শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৪ ০০:০০ টা

মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম (৩৪তম পর্ব)

গোলাম মাওলা রনি

মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম (৩৪তম পর্ব)

যদি কখনো বিপদ ঘণ্টা বাজানোর দরকার হয় তবে সংশ্লিষ্টরা প্রাসাদ অধ্যক্ষের কাছে এসে তা বর্ণনা করবেন। অধ্যক্ষ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, ঘণ্টা বাজানো হবে কী হবে না। যদি বাজানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তবে দ্রুত তিনি তার বিশেষ সহকারীকে লিখিত অনুমতি দেবেন এবং সেই অনুমতিপত্র যথাযথভাবে পরীক্ষার পর রক্ষীরা তাকে সুরঙ্গের মধ্যে ঢুকতে দেবে। এরপর সহকারী প্রাসাদ বেদিতে উঠে প্রহরারত রক্ষীদের অনুমতিপত্র দেখাবে এবং সবশেষে ঘণ্টায় আঘাত করবে। ঘণ্টায় আঘাতের সঙ্গে সব পুরুষ খোলা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে আসবে এবং দরবার হলে সমবেত হবে। অন্যদিকে প্রাসাদের বাইরের সেনা ছাউনিতে খবর চলে যাবে এবং সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টার মধ্যে একটা সাত হাজারি সেনাদল তাদের পদাধিক, ঘোড়া সওয়ারি, গোলন্দাজ বাহিনী, তীরন্দাজ বাহিনী এবং হস্তি বাহিনীসহ উপস্থিত হবে প্রাসাদের মূল গেটের সামনে। স্বয়ং সম্রাটের অনুমতি পাওয়ার পরই কেবল তারা প্রাসাদে ঢুকতে পারবে। আজও ঘণ্টা বাজার পর সব কিছু ঠিকমতোই হয়েছে। কিন্তু ঘণ্টাটি কেবল ঠিকমতো বাজেনি। মোগল খান্দানের এত বছরের ইতিহাসে এই প্রথম ঘণ্টাটি বিনা কারণে বাজানো হলো এবং তাও বাজাল দুটি বানর- একটি মেয়ে বানর, অন্যটি ছিল পুরুষ বানর। তাদের প্রেম প্রণয় এবং সঙ্গমে বাধা দেওয়ার জন্যই এই মহা বিপত্তি ঘটল।

প্রহরীরা যথারীতি কর্তব্যরত ছিল। হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলো বানর দম্পতি। প্রহরী যথারীতি তলোয়ার উঁচিয়ে ওদের ভয় দেখাল এবং ধমক মেরে ওখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য গালাগালি করতে লাগল। কিন্তু বানররা কোনো কিছুই পাত্তা দিল না। বরং আরও একটু কাছাকাছি এসে চোখ পিট পিট করতে থাকল এবং কিচির-মিচির, চিউবিউ শব্দ করে ভেংচি কাটতে লাগল। প্রহরীরা ছিল বালুচ জাতির লোক। মস্ত শরীর, স্বল্প বুদ্ধির এবং স্বভাবজাত মাথা গরম প্রকৃতির। তারাও বানরদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গালাগালি দেওয়ার পাশাপাশি ভেংচি কাটতে লাগল। বানররা ওই দুই বালুচ প্রহরীর মতো অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ বোধ হয় জীবনে দেখেনি। তারাও পাল্লা দিয়ে শুরু করল বাঁদরামো। একটি বানর হঠাৎ করে লাফ দিয়ে এসে এক প্রহরীর কান মলে দিয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে অন্য প্রহরী দাঁত বের করে যেই না ফক ফক করে হাসতে যাবে অমনি অন্য বানরটা এসে তার পুরুষদণ্ড এবং অণ্ডকোষে একসঙ্গে নাড়া দিয়ে গেল। বেচারা ভয়, লজ্জা আর অপমানে একদম বসে পড়ল। এরপর বানর দম্পতি শুরু করল আসল বাঁদরামি। তারা প্রহরীদের দেখিয়ে দেখিয়ে নির্লজ্জ ও বেহায়ার মতো শুরু করল সঙ্গম। প্রহরীদের মাথায় রক্ত চেপে বসল। তারা কোত্থেকে যেন দু-তিনটা পাথরের ঢিল জোগাড় করল এবং সজোরে ছুড়ে মারল সঙ্গমরত পশুগুলোর দিকে। সঙ্গমে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ওরা প্রহরীদের বিরুদ্ধে বলতে গেলে যুদ্ধ ঘোষণা করল। নিজেদের লজ্জাস্থান দেখাতে দেখাতে তারা প্রতিপক্ষের দিকে এগুতে থাকল আর প্রবল জোরে অদ্ভুতসব শব্দ করতে থাকল। ওদের সেই শব্দ শুনে আরও গোটা পঞ্চাশেক বানর প্রচণ্ড আক্রমণাত্দক ভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে এলো।

