একটি ক্ষেত্র। আমাদের একটি ভালো ইকুইটি মার্কেট রয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের বন্ড মার্কেট এখন খুব ভালো করছে। এ ছাড়া আমরা গত ১ বছর ২ মাসে ৬০ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছি। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে এখন প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে এখানে বিনিয়োগ করেছে। তারা তাদের নিটা অ্যাকাউন্ট (অনাবাসী বিনিয়োগকারীদের টাকা অ্যাকাউন্ট) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগ করছে। বিনিয়োগকৃত অর্থ তাদেরকে মুনাফা দিচ্ছে। গত ৩০ বছরে আমাদের পুঁজিবাজার অনেক বড় হয়েছে। এটা আরও এগিয়ে যাচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে আমাদের দেশেও আন্তর্জাতিক ইস্যু তৈরি হয়েছে। কিন্তু সারা বিশ্বের এই অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আমাদের পুঁজিবাজারকে কমবেশি স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমরা আশাবাদী যে, বাংলাদেশ খুব দ্রুত ফ্রন্টিয়ার মার্কেট থেকে ইমেজিং মার্কেটে চলে যাবে। আর এটাই আমাদের লক্ষ্য।

বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, বিনিয়োগকারীদের দাবি মেটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিনিয়োগকারীরা হয়তো অনেক বছর জানতেন না তাদের পাওনা লভ্যাংশ বা স্টকের বিষয়ে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের সেই পাওনা টাকা কোথায় আছে তা তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগ নিয়েছি। আজকে এই টাকা পাওয়ার মাধ্যমে তাদের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব আসবে। এই বাজারে বিনিয়োগ করলে যে রিটার্ন পাওয়া যায় সেটা প্রমাণ হবে। এ ছাড়াও তাদের পাওনা আদায় করে দেওয়ার জন্য যে রেগুলেটর আছে, সেটা সব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করবে।

তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকার লভ্যাংশ জমে থাকার বিষয়টি যখন আমরা তুলে নিয়ে আসলাম, তখন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ওই লভ্যাংশের পাওনাদার বিনিয়োগকারীদের খুঁজে পাচ্ছে। আমাদের উদ্যোগের ফলে যদি বিনিয়োগকারীরা তাদের পাওনা ফেরত পায়, সেটাও ভালো। তবে এখনো কিছু কোম্পানি থেকে অবণ্টিত লভ্যাংশের হিসাব নেই বলে কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছে। আমরা মার্চের পর কঠোর হব। এখনো জরিমানা করা শুরু করিনি, তবে শিগগিরই কমিশন পদক্ষেপ নেবে। আমরা অনেক সময় দিয়েছি এবং অপেক্ষা করেছি। চলতি মাসের পরে আর সময় দেওয়া হবে না।

শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আসার পর থেকে জমা হওয়া অবণ্টিত লভ্যাংশ কোথায় রাখা হয়েছে বা কোথায় ব্যবহার করা হয়েছে, নাকি কেউ নিয়ে গেছে, তা খুঁজে বের করা হবে। এই অর্থ খুঁজে বের করতে আন্তর্জাতিকমানের নিরীক্ষক দিয়ে নিরীক্ষা করা হবে। এর মাধ্যমে ওই টাকা কোথায় গেছে, তা খুঁজে বের করব। যে টাকা নিজের নয়, তা আপনারা (কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট) ব্যবহার করলেন কেন? তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ বা যে কোনো কারণ হোক, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজার নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তবে আমরা স্ট্র্যাটেজিক ও ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সেই সংকট কাটিয়ে উঠেছি। এ ক্ষেত্রে স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমরা যে উদ্দেশ্যে এই ফান্ড গঠন করেছিলাম, সেটা সত্যিই কাজে লাগছে।

সর্বশেষ খবর