শনিবার, ২২ জুন, ২০১৩ ০০:০০ টা

মোঘল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম (ষষ্ঠ পর্ব)

মোঘল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম (ষষ্ঠ পর্ব)

অত্যন্ত ধীরলয়ে শাহেনশাহ জাহাঙ্গীর দরবারে ঢুকলেন। উপস্থিত সভাসদ, বিদেশি রাষ্ট্রদূত, সাম্রাজ্যের প্রধান কাজী বা কাজী-উল কুজ্জাত ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীরা ছিলেন_ সবাই ওঠে দাঁড়িয়ে মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন। সম্রাট তার সিংহাসনে বসলেন। তার রুদ্রমূর্তি এবং যুদ্ধাবস্থার পোশাক দেখে উপস্থিত লোকজন ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল। এমনকি দরবারের দীর্ঘদিনের নকীব, যিনি কিনা সম্রাটের আগমন বার্তা ঘোষণা করেন। তিনিও আজ হতবিহ্বল। ঘোষণা দিতে গিয়ে গলার স্বর বার বার কেঁপে উঠছিল। সম্রাট কোনো ভূমিকা না রেখে হুকুম করলেন, ইলিয়াস খানকে দরবারে হাজির করা হোক। শৃঙ্খলবদ্ধ ইলিয়াস খানকে উপস্থিত করা হলে সম্রাট ওঠে দাঁড়ালেন এবং সিংহাসন থেকে নেমে তার মুখোমুখি হয়ে হুকুম করলেন_ বল ইলিয়াস খান, কী হয়েছিল সেদিন? একটি শব্দও বাদ দেবে না এবং কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা করবে না। আমি জানতে চাই, আনারকলির সঙ্গে তুমি কোনো অশালীন আচরণ করেছিলে এবং কিভাবে সেই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।

তোমার দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে আনারকলি কী বলেছিল এবং ক িকরেছিল। কেন তুমি আনারকলিকে উজিরে আজম আবুল ফজলের হাতে তুলেছিলে! এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পর সম্রাট পুনরায় সিংহাসনে আসীন হলেন। রাগ, অভিমান এবং ক্রোধে তার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছিল_

সম্রাটের হুকুম পাওয়ার পর ইলিয়াস খান নির্বিকার চিত্তে শুরু করলেন তার বক্তব্য। মান্যবর শাহেনশাহ এ কথা আমি আমৃত্যু বলে যাব যে, রাস্তা থেকে আপনি আমাকে তুলে এনেছিলেন দ্বীনহীন অবস্থায়। আপনার শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের কারণে আপনার অবারিত করুণা ও দয়া আমি পেয়ে এসেছিলাম শর্তহীনভাবে কোনো কারণ ছাড়াই। আপনার মানবিকতা, ঔদার্য এবং রাজসিক সরলতার কারণে কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মোগল বাহিনীতে চাকরির সুযোগ পেয়েছিলাম। পদোন্নতি তো দূরের কথা, চাকরি করার সাধারণ যোগ্যতাও আমার ছিল না। আমি নিজের দুর্বলতা ঢেকে রাখার জন্য সর্বদা বিকল্প পথে আপনার মনতুষ্টির চেষ্টায় রত থাকতাম। তোষামোদি এবং আপনার পছন্দের উপকরণসমূহের সর্বোত্তম সরবরাহ করে আমি আপনাকে রাজি-খুশির মাধ্যমে দ্রুত পদোন্নতি লাভ এবং আর্থিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টায়রত থাকতাম। আমার বহুমুখী শয়তানি প্রতিভা দ্বারা আমি আপনার সন্তুষ্টি এবং বিশ্বস্ততা অর্জন করি অতি দ্রুততার সঙ্গে। আপনিও আমাকে সব সময় কাছে পেতে চাইতেন। আমার প্রতি আপনার এই অবারিত দয়াকে আমি পুরোপুরি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। ফলে আমি কোনো যুদ্ধ না করেও হয়ে গেলাম যুদ্ধজয়ী সৈনিক। আবার সাধারণ সৈনিকের কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও হয়ে গেলাম মহান সেনাপতি। আপনি অচিরেই আমাকে পাঁচ হাজারি মসনদদার পদে পদোন্নতি দিয়ে জায়গির প্রদান করলেন।