প্রাসাদ বেদির ওই স্থানটা এতই সুরক্ষিত এবং এতই নির্জন যে, ওখান থেকে খুব জোরে চিৎকার করলেও আশপাশের প্রহরীরা শুনতে পাবে না। আবার শুনতে পেলেও ওখানে যেতে পারবে না প্রাসাদ অধ্যক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে। প্রহরীরা বুঝল তারা সত্যিই বিপদে পড়েছে। এতগুলো বানরকে একসঙ্গে আসতে দেখে তাদের চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে গেল। তারা হুড়োহুড়ি করে সুরঙ্গে ঢুকতে চাইল। সরু সুরঙ্গ পথে একজনের বেশি ঢোকা যায় না। একজন ঢুকল আর অন্যজন তার পেছনে পেছনে ঢুকতে চাইল। ইতিমধ্যে বানরের দল এসে পড়ল এবং পেছনের জনের পেছনের দিকটাতে আক্রমণ করল। মাথা নিচু করে পশ্চাৎদেশ পেছনে রেখে যেই না দ্বিতীয় প্রহরী সুরঙ্গের মধ্যে ঢুকতে যাবে অমনি বানরেরা একসঙ্গে মৌমাছির মতো তার পাছাও পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লোকটি ভয়ে চিৎকার শুরু করল এবং সঙ্গী প্রথম প্রহরীকে জাপটে ধরল। ফলে উভয়েই একযোগে চিৎকার শুরু করল। বানরেরা ইচ্ছেমতো দ্বিতীয় জনকে কামড় ও খামছি দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করল। লোকটি যতই না ব্যথা পেল তার চেয়েও বেশি ভয় পেল। সে অনেক জোরে চিৎকার করে কাঁদল এবং সর্বশক্তি দিয়ে তার সঙ্গী লোকটিকে জাপটে ধরে রাখল। বানরেরা কামড়া-কামড়ি আর খামচা-খামছি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ফিরে গেল এবং যাওয়ার সময় বেশ কয়েকবার ঘণ্টাটি বাজিয়ে গেল। আর তখনই শুরু হলো পুরো প্রাসাদময় ভীতিকর দৌড়াদৌড়ি, চিৎকার চেঁচামেচি এবং যত্তসব লঙ্কাকাণ্ড।

