বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা

খর্বাকৃতির কীর্তিমান মানুষ

জুয়েল সরকার

দেহের গড়ন খাটো বলে পিছিয়ে যাওয়ার কিছু নেই। ইতিহাসে অনেক কীর্তিমান রয়েছেন যারা আকারে খুব একটা লম্বা ছিলেন না। খর্বাকৃতির এই মানুষগুলো কোনোভাবেই পিছিয়ে ছিলেন না। বরং নিজ প্রতিভার বহিঃপ্রকাশে তারা হয়ে উঠেছেন অনন্য। তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে মানা হয়। সত্যি বলতে গুণ থাকলে দৈহিক পরিমাপের বিষয়টি বিবেচিত হয় না। যদিও কথায় বলে 'আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী'। কথাটি যে সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় তার বহু প্রমাণ রয়েছে পৃথিবীতে। গুণ না থাকলে লম্বা-চওড়া, সুদর্শন নারী বা পুরুষও সমাজ-সংসারে অপাঙ্ক্তেয় হিসেবে যে বিবেচিত হয়, তা বলাইবাহুল্য। আসলে মানুষের কৃতিত্ব দৈহিক পরিমাপের মাধ্যমে বিবেচিত হয় না। দৈহিক মাপে খাটো বা বেঁটে ছিলেন, কিন্তু মানুষ হিসেবে তাদের সাফল্য বিশাল; কর্মগুণে পরবর্তীকালে এসব ব্যক্তিত্ব কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি পেয়েছেন, এমন কয়েকজন ব্যক্তি হলেন নেপোলিয়ন, মাও সে তুং, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, হো চি মিন, মাদার তেরেসা প্রমুখ। দৈহিক গড়নের দিক থেকে তারা খাটো হলেও এদের সাফল্য নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উঁচু মাপের। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এসেছিলেন সাধারণ পরিবার থেকে। অথচ এই খাটো মানুষটি সাধারণ সৈনিক থেকে অসীম সাহস, মেধা ও কর্মদক্ষতা গুণে ফরাসি জাতির ভাগ্যবিধাতা হয়েছিলেন। শোনা যায়, তার নাম শুনলে প্রতিপক্ষের বুক কেঁপে উঠত ভয় ও শ্রদ্ধায়। এ খর্বকায় মানুষটি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। কারও কাছে তিনি নন্দিত আবার কারও কাছে নিন্দিত। চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং দৈহিক পরিমাপে তেমন লম্বা ছিলেন না। অথচ বর্তমান চীনের বিশাল ভূখণ্ডকে বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন করতে তার সাফল্য নিঃসন্দেহে বড় মাপের- একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে রাশানদের চেয়ে আরও এক খাটো মানুষ হলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। তিনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করে এক সময় বদলে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রব্যবস্থার খোলনলচে। উচ্চতায় বিশেষভাবে খাটো আরেক প্রবাদপ্রতিম ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত নেতা ড. হো চি মিন। তার নেতৃত্বেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ভিয়েতনাম স্বাধীন হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীও ছিলেন খর্বাকৃতির, কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সততা ছিল বড় মাপের। আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত নোবেল বিজয়ী মাদার তেরেসাও দৈহিক গড়নে খাটোই ছিলেন। কিন্তু তার কীর্তি সাগরের চেয়েও অতলস্পর্শী আর হিমালয় অপেক্ষা আকাশস্পর্শী। বাংলাদেশের একজন খর্বাকৃতির বড় মানুষ হলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা সাহিত্যের গবেষণা ও বিকাশে তার অবদান অবিস্মরণীয়। এই বহু ভাষাবিদ পণ্ডিতের কাছ থেকে ভাষা আন্দোলনের মহান প্রেরণা ও বাংলা ব্যাকরণ পেয়েছে বিপুল সম্পদ। বড় মাপের খাটো মানুষটির কাছে বাঙালি জাতি তাই নিঃসন্দেহে কৃতজ্ঞ। নন্দিত, নিন্দিত, বিতর্কিত বাঙালি ব্রিটিশ প্রবাসী ভারতীয় লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরী বা নীরদ সি. চৌধুরীও ছিলেন দৈহিক গড়নে খাটো। কিন্তু লেখক হিসেবে ছিলেন অনেক বড়; তাকে নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, তিনি স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের অন্যতম সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামাল সাহিত্য, সমাজসেবা, নারী আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন। ছোটখাটো এ মানুষটির মানসিকতা, প্রজ্ঞা, সাফল্য ছিল অত্যন্ত উঁচু মাপের। এমনই কিংবদন্তিতুল্য খর্বাকৃতি মানুষের বড় মাপের সাফল্যের অনেক উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় ছড়ানো-ছিটানো আছে। চলচ্চিত্র জগতের অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী চার্লি চ্যাপলিনও খাটো মানুষ ছিলেন। তিনি অভিনয় এবং চিত্র পরিচালনায় যে সাফল্য রেখে গেছেন, তা বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর। খাটো মানুষটির সাফল্য খুব বড় মাপের।

সর্বশেষ খবর