আমি আমার দুর্বলতাসমূহ খুব ভালোভাবেই জানতাম। আমার সব সময় ভয় হতো এই ভেবে যে, আপনি যদি আমাকে কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের দায়িত্ব দেন, তাহলে আমার মৃত্যু ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। অধিকন্তু আমার অধীনস্থ পাঁচ হাজার সৈনিকের মৃত্যু অবধারিত। কারণ যুদ্ধ করার কোনো কৌশলই আমি রপ্ত করিনি। আমার সৈনিকরাও অনেকটা আমার মতো ছিল। আমার দুর্বল মেধা, স্বার্থপর মন এবং ব্যক্তিত্বহীন চরিত্রের কদর্য গুণাবলি দিয়ে আমি তাদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করিয়েছিলাম। ফলে তারা কোনো কাজ না করে একে অপরের বিরুদ্ধে লেগে থাকত এবং ঊধর্্বতন কর্মকর্তাদের তেল মারত। আমি তাদের বহুরূপী তেলে সিক্ত হয়ে ভাবতে শুরু করলাম কী করে সালতানাতে মোগলের প্রধান সেনাপতি হওয়া যায়। আমি যে পরিবার থেকে এসেছি সেখান থেকে ভালো কিছুই রপ্ত করতে পারিনি। আমার পরিবারটি ছিল খুবই নীচু জাতের। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ, স্বার্থপরতা, অলসতা এবং অজ্ঞানতা ছিল আমাদের অলঙ্কার। আবার এসব অলঙ্কার নিয়ে আমরা ভয়ানক অহংকার করলাম। কাউকে বিশ্বাস করা কিংবা কারও বিশ্বাসের মর্যাদা দেওয়ার মতো চারিত্রিক যোগ্যতা আমাদের কারও ছিল না। এমন একটি পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণে আপনার অনুগ্রহে প্রাপ্ত পদ ও পদবি আমি ব্যবহার করতে থাকলাম নিজের মতো করে। যতটুকু সময় আমি আপনার সম্মুখে থাকতাম ততক্ষণ প্রাণান্ত চেষ্টা করতাম নিজের আভিজাত্য ও পাণ্ডিত্য প্রকাশের অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন সহকর্মী বা অধস্তনের কাছে আসতাম তখন আমার চরিত্রের দুর্গন্ধময় ও কদর্য দিকগুলো বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু কেউই ঝুঁকি নিয়ে এসব বিষয় আপনাকে বলত না। কেননা তারা জানত যে, আপনি আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন এবং বিশ্বাস করেন। আপনার এই আকুণ্ঠ সমর্থন ও আশকারা পেয়ে আমি দিনকে দিন মহা অত্যাচারী, দুর্নীতিবাজ, স্বার্থপর এবং লোভী হয়ে উঠি। আমার অপরাধের মাত্রা ভয়ঙ্করভাবে বাড়তে থাকে। এগুলোকে ছাইচাপা দেওয়ার জন্য এবং আমার বিরুদ্ধে কেউ যাতে আপনার কাছে নালিশ করতে না পারে সে জন্য আপনার মনতুষ্টির নিত্য-নতুন উপকরণ খুঁজতে থাকে। আপনার দুর্বল থেকে দুর্বলতম জায়গার খোঁজে দিবানিশি গবেষণা করতে থাকি। আর দরবারের কিছু লোককে নিয়মিত তোহফা দিতে থাকি, যাতে করে তারা সর্বদা আমার ব্যাপারে আপনার কাছে প্রশংসা চালিয়ে যায়।

এভাবেই চলছিল সবকিছু_ আর আমার সৌভাগ্যের ধ্রুবতারা আমাকে দিনকে দিন লোভী থেকে আরও লোভী বানিয়ে ফেলছিল। আপনার উদার প্রেমিক মনের জন্য সুন্দরী নারীই যে সর্বোত্তম উপহার সেটা আমি বিলক্ষণ জানতাম। মনে-প্রাণে এমন এক নারীকে খুঁজছিলাম যাকে পেলে আপনি সবকিছু ভুলে যাবেন এবং যার প্রেমে অন্ধ হয়ে আমার প্রতি আপনার করুণাকে আরও অবারিত করবেন। অবশেষে আমার সেই সুযোগ এলো। মোগল হেরেমের অসাধারণ সুন্দরী আনারকলিকে আমি প্রথম দেখি তার ভাই সাইফ খানের মাধ্যমে। আনারকলিকে দেখার পর আমি তার প্রেমে অন্ধ হয়ে যাই। একনাগাড়ে কয়েক রাত না ঘুমিয়ে কাটাই। তার প্রেমে সারা দুনিয়া আমার কাছে মোহনীয় হয়ে ওঠে। আকাশের চাঁদের দিকে তাকালে মনে হতো, আনারকলি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাসে আমি স্পষ্টতই তার ঘ্রাণ পেতাম। প্রকৃতিতে কোনো পাখি ডাকলে আমি তাতে আনারকলির কণ্ঠস্বর শুনতে পেতাম। আমার কাছে মনে হতে লাগল, তাবৎ পৃথিবীর বিনিময়ে হলেও আমি আনারকলিকে পেতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় মানব আকাঙ্ক্ষাকে যথাসাধ্য গোপন করে আমি আনারকলির ভাই সাইফ খানের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি।

আনারকলির ভাইকে আমার ফৌজে অন্তর্ভুক্ত করি। তার সহযোগিতায় আমি দুই-একবার আনারকলির সঙ্গে দেখা করি। আমার উচ্চপদ, অর্থ-বিত্ত কিংবা সৌন্দর্য কোনোটাই আনারকলিকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। বরং তার আচরণ দেখে স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, সে আমার প্রতি বেশ বিরক্ত উপযাচক হয়ে বার বার তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হওয়ার জন্য। আমি যে প্রত্যাখ্যাত হতে যাচ্ছি, তা বুঝতে কোনো অসুবিধাও হচ্ছিল না। ফলে এক ধরনের অপমান এবং এক ধরনের হৃদয়বিদারক কষ্ট আমাকে পেয়ে বসল। দিন-রাত শুধু আনারকলির চিন্তা আর না পাওয়ার বেদনায় আমি ইমানহারা হয়ে পড়লাম। আমার ধনসম্পদ, প্রাসাদ, সৈন্যসামন্ত, স্ত্রী এবং পরিবার-পরিজন সবকিছুই তুচ্ছ মনে হতে লাগল। জীবনের ওই মুহূর্তে কেবল আনারকলি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। এর মধ্যে প্রেম কতটুকু ছিল কিংবা শারীরিক আকর্ষণ কতটুকু ছিল তার ভেদাভেদ করতে পারব না। তবে আনারকলির নাম মনে হতেই সারা শরীর আনচান করে উঠত। তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে পাগল করে তুলত। আমার প্রাসাদের রক্ষিতা ছাড়াও বাইরের নামকরা রক্ষিতাদের কাছে গিয়ে মাতাল হয়ে সেই আকাঙ্ক্ষা অবদমিত করার চেষ্টা করেছি কিন্তু ফল হয়নি। মনে হচ্ছিল, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। যখন একা থাকতাম আনমনে বিড়বিড় করে কেবল আনারকলি আনারকলি নাম আওড়াতাম।