পাগলা ঘণ্টা বেজে ওঠার কাহিনী বলতে গিয়ে সম্রাট যে হাসি শুরু করেছিলেন তা যেন কিছুতেই থামছিল না। পুরো ঘটনা শোনার পর সম্রাজ্ঞীর একটুও হাসি পেল না। বরং শাহী প্রাসাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে তার মনে রীতিমতো আশঙ্কার সৃষ্টি হলো। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সেই আশঙ্কা তখনই ব্যক্ত করা থেকে বিরত রইলেন অন্তত সৌজন্য ও সম্মান বোধের কারণে। সম্রাট তখনও হাসিতে গড়া গড়ি খাচ্ছিলেন। বানরদের আক্রমণ এবং প্রহরীদের নাজেহালের দৃশ্য সম্ভবত শাহেন শাহের মানসপটে বারবার ভেসে উঠছিল। ফলে তিনি অন্যসব কৌতুকপূর্ণ খেলার মতো ওই দৃশ্য থেকে বিনোদন নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সম্রাজ্ঞীর খুব ইচ্ছা হলো সম্রাটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাসতে। তিনি চেষ্টা করলেন। কিন্তু হলো না। বড়জোর একটু মুচকি হাসি দিতে পারলেন। কিন্তু গলা ফাটিয়ে হা হা হা রবে হাসতে পারলেন না। এমনিতেই সম্রাট খুব রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। প্রকাশ্যে চিৎকার চেঁচামেচি, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা, হাস্যরস করা কিংবা ব্যথিত হয়ে অশ্রু বিসর্জন করার মতো মানুষ তিনি নন। মনে মনে তিনি প্রেম সাম্রাজ্যের মহানায়ক। কিন্তু উপরে উপরে ভাব দেখাবেন যেন কিছুই বোঝেন না। একেবারে গো বেচারা ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানেন না!

সম্রাজ্ঞী দেখলেন সম্রাট হাসতে হাসতে বসা থেকে শুয়ে পড়লেন এবং বাচ্চা ছেলেদের মতো কোল বালিশের ওপর চড়ে উপুড় হয়ে কুত কুত, ফিক ফিক শব্দ করে হাসছেন। এ দৃশ্য দেখে সম্রাটের প্রতি তার ভীষণ রকম মায়া অনুভূত হতে লাগল। তারও ইচ্ছা জাগল প্রাণ খুলে হাসতে। কিন্তু তাতো তিনি পারছেন না। জীবনে এই প্রথম টের পেলেন বা আত্দোপলব্ধি লাভ করলেন যে, হৃদয় থেকে উৎসারিত না হলে প্রাণ খুলে হাসা যায় না। সুতরাং হাসি নিয়ে রং তামাশা বা অভিনয় করা যায় না। হাসিকে আমরা যত তাচ্ছিল্যই করি না কেন-এটা বিধাতার দেওয়া অমূল্য একটি সম্পদ। অথচ কান্না! এটা কোনো ব্যাপারই নয়, যে কোনো লোক যে কোনো সময় কান্নার ভান করতে পারে। সে এমনভাবে কান্নার অভিনয় শুরু করতে পারে যা দেখে মনে হবে লোকটি যেন সত্যিকার অর্থেই কাঁদছে। কান্নার সবচেয়ে দুর্লভ বিষয় হলো চোখের পানি। জীবনের কোনো বিয়োগান্তক ঘটনা বা আবেগময় স্মৃতি মনে করলে, যে কোনো পরিবেশে কিংবা যে কোনো সময় কান্নার সঙ্গে চোখের পানিও চলে আসবে। কাজেই চোখের পানি নিয়েও প্রতারণা করা সম্ভব। সম্রাজ্ঞী ভাবলেন, কোনো নারী বা পুরুষ যদি তার কাছে এসে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে তার কোনো ব্যক্তিগত কষ্টবোধ, দুর্বলতার স্মৃতির প্রতি সহানুভূতি জানায়, তবে নিশ্চয়ই তিনি লোকটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বেন। অথচ লোকটি সহজেই কিন্তু তার সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে। সে যদি সম্রাজ্ঞীর সামনে কান্নার অভিনয়ের সময় নিজের জীবনের কোনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের মৃত্যু, প্রেম-বিরহ ইত্যাদির কথা স্মরণ করে তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চোখে পানি চলে আসবে। অন্যদিকে লোকটি কিন্তু শত চেষ্টা করেও প্রাণখুলে হাসাহাসি করে সম্রাজ্ঞীর আনন্দের অংশীদার হতে পারবে না। সম্রাজ্ঞী এ কথা ভাবলেন এবং নিজেকে খুব অসহায় এবং নির্বোধ ভাবতে লাগলেন। একটি অতি সহজ বিষয় তারপরও তিনি কেনো এতদিন তা বুঝতে পারেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আর কোনোদিন মানুষের কান্না দ্বারা আবেগতাড়িত হবেন না। বরং যারা তার সামনে প্রাণখুলে হাসতে পারবেন তাদের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করবেন।

