শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো

আমির হোসেন

কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো

১৯৭১ সালে কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডের বাংলাদেশ মিশন

যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, অংশ নিয়েছেন, বিজয় দেখেছেন তাদের কাছে সেই সব দিনের স্মৃতি জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সঞ্চয়। আমার কাছেও তাই। আমি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করতে পারিনি। তবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি সাংবাদিক এবং শব্দসৈনিক হিসেবে। ইতিহাসের সেই ক্রান্তিলগ্নে আমি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'বাংলার বাণী' সম্পাদনা করেছি এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সংবাদ পর্যালোচনার স্ক্রিপ্ট রচনা করেছি প্রতিদিন।

একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে ঢাকাতেই ছিলাম। ঢাকা ছেড়েছিলাম ২৭ মার্চ কারফিউ ওঠার পর। সেদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়ার পর অবরুদ্ধ নগরী থেকে বন্যার স্রোতের মতো মানুষ যে যেদিকে পারে বেরিয়ে যেতে থাকে। সেই অন্তহীন স্রোতে মিশে শহর থেকে বেরিয়ে যাই। আমার বাড়ি মাদারীপুরে। সেখান থেকে একটানা আট দিন আট রাত পায়ে হেঁটে মে মাসের এক কাকডাকা ভোরে বাগদা সীমান্ত পার হয়ে পৌঁছি পশ্চিমবঙ্গে। ক্লান্ত, অবসন্ন। তবে মনে ছিল নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছার স্বস্তি এবং আবার একদিন মুক্ত স্বদেশে ফেরার আশা।

সীমান্ত থেকে কিছু দূরেই বাগদা বাজার। সেখানে পৌঁছার পর কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল কলকাতা যাত্রার আয়োজনে। প্রথমে বাসে চড়ে যেতে হবে বনগাঁ। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা। এ পথে তখন প্রতিদিন হাজার হাজার নর-নারী-শিশু বনগাঁ যাচ্ছে। প্রচণ্ড ভিড়। বাসে ঠাঁই পেলাম না। শেষ পর্যন্ত সঙ্গী-সাথী মিলে একটা ট্রাক ভাড়া করলাম। বসে ছিলাম ড্রাইভারের পাশের সিটে। যাত্রার ঠিক আগ মুহূর্তে দেখি পাশেই লোকজনের ভিড়ে আটকে গেল একটা প্রাইভেট কার। বিস্ময় আর আনন্দের সঙ্গে দেখলাম সে গাড়িতে বসা জননেতা ফণীভূষণ মজুমদার, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও আমির হোসেন আমু। তারা ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি-প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। দ্রুত ট্রাক থেকে নেমে গাড়ির কাছে গেলাম। তারা বাগদায় এসেছিলেন শরণার্থীদের খোঁজখবর নিতে এবং তাদের যথাযথভাবে শরণার্থী শিবিরে তোলার কাজ তদারকি করতে।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরু হওয়ার পর দলে দলে মানুষ আশ্রয়ের জন্য পাশর্্ববর্তী ভারতে ছুটে যায়। বাংলাদেশের দুর্দিনের বন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার এবং ভারতের জনগণ দুর্গত বাঙালিদের দিকে উদার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসার জন্য সীমান্তের সর্বত্র গড়ে তোলা হয় বিপুলসংখ্যক আশ্রয়শিবির। সেগুলোর দেখাশোনা ও সাহায্য-তদারকির ভার দেওয়া হয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের। সে দায়িত্ব পালন করতেই ওই নেতারা সেদিন বাগদা গিয়েছিলেন। তারাই আমাদের প্রথমে বনগাঁ এবং পরে সেখান থেকে কলকাতায় যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার কর্মক্ষেত্র ছিল কাগজে-কলমে 'মুজিবনগর', তবে বাস্তবে কলকাতা। কারণ কলকাতাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনিক কর্মস্থল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার গঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। এ সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল। বেশ কিছু বিদেশি সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট দেশি-বিদেশি অতিথি এবং প্রধানত ১৯৭০ সালে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলায় এক বিশাল আমবাগানে। স্থানটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর, যা বাংলাদেশ সরকারের সদর দফতর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তবে বিপ্লবী সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হয় আসলে কলকাতা থেকে। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ছিল বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়। এখানেই বসতেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী।

আমি একাত্তরে ঢাকায় দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চলে যাই কলকাতায়। সেখানে থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করার নির্দেশ দেন। তার আগেই শেখ ফজলুল হক মণি দায়িত্ব দিয়েছিলেন সাপ্তাহিক 'বাংলার বাণী' পত্রিকা বের করার। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় আমি এই দুটো দায়িত্বই পালন করি।

স্বাধীন বাংলা বেতারের কার্যালয় ছিল বালিগঞ্জে, আর 'বাংলার বাণী'র অফিস ভবানীপুরে। এলগিন রোডে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বাড়ির অদূরে রাজেন্দ্র স্ট্রিটে একটি তিনতলা বাড়ির নিচতলায় ছিল 'বাংলার বাণী'র অফিস ও আমার থাকার ব্যবস্থা। 'বাংলার বাণী' কম্পোজ ও ছাপা হতো কলেজ স্ট্রিটের কালি প্রেসে। প্রথম দিকে সকালে স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য 'সংবাদ পর্যালোচনার' স্ক্রিপ্ট লিখে বালিগঞ্জে গিয়ে রেকর্ড করে আসতাম। সন্ধ্যায় তা প্রচারিত হতো। পরে শুধু স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়ে আসতাম। পড়তেন অন্যরা। কখনো আশরাফুল আলম, কখনো বাবুল আকতার, আবার কখনো পারভীন হোসেন।

স্বাধীন বাংলা বেতারের স্ক্রিপ্ট পৌঁছে দিয়ে চলে যেতাম কলেজ স্ট্রিট, আর ফিরতাম রাতে। এভাবেই চলছিল ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিন পর্যন্ত।

যে কোনো যুদ্ধে রণক্ষেত্রে সশস্ত্র লড়াইয়ের পাশাপাশি 'সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার' বা মনস্তাত্তি্বক লড়াইয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। শত্রুর মনোবল ভেঙে দিতে এবং সমর্থকদের উজ্জীবিত ও চাঙ্গা করার লক্ষ্যেই 'সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