আমি নিজের শরীর ও মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে বসলাম। এ অবস্থায় অনেক নির্বোধ মানুষের মতো আমিও মন্ত্রতন্ত্র ও ঐন্দ্রজালিক বিষয়ের মাধ্যমে আনারকলিকে পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। এক হিন্দু জাদুকর আমাকে অনেক ভেলকিবাজি দেখাল। তার জাদুতে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম যে, আমি অশরীরী মানুষে পরিণত হয়ে আনারকলির কাছে যেতে পারব। তাকে আলিঙ্গল করার সুযোগ পাবো। আমি জাদুকরকে অনেক অর্ধকড়ি দিলাম। অনেক চেষ্টা করলাম অশরীরী মানুষ হওয়ার জন্য, কিন্তু হতে পারলাম না। ভণ্ড জাদুকর সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেল। কিন্তু আমার লোভ অবদমিত হলো না। এরপর আমি পরিচিত হলাম আরেক ভণ্ড তান্ত্রিকের সঙ্গে। সে পরামর্শ দিল, ইবলিশ শয়তানের বন্ধু হওয়ার জন্য এবং শয়তানের সহযোগিতায় আনারকলির সঙ্গে মিলনের সাধ পূর্ণ করার জন্য। আমি তান্ত্রিকের কথামতো অমাবস্যা রাতে শ্মশানঘাটে গিয়ে উলঙ্গ হয়ে সারা শরীরে কাদা ও ছাই মেখেছি। তারপর শয়তানের বন্দনাবাণী আওড়াতে আওড়াতে সারারাত নেচেছি। এক সময় ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। তান্ত্রিক পালিয়েছিল। খুব সকালে গ্রামবাসী আমাকে উলঙ্গ অবস্থায় উদ্ধার করে। আমার সারা শরীরে কাদা ও ছাই মাখানোর জন্য তারা আমাকে চিনতে পারেনি। আমি কোনোমতে একটি বস্ত্র জোগাড় করে সেখান থেকে পালিয়ে দুর্গে এসেছিলাম।

আনারকলিকে পাওয়ার জন্য আমার অবিরত সংগ্রাম যতই ব্যর্থ এবং লাঞ্ছিত হচ্ছিল, ততই আমার আগ্রহ বাড়তে থাকল। এরপর আমি শুরু করলাম জিনপূজা। আমাকে বোঝানো হলো জিনেরা এক মুহূর্তের মধ্যে আনারকলিকে মোগল হেরেম থেকে তুলে এনে আমার প্রাসাদে হাজির করতে পারবে দিন-রাতের যে কোনো সময়_ আমার পছন্দ অনুযায়ী। আমি এবার জিন তান্ত্রিকদের প্রতারণায় পড়লাম। তারা আমাকে দিয়ে বিচিত্র সব যজ্ঞ ও কাণ্ডকারখানা করাল। আমার অর্থকড়ি হাতিয়ে নিল এবং এক সময় লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে পালিয়ে গেল। আমি এরপরও হাল ছাড়লাম না। মন্ত্রটন্ত্র, জাদুটোনায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আমি আমার নিজের শয়তানি ও প্রতারণা বুদ্ধি খাটাতে চেষ্টা করলাম। আমার সারাজীবনে শুভবুদ্ধির মাধ্যমে ভালো কাজ করার নজির খুবই কম। অন্যদিকে মন্দ কাজের সফলতায় মাঝেমধ্যে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম। আমি ভাবতে থাকলাম, কী করে আনারকলিকে কাছে পাওয়া যাবে। এসব চিন্তা করতে করতে আমি মনে মনে বড়ই নিষ্ঠুর হয়ে উঠলাম। আমি আমার অভিলাষ পূরণ করবই_ তাতে যদি নিজে মারা যাই কিংবা আনারকলি মারা যায়, কিছু আসে যায় না। আমি অতিরিক্ত লোভের কারণে আমার হৃদয়ের ভালোবাসা হারিয়ে কেবল ভোগবাদী পুরুষরূপী পিশাচে পরিণত হলাম।

আমার ভোগবাদী খারাপ নফস যা কিনা নফসে আম্মারা নামে পরিচিত। আমাকে বহুবিধ পরিকল্পনা বাতাস দিল। অনেক কারণে পরিকল্পনার মধ্যে আমার জন্য সর্বাধিক সহজ ছিল আনারকলির কাছে বলা যে, আপনি তাকে ভালোবাসেন এবং আপনার ভালোবাসার পয়গাম তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করা। আমার সারা জীবনের ভণ্ডামিটি সেদিন উপস্থাপিত হয়েছিল আনারকলির কাছে। আপনার কথা শুনেই সে খুশিতে টগবগ করে উঠল। তার সারা শরীরে লক্ষ করলাম আনন্দের প্রচণ্ড শিহরণ। লজ্জা, ভয় আর আবেগে তার মুখমণ্ডলে মৃদু ঘাম দেখা দিল। সে এক দৌড়ে প্রাসাদের মধ্যে ঢুকল এবং আবার একটু পর বেরিয়ে এলো। হাতে একটি রেশমি রুমাল। সে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলল। বড় ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে আমাকেও সে বড় ভাই মনে করে সালাম করল। তার হাতের স্পর্শ পেয়ে মানুষখেকো জানোয়ারের মতো আমার সারা দেহমনে কামনার আগুন ছড়িয়ে পড়ল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলাম বটে কিন্তু তাকে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার আরও বেড়ে গেল।

কোনো এক সন্ধ্যায় আমি আনারকলির একটি উত্তম তৈলচিত্র এবং তার দেওয়া রেশমি রুমাল নিয়ে আপনার প্রাসাদে উপস্থিত হলাম। আমার বর্ণনা শুনে আপনিও আনারকলির জন্য প্রবল আগ্রহ দেখালেন। এরপর আমি যখন আপনাকে ছবি এবং রুমাল উপহার দিলাম, আপনি বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। আমি বুঝলাম, আমি একটি মহালাভের ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি। আনারকলিকে আপনার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে দিতে পারলে আমার বর্তমান পদ-পদবি এবং বিত্ত-বৈভব বাড়তে থাকবে অগুনতি হারে। অন্যদিকে সুযোগ পেলে আনারকলিকে ভোগও করা যেতে পারে। আপনার বহু রম্য বিহারের আমি ছিলাম সাক্ষী এবং প্রেরণাদাতা সঙ্গী। আনারকলির নাম, ছবি এবং তার উপহার পাওয়ার পর আপনার চোখমুখের যে অভিব্যক্তি হয়েছিল, তাতে আমি স্পষ্ট বুঝেছিলাম_ এখন আমার কী করতে হবে। অনেক সুন্দরী দাসী আপনাকে উপহার প্রদানের সুযোগ পেয়েছিলাম। তাদের অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। নারীদের নিয়ে আপনার শিল্পকলা আমি তাদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমার ধারণা হয়েছিল, আনারকলি হবে আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ নারী।