এসব তত্ত্বকথা ভাবতে ভাবতে সম্রাজ্ঞী পালঙ্কের ওপর উঠলেন এবং কি মনে করে যেন সম্রাটের উপুড় হওয়া শরীরের ওপর বসে পড়লেন। ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যেভাবে বড়দের পিঠে বসে ঘোড়ায় চড়ার অভিনয় করে ঠিক সেভাবে বসলেন। এতে সম্রাটের হাসি আরও বেড়ে গেল। তিনি চিৎকার করে বললেন, এই নামো! তাড়াতাড়ি নামো! আমার বড্ড সুড়সুড়ি লাগছে। সম্রাটের কথা শুনে সম্রাজ্ঞীর ঘোড়ায় চড়ার চেষ্টার উদ্দমতা যেন আরও বেড়ে গেল। তিনি সম্রাটের পিঠের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে নিজের দু'পা দিয়ে স্বামীর দু'পা সজোরে প্যাঁচ মারলেন। তারপর দুহাত চালান করে দিলেন সম্রাটের শরীরের দু'পাশ দিয়ে এবং বক্ষস্থলে আক্রমণ করে বসলেন ঠিক সেভাবে যেভাবে সম্রাট তার বক্ষে আঘাত করেন। এই অভাবিত ঘটনায় শাহেনশাহের সুড়সুড়ি আরও বহু গুণে বেড়ে গেল। তিনি ওরে বাবাগো, ওরে মা গো। এই নূরজাহান, ছাড়। দয়া করে ছাড়। আর পারছি না। আমি তো মরে যাব ইত্যাদি বলতে থাকলেন।

সম্রাটের আকুতি-মিনতিতে সম্রাজ্ঞী যেন আরও খ্যাপাটে হয়ে পড়লেন। তিনি শাহেন শাহের ঘাড়ে সজোরে দংশন বসিয়ে দিলেন। এরপর একহাত দিয়ে স্বামীর বুকের স্পর্শকাতর স্থানে চাপ দিতে লাগলেন এবং অন্য হাতটি আরও এক জায়গায় আক্রমণের জন্য চেষ্টা করতে থাকলেন। সম্রাট আর স্থির থাকতে পারলেন না। আদিম বন্যতায় তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন এবং সজোরে কোল বালিশের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে সম্রাজ্ঞীর ওপর আসীন হলেন। প্রথম দিকে সম্রাজ্ঞীর ভীষণ সুড়সুড়ি লাগল। হাসতে হাসতে তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি টের পেলেন যে, কিসের বন্ধনে যেন তার শরীর ও মন সম্রাটের শরীর মনের সঙ্গে আটকে গেছে। উভয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেকের প্রাণান্ত চেষ্টার পর সেই আটক অবস্থা থেকে মুক্ত হলেন বটে কিন্তু ততক্ষণে শরীরের ঘামে উভয়ের কাপড়-চোপড় ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তারা দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করে নিলেন এবং চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নিজেদের স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। এরপর ফিরে গেলেন আগের প্রসঙ্গে অর্থাৎ গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের আদি ইতিহাসে।

সম্রাট বললেন এ কথা সত্য, সুলতান শের শাহ সুরী সড়কটির ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। বিভিন্ন সময়ে নির্মিত সড়কের বিভিন্ন অংশের সংযোগ সাধন করেন। তার আমলেই এ সড়কটি দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সোনারগাঁও, আবার সেখান থেকে কলকাতা, পাটনা, বেনারস, এলাহাবাদ, দিলি্ল, লাহোর, পেশোয়ার হয়ে সরাসরি কাবুল পর্যন্ত যাওয়া যেত। এই মূল সড়কটির সঙ্গে আরও অনেকগুলো উপসড়কের মাধ্যমে অনেক বড় বড় নগর, বন্দর ও জনপথকে সংযুক্ত করা হয়েছিল। যেমন সোনারগাঁও থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে মুর্শিদাবাদের মধ্য দিয়ে পাটনা হয়ে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক সড়কের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটিয়ে চলে গেছে আহমেদাবাদের দিকে। আবার আহমেদবাদ থেকে উপসড়কটি আজমির হয়ে দিলি্লর কাছাকাছি এসে মূল সড়কে মিশেছে। অন্যদিকে, লাহোর থেকে একটি উপ-সড়ক পশ্চিমে মুলতানের দিকে গিয়ে সেটি আবার উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে পেশোয়ারের কাছে মূল সড়ক পার হয়ে সরাসরি পূর্বদিকে শ্রীনগর পর্যন্ত চলে গেছে।

সুলতান শেরশাহের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো- এই সুবিশাল মহাসড়ক এবং মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত উলি্লখিত উপ-সড়কগুলোতে শতভাগ রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি প্রতি দুই ক্রোশ অন্তর একেকটি সরকারি অফিস স্থাপন করেছিলেন। এসব অফিসে একজন সুবেদারের অধীনে পঞ্চাশজন অশ্বারোহী সৈন্য থাকত সার্বিক নিরাপত্তা এবং জনগণের চলাচলকে নির্বিঘ্ন করার জন্য। ছিল একটি ডাকঘর, একটি সরাইখানা, গণশৌচাগার, পানীয় জলের জন্য কূপ, সরকারি আস্তাবল। এসব আস্তাবল থেকে পথচারীরা তাদের ক্লান্ত ঘোড়াকে বদলে নিতে পারত। অসুস্থ ঘোড়ার চিকিৎসা করাতে পারত এবং দরকার হলে দ্রুতগামী ঘোড়া ভাড়া নিতে পারত। পথচারীরা দিন রাতের সবসময় এই মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করত এবং সুলতানের শাসনামলে এই মহাসড়ক কিংবা উপসড়কগুলোতে একটি সাধারণ ছিঁচকে চুরির ঘটনাও ঘটেনি। এমনকি কোনো পথচারী যদি ভুল করে রাস্তায় বা সরাইখানায় সহস্র স্বর্ণমুদ্রার থলিটি ফেলে যেত এবং পরবর্তী সময়ে কয়েক বছর পরও ফিরে আসত তবে তার ফেলে যাওয়া মুদ্রার থলিটি যথাস্থানে পেত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, শেরশাহের সেই সুশাসনের ধারাবাহিকতা এখন আর নেই।

আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, মহাবীর আলেকজান্ডার এই গ্রান্ড ট্রাঙ্ক সড়ক ধরেই ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতে তখন নন্দ বংশের রাজত্ব। ভারত বলতে আমি উত্তর ভারতকেই বোঝাচ্ছি। মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তখন সবে কিশোর থেকে যুবকে রূপান্তরিত হওয়ার পথে। তার ভুবন বিখ্যাত বন্ধু চাণক্য তখন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ওই সময় সারা দুনিয়ায় তক্ষশীলার মতো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ছিল না, তেমনি চাণক্যের মতো বহুমুখী প্রতিভাধর অধ্যাপকও ছিল না। তিনি কেবল অধ্যাপকই ছিলেন না- তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ সেনাপতি, শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, শ্রেষ্ঠ মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদ, শ্রেষ্ঠ লেখক এবং শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত। চাণক্য কিন্তু প্রেমিক হিসেবেও ছিলেন শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আজ আমি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা চাণক্যের প্রেম কাহিনী বলব না। বলব আলেকজান্ডারের প্রেমকাহিনী। [ চলবে ]

 

 

 

সর্বশেষ খবর