আপনার আগ্রহ দেখে আমার কামনার আগুন এবার আনারকলিকে ছেড়ে পদ ও পদবির দিকে ধাবিত হলো। তাকে নিয়ে আমার উত্তেজনার প্রবলতা কমল বটে, কিন্তু প্রশমিত হলো না। আমি যথাশীঘ্র আপনাদের মিলন ঘটিয়ে দিয়ে মহামূল্যবান পুরস্কার লাভ করব এই নতুন স্বপ্ন আমাকে পেয়ে বসল। আমি আবার আনারকলির সঙ্গে দেখা করলাম এবং আপনার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করলাম। আমি এও বললাম, খুব তাড়াতাড়ি মহামান্য যুবরাজ সেলিম তার সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহী। আনারকলি সায় দিল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আপনাদের দেখা সাক্ষাৎ পর্বটি আমার প্রাসাদে আয়োজন করব। আপনার অনুমতি নিয়ে সাক্ষাতের তারিখ নির্ধারণ করলাম এবং নির্ধারিত রাতে আকাশভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় আমার প্রাসাদটিকে মনোরমভাবে সাজালাম, আপনাদের মিলনকে চির স্মরণীয় করে তোলার জন্য। যমুনার শাখা নদীর তীরে আমার প্রাসাদটির নাম ছিল রাজ লহরী। ফতেপুর সিক্রির মূল প্রাসাদ ও শাহী হেরেম থেকে এটির দূরত্ব সাত ক্রোশ মাত্র। প্রকৃতির এক অনাবিল প্রশান্তময় পরিবেশে আপনি যাতে আনারকলির সঙ্গ অনুভব করতে পারেন তার সব আয়োজনই আমি করেছিলাম। আনারকলিকে আমি আগেই এনে রেখেছিলাম। আপনি এলেন সূর্য অস্ত যাওয়ার ঠিক পর পরই...। এটুকু বলে ইলিয়াস খান সামান্য কাত হয়ে মাথা উঁচু করলেন। আনত নয়নে সম্রাটের দিকে তাকালেন। চারদিকে সুনসান নীরবতা। দরবারে উপস্থিত সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। নিশ্চুপ ও নিশ্চল হয়ে প্রতিটি শব্দ শুনছেন। ভরা দরবারে প্রকাশ্যে ইলিয়াস খানের বিচার চলছে। পদাধিকার বলে সম্রাট স্বয়ং আজ প্রধান বিচারক। রয়েছেন কাজী উল কুছাতসহ গ্রান্ড জুরিগণ। আসামির জবানবন্দির পর শুরু হবে সওয়াল জওয়াব। আসামি তার জবানবন্দির এই পর্যায়ে আরও একান্ত ব্যক্তিগত ও স্পর্শকাতর বিধায় বলতে চাচ্ছেন। আর এ কারণেই দ্বিধাগ্রস্ত ইলিয়াস খান সম্রাটের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত বোঝার চেষ্টা করছেন। সম্রাটও তার ইঙ্গিত বুঝলেন। আসামি তাকে জিম্মি করতে চাইছে। ভরা দরবারের প্রকাশ্য এজলাসে তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করে তাকে বিব্রত করার ভয় দেখিয়ে সুবিধা নিতে চাচ্ছে। সম্রাটের ভীষণ অভিমান হলো। সঙ্গে সঙ্গে জিদও চাপল। বলুক না, দেখি কি এবং কতদূর বলতে পারে। তিনি হুকুম করলেন জবানবন্দি চালিয়ে যাওয়ার জন্য_

ইলিয়াস খান আবার শুরু করলেন_ আলমপনা! আমি আপনাদের মিলনের জন্য সব আয়োজনই সম্পন্ন করেছিলাম অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। এরই মধ্যে আমার শয়তান মন আমাকে আরও একটি কুপরামর্শ দিল এবং আমি তা গ্রহণ করলাম। আনারকলির শারীরিক সৌন্দর্য ভোগ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাকে পেয়ে বসল। তাকে নিবিড়ভাবে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাদই দিয়েছিলাম। আমার বিশ্বস্ত কয়েকজন স্থাপত্যবিদকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মনের গোপন কথাটি তাদের বললাম। তারা প্রথমে খুব হাসল। তারপর দাবি করে বসল বিশাল অঙ্কের অর্থ। আনারকলির উন্মুক্ত শরীর দেখার সুযোগের কাছে আমার কাছে তাদের দাবিকৃত অর্থ নিতান্ত তুচ্ছ মনে হলো।

অর্থ পেয়ে তারা খুব দ্রুত সংশ্লিষ্ট কামরাটিতে জ্যামিতিক কোণে ত্রিমাত্রিক আয়না বসাল। পাশের একটি কামরায় বসে আমি অন্য একটি আয়নার মাধ্যমে ওই কামরার সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলাম। গোপন দৃশ্য দেখার এই নয়া কৌশল আবিষ্কারের পর আমার আনন্দ আর উত্তেজনার শেষ ছিল না। আপনার কথা ভেবে আমি খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম। আবার আনারকলির কথা ভেবে খুব আনন্দ পাচ্ছিলাম। এটুকু বলে ইলিয়াস খান আবার থামল এবং গর্বের সঙ্গে দরবারের চারদিকে চোখ বুলাল। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে। দরবারের খোজা প্রহরীগুলো উলঙ্গ তলোয়ার হাতে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে সম্রাটের হুকুম মাত্র ইলিয়াস খানের শিরশ্ছেদ করা যায় কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু ইলিয়াস খানের যেন কোনো কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ নেই। সে আবার বলতে শুরু করল_

সূর্য ডোবার অব্যবহিত পরে আপনি আমার প্রাসাদে এলেন। আমার সর্বোত্তম মেধা ও মননশীলতা দিয়ে প্রাসাদটিকে সাজিয়েছিলাম। বাহারি আতশবাজি এবং হাজার হাজার প্রজ্বলিত মোমের আলোয় এমন এক স্বপ্নময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল, যা এখনো আমার হৃদয়ে পুলক সৃষ্টি করে। আপনাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমি নিয়ে গেলাম আনারকলির কামরার কাছে। মুচকি হেসে আপনি সেখানে ঢুকলেন আর আমি চলে গেলাম পাশের কামরায় আপনাদের গোপন দৃশ্য দেখার জন্য। আমি বহু নারী দেখেছি, দেশ-বিদেশের বহু নারীর সঙ্গ লাভ করেছি। প্রতিটি নারীর স্বতন্ত্র দেহ সেক্টর, তাদের গায়ের সুঘ্রাণ, কণ্ঠস্বর এবং আকর্ষণীয় অংশগুলোর গঠন সম্পর্কে আমি ছিলাম সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। আমি আমার সুদীর্ঘ ভোগী জীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলোতে নারীদের গভীর মনোযোগ নিয়ে দেখেছি। আমার সেই অদ্ভুত আগ্রহে নারীরা বেশ খুশিই হতো এবং রসিয়ে রসিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করত, কেন আমি এসব করছি। সেসব অতিজ্ঞতার আলোকে আমি আনারকলিকে দেখছিলাম। তার পায়ের নখ থেকে চুল পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গই আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। অসাধারণ কেবল অসাধারণ এবং শুধু অসাধারণ। উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছিল। নিজের অজান্তেই আমার 'নুতফা' বের হয়ে এলো। আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে থাকলাম।

এ ঘটনার পর আপনি অনেকবার আমার প্রাসাদে এসেছেন আর আমিও গোপনে আনারকলির সবকিছু দেখেছি। এতবার দেখার পরও আমার আগ্রহ নূ্যনতম কমেনি বরং বেড়েই চলেছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে কোনো মূল্যে আপনার আর আনারকলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করব সুকৌশলে। যাতে করে সে এবং আপনি উভয়েই আমার শরণাপন্ন হন। আর তখনই সুযোগমতো আনারকলিকে উপভোগ করব। যেমন কথা তেমন কাজ। আমি বিষয়টি প্রথমে আপনার প্রবীণ স্ত্রী মনভাবতী বাইকে জানালাম। তিনি শুরু করলেন চিৎকার-চেঁচামেচি। সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে গেল রাজস্থানে আপনার শ্বশুর এবং মামাদের প্রাসাদগুলোতে। মহান বাদশাহ আকবরের কানেও বিষয়টি পেঁৗছানোর ব্যবস্থা করলাম। আমি সবাইকে এই মর্মে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে, আনারকলির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক অন্য দশ জনের মতো নয়। আপনারা একে অপরকে প্রবলভাবে ভালোবাসেন এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেহেতু রাজকুমারী মনভাবতীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভালো নয় সেহেতু আপনি সম্রাট হলে আনারকলিই হবেন রাজমহীয়সী_ এ ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে দরবারের রাজপুত আমাত্যগণকে আমি উত্তেজিত করে তুলি। পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, মহান বাদশাহ আকবর আপনাকে ডেকে পাঠান।

আপনার মহান পিতার সঙ্গে আলোচনার পরই আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমার ভয় হচ্ছিল যে, আপনি হয়তো সব দুরভিসন্ধি জেনে ফেলেছেন। আমার মনে হলো পালাই। কিন্তু কোনো সুযোগ পেলাম না। আপনার দেহরক্ষীরা আমাকে তাড়াহুড়া করে আপনার সামনে হাজির করল। ভয়ে থর থর করে কাঁপছিলাম। মনে হলো, এক্ষণি আমার শিরশ্ছেদ হবে। কিন্তু না কিছুই হলো না। আপনি আমার শয়তানির কিছুই জানতে পারেননি। বরং আমার দ্বারা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে আমাকে বিশ্বাস করে নতুন দায়িত্ব প্রদানের জন্য ডেকেছিলেন। প্রচণ্ড চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে আপনি পায়চারী করছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে আপনি বসলেন এবং আমাকে বসার অনুমতি দিলেন। তখনই বুঝতে পারলাম আমি নিরাপদ। আমি আপনার কাছে নিবেদন করলাম এক মগ পানি পান করার জন্য। ভয়ে আমার বুক ও গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। ঠাণ্ডা পানি পানে হৃদয় কিছুটা শীতল হওয়ার পর আমি কিছুটা স্থির হয়ে আপনার হুকুম শোনার জন্য প্রস্তুত হলাম। প্রচণ্ড অস্থিরতা এবং দুশ্চিন্তার জন্য আপনি আমার এই করুণ দৃশ্য লক্ষ্য করেননি। যদি আমার দিকে ভালোভাবে তাকাতেন এবং আমার শয়তানি ধরে ফেলতেন, তাহলে সালতানাতে মোগলের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো।

আপনি আশঙ্কা করছিলেন যে, আনারকলিকে হয়তো হেরেমের অভ্যন্তরে মেরে ফেলা হতে পারে। এ জন্য আপনি আমাকে দায়িত্ব দিলেন আনারকলিকে নিয়ে আগ্রা থেকে পালিয়ে দিলি্লর মেহরুলিতে অবস্থিত আপনার ব্যক্তিগত দুর্গে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। আমি ছিলাম পাঁচ হাজারি মসনবদার সেনাপতি। এর সঙ্গে নতুন যোগ হলো আরও দুই হাজার সৈন্যের দুর্গটি। ফলে আমার নতুন পদবি হলো সাত হাজারি। আনন্দে আমি আত্দহারা হয়ে পড়লাম। মোগল বাহিনীতে অতি অল্প সময়ে এত বড় পদে পদোন্নতি এরআগে মাত্র দুজন পেয়েছিলেন_ মহারাজা মানসিংহ আর সেনাপতি মহব্বত খান। আমি পদোন্নতিতে যত না আনন্দিত হলাম, তার চেয়েও বহুগুণ খুশি হলাম আনারকলির জিম্মা পেয়ে। লোভে আমার জিহ্বাতে পানি চলে এলো। মনে হলো এতদিনে পাপিষ্ঠ শয়তান হয়তো আমার মনের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের একটি সুযোগ করে দিয়েছে। আমি আমার ব্রিগেডের সব সেনাদের নিয়ে দিলি্লর মেহরুলির উদ্দেশে রওনা করলাম, সঙ্গে নিলাম আনারকলি এবং তার ভাইকে।

আমি যখন দিলি্লর পথে তখন রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে ঘটতে থাকল একের পর এক ঘটনা এবং দুর্ঘটনা। সময়টা ছিল ১৫৯৯ সালের প্রথমার্ধ। দাক্ষিণাত্যে মোগল অধিকৃত রাজ্যগুলো বিদ্রোহ করে বসল। এর সঙ্গে যুক্ত হলো বিজাপুর, গোলকোণ্ডা, আহমেদাবাদ নামক মুসলিম রাজগুলোর উৎপাত। সম্রাট আকবর স্বয়ং রওনা করলেন বিদ্রোহ দমনে। আপনি তখন আগ্রায়। হঠাৎ কেন জানি কি হলো আপনি সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসলেন। আগ্রা এবং আশপাশের অনেক জায়গিরদার এবং সেনাপতিরা আপনার সঙ্গে যোগ দিল। আমিও যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে আপনার কাছে দূত প্রেরণ করলাম। দিলি্লতে থেকে আনারকলিকে হেফাজত করার নির্দেশ নিয়ে দূত ফেরত এলো। এদিকে আপনার বিদ্রোহের খবর শুনে মহান সম্রাট আকবর দাক্ষিণাত্য ছেড়ে দ্রুত আগ্রার পথে রওনা হলেন। সম্রাট রাজধানীর উপকণ্ঠে পেঁৗছে শিবির গাড়লেন। সম্রাটের আগমন সংবাদে অনেক সেনাপতি আপনার পক্ষ ত্যাগ করল, কেবল অল্প কয়েকজন ছাড়া। সম্রাট প্রাণান্ত চেষ্টা করলেন যুদ্ধ পরিহার করার জন্য। কিন্তু আপনি অনড় রইলেন নিজের অবস্থানে। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। একদিনের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে আপনি পরাজিত এবং বন্দী হলেন। এ খবর যখন মেহরুলিতে আমার দুর্গে পেঁৗছল তখন দেহের অভ্যন্তরের সব শয়তানি ইন্দ্রগুলো নাচানাচি শুরু করল। আমি ভাবলাম এবার আমি আনারকলিকে ইচ্ছামতো পাবো।

যেই কথা সেই কাজ। আমি আনারকলির কামরায় এত্তেলা পাঠালাম যে, আমি সন্ধ্যার পর আসছি জরুরি প্রয়োজন। একটু লম্বা সময় নিয়ে আলোচনা দরকার। সে যেন তার সান্ধ্যকালীন পানাহার সেরে নেয়। সম্ভব হলে উত্তম পোশাক পরিধান করার জন্য নির্দেশনা দিলাম। এদিকে উত্তেজনায় আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। খুব হাসি পাচ্ছিল আমার। দুর্গের ছাদে গিয়ে অনেকক্ষণ পাগলের মতো হাসলাম। আমার হাত ও পা কেমন যেন কাঁপছিল এবং আচরণ করছিলাম একদম নির্বোধ বালকের মতো। আমার ভয় হলো নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণহীনতা দেখে। আমার আশপাশের লোকজন আমার চঞ্চলতা এবং বালখিল্য দেখে তাজ্জব বনে গেল। আমি হাম্মামখানায় গিয়ে অনেকক্ষণ চৌবাচ্চার মধ্যে নিজের শরীর ডুবিয়ে রাখলাম। কিন্তু উত্তেজনা কমল না। আমি ঘোড়ার পিঠে করে কিছু সময় ঘুরতে চাইলাম। কারণ শরীরে গতি পেলে অস্থিরতা কমে। কিন্তু আস্তাবল থেকে যখন আমার প্রিয় তুর্কি ঘোড়াটিকে আনা হলো তখন আমি ভয় পেয়ে গেলাম। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও প্রিয় ঘোড়াটিকে আমার আজ আজরাইলের মতো মনে হতে লাগল। আমি দেখছিলাম, ঘোড়াটির চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে আর সে যেন দাঁত বের করে আমাকে ভেংচি মারছে। আমি ঘোড়াটিকে পুনরায় আস্তাবলে নিয়ে যেতে বললাম। এরপর আমার হুকুমে সাদা রঙের একটি গাধা আনা হলো। আমি গাধার পিঠে চড়তেও সাহসী হলাম না। একজন বিশ্বস্ত প্রহরী নিয়ে আমি হাঁটতে হাঁটতে নিকটস্থ গ্রামের দিকে গেলাম।

আমার দুর্গটি ছিল মূল দিলি্লর শহরতলি থেকে দুই ক্রোশ দূরে। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত সাধক খাজা নিজাম উদ্দিনের মাজার। আমি ভয়ে কখনো সেদিকে যাইনি। আমার বিশ্বাস ছিল, নিজাম উদ্দিন আউলিয়া অত্যন্ত বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। অন্যান্য আউলিয়াগণের মতো তারও অনেক কেরামতি থাকতে পারে তার মৃত্যুর পরও। তিনি যখন এখানে আসেন তখন সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের রাজত্বকাল। তার জীবদ্দশায় অনেক সুলতান দিলি্লর সিংহাসনে বসেছেন। কিন্তু কেউই তার সঙ্গে বেয়াদবি করার সাহস পাননি। অনেকে তার অভিশাপের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছেন। সবাই বলেন, সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তার কারণেই অকাল মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন। আমার মাঝেমধ্যে মনে হতো নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার দরবারে গিয়ে তওবা করি এবং ভালো হয়ে যাই। কিন্তু আমার নফসসহ সময় আমাকে উল্টো পথে পরিচালিত করেছে। আজও আমি উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম। নদীর তীর ধরে আমি অনেকক্ষণ হাঁটলাম। পড়ন্ত বিকেলের মৃদুমন্দ বাতাস এবং গ্রামবাসীদের দেখার পর আমার মন কিছুটা শান্ত হলো। আমি দুর্গে ফিরে এলাম।

সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি আনারকলির কামরায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। আমি জানতাম সে যেমন নৃত্য পটীয়সী তেমনি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। আমার সন্দেহ হলো, সে যদি সাহস করে আমাকে আক্রমণ করে বসে, সে ক্ষেত্রে তার সঙ্গে শারীরিক শক্তিতে নাও পারতে পারি। এ জন্য বিশ্বস্ত চারজন খোজা প্রহরীকে সার্বক্ষণিকভাবে কামরার বাইরে সতর্ক প্রহরায় রাখলাম। আমি সেখানে যাওয়ার আগে কামরাটিতে ব্যাপক তল্লাশি চালালাম এবং কোনো অস্ত্র লুকানো আছে কিনা ভালোভাবে খোঁজ করলাম। এরপর আমি আনারকলির মুখোমুখি হলাম। আমি জীবনে কোনো নারীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিনি তাকে ছাড়া, কিংবা সুনির্দিষ্ট কোনো নারীকে পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন বিনিদ্র রজনী কাটাইনি। কোনো নারীকে নিয়ে আবার আবেগ সৃষ্টি হয়নি। কারণ শরীরে যৌবন আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পেয়েছি ইচ্ছামতো। আজ প্রথম কারও সামনে যাচ্ছি, যে কেবল একজন নারী নয়। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না তাকে আমি কী বলব, তার সঙ্গে কেমন আচরণ করব। সব কিছুর আগে আমাকে মোগল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। আমার ভয় হচ্ছিল যদি আপনি ছাড়া পেয়ে যান এবং তা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনাও ছিল।

আপনার বিদ্রোহের বেশ কিছুকাল পূর্ব থেকেই আপনার স্ত্রী মনভাবতী বাই, আপনার স্ত্রীর বড়ভাই রাজা মানসিংহ এবং আপনার শ্বশুর রাজা ভগবান দাস আপনার পরিবর্তে আপনার জ্যেষ্ঠপুত্র শাহজাদা খসরুকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের জন্য জোর চাপ দিচ্ছিলেন। প্রথমদিকে মহামতি সম্রাট আকবর গররাজি হলেও পরে কয়েকটি কারণে তিনি রাজি হন। প্রথম কারণ ছিল রাজপুত বীর রানা প্রতাপ সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য রাজা মানসিংহের বিকল্প ছিল না। ১৫৭৬ সালের ৩ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ চলছিল আপনার শাসনামল পর্যন্ত। সম্রাট আকবরকে বাধ্য হয়ে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছিল। জয়পুর ও আজমীরের মরুময় পাহাড়ি অঞ্চলে যুদ্ধ করার জন্য এবং বিশেষত রাজপুতদের বিরুদ্ধে_ রাজা মানসিংহের বিকল্প ছিল না। অন্যদিকে ১৫৮০ সালে শুরু হল নতুন উৎপাত। একদল মোগল সেনা এবং উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী মিলে ধর্মের দোহাই দিয়ে বিদ্রোহ করে বসল। তারা বিখ্যাত মুসলিম ধর্মীয় নেতা কাজী মোহাম্মদ ইয়াদদির কাছ থেকে এই মর্মে ফতোয়া আদায় করল যে_ আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ। তারা মহামতি সম্রাট আকবরের সৎভাই এবং কাবুলের গভর্নর মীর্জা হাকিমকে নতুন সম্রাট ঘোষণা করল।

বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহ। প্রথমে বাংলা, তারপর বিহার এবং সব শেষে কাবুলে। এই বিদ্রোহ ছাড়াও নিয়মিত যুদ্ধ হচ্ছিল রাজপুতদের সঙ্গে দক্ষিণাত্যে বিশেষত বিজাপুর, গোলকণ্ডা এবং আহমেদ নগরে। সম্রাট আকবর বাংলা ও বিহারে সৈন্য প্রেরণ করলেন এবং নিজে রাজা মানসিংহকে নিয়ে কাবুল রওনা হলেন। ১৫৮১ সালের ৮ মার্চ সম্রাট সিন্ধু নদীর তীরে তাঁবু গেড়ে মানসিংহকে কাবুল অভিযানের দায়িত্ব দেন। মহা সাহসিকতা নিয়ে মানসিংহ সিন্ধু নদ পাড়ি দেন আর এ খবর পেয়ে মীর্জা হাকিম দুর্গম পাহাড়ি উপত্যকা গুরুবান্দে পালিয়ে যান। ১৫৮১ সালের ১০ আগস্ট আকবর স্বয়ং কাবুলে উপস্থিত হন। ১৫৮২ সালে মানসিংহকে কাবুলের গভর্নর নিযুক্ত করে সম্রাট ফতেপুর সিক্রিতে ফিরে এলেন। এরপর শুরু হলো আরেক বিপদ_ আফগানিস্তানের বিখ্যাত উপজাতি ইউসুফজাই এবং মান্দার সম্প্রদায় বিদ্রোহ করে বসে। সেই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে সম্রাটের নবরত্নের অন্যতম রাজা বীরবল নিহত হন। এরপর সেখানে প্রেরণ করেন রাজা টোডরমলকে। বিদ্রোহীরা হিন্দুকুশ পর্বতের অভ্যন্তরের দুর্গম গিরিপথ খাইবার পাশে ঢুকে পড়ে মোগল বাহিনীকে বিপর্যস্ত করতে থাকে! কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এ অবস্থায় সম্রাট ১৫৮৬ সালে আপনার শ্বশুর রাজা ভগবান দাসের নেতৃত্বে নতুন আরেক দল সেনাবাহিনী পাঠান। এরপরই কাবুলের বিদ্রোহ প্রশমিত হয় বটে, কিন্তু সম্রাট পিতা-পুত্র-কন্যা অর্থাৎ রাজা ভগবান দাস, রাজা মানসিংহ এবং রাজকুমারী মনভাবতী বাইয়ের চাপে আপনার পরিবর্তে আপনার জ্যেষ্ঠ শাহজাদা খসরুকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন দিতে রাজি হন।

আমার ভয় হচ্ছিল, ক্ষমতা কোনোমতেই আপনার বৃত্তের বাইরে যাচ্ছে না। কাজেই আনারকলির সঙ্গে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে আমার কোনো রক্ষা নেই, একথা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। কাজেই সম্ভাব্য প্রতিকারের কথা চিন্তা ও পরিকল্পনা করে আমি কুকর্মের দিকে এগুতে মনস্থ করলাম। পরিকল্পনা মতো আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আনারকলিকে প্রথমে প্রস্তাব দেব আমার হেরেমের বাসিন্দা হওয়ার জন্য। এতে সে রাজি না হলে তাকে জবরদস্তিমূলকভাবে ভোগ করব নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এরপর তাকে হস্তান্তর করব প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজলের কাছে। সম্রাট আকবরের নির্দেশে প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল তখন হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন আনারকলিকে। সে ক্ষেত্রে আমার লাভ দুদিকেই, একদিকে তাকে ভোগ করার আনন্দ আর অন্যদিকে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে ইনাম। সর্বাধিক মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আমি আনারকলির কামরায় ঢুকলাম। সে তখন বসেছিল বিষণ্ন মনে। তার হাবভাব দেখে মনে হলো, আমার দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সে কোনো সন্দেহই করেনি। সে কেবল আপনার কথাই ভাবছিল। আমাকে দেখে সে দাঁড়াল না। সম্রাজ্ঞীর মতো আয়েসী ভঙ্গিতে চিন্তাক্লিষ্ট মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করল, ইলিয়াস খান! সাহেবে আলমের খবর কি? আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম এবং এক মুহূর্তের মধ্যে আমার গলা শুকিয়ে গেল। এর আগে তাকে আমি সম্মান করে মালেকা এ আলায়া বলে ডাকতাম। এখন আমি কী বলব ভাবতেই পারছিলাম না। কোনোরকম সম্বোধন ছাড়াই আমি যথাসম্ভব সংযত হয়ে তার কাছে বসার অনুমতি চাইলাম। সে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আমার খাস কামরায় স্বয়ং সম্রাট এবং সাহেবে আলম ছাড়া কারও বসার এখতিয়ার আছে কি? যা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দিন। আমি আমতা আমতা করতে থাকলাম। সে আমাকে ধমক দিয়ে আপনার কথা জিজ্ঞাসা করল। এবার আমি তাকে বললাম, সাহেবে আলম শাহাজাদা সেলিম রাজকীয় কাহিনী কর্তৃক পরাজিত এবং গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় আছেন। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য সম্রাজ্ঞী যোধা বাই, রাজা ভগবান দাস, রাজা মানসিংহসহ অনেকে চেষ্টা করছেন। এর বেশি আর কিছু আমি জানি না। এদিকে আমার জন্য সমস্যা হচ্ছে, সম্রাটের লোকজন হন্যে হয়ে তোমাকে খুঁজছে। আমি বোধহয় তোমাকে আর লুকিয়ে রাখতে পারব না। আমার মুখে এই প্রথম তুমি শব্দ শুনে এবং সম্রাটের লোকজনের খোঁজ করার ঘটনা শুনে সে করুণ মুখে আমার দিকে তাকাল। সম্ভবত এবার সে আমার মতলব অাঁচ করতে পারল। অত্যন্ত শান্ত গলায় আমাকে বলল, বসুন সেনাপতি ইলিয়াস খান। ইতোমধ্যে আমার সব জড়তা কেটে গেছে এবং অত্যন্ত খোলামেলাভাবে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম। তাকে জানালাম, এ মুহূর্তে দুর্গমধ্যে তোমার অবস্থান আমার নিজের জন্য এবং একইসঙ্গে সাত হাজার সৈন্যের জন্য জীবন-মরণ সমস্যা। সম্রাট যদি জানতে পারেন, তাহলে আমাদের কাউকে ছাড়বেন না। তবে হ্যাঁ তুমি যদি আমার প্রস্তাবে রাজি হও সে ক্ষেত্রে তোমার জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হব না। আনারকলি এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। এতক্ষণে বোধহয় সে বুঝতে পারল আমার আসল উদ্দেশ্য। সে ওঠে দাঁড়াল এবং বলল, আমি মৃত্যুবরণ করব কিন্তু চরিত্রহীন হয়ে আপনার বাহুলগ্ন হব না। আমি হাসলাম এবং বললাম, এখানে শত চেষ্টা করেও তুমি আত্দহত্যা করতে পারবে না। অধিকন্তু খোজা প্রহরীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হবে। আমি যে কোনো সময় তোমাকে ভোগ-দখল করতে পারি। এরপর আমি ওঠে দাঁড়ালাম। আমার পাশবিক মন ও দেহ একসঙ্গে আনারকলিকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো, আমি অধৈর্য হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আর এরপরই ঘটল সেই অভাবনীয় ঘটনাটি। (চলবে)

 

 

সর্বশেষ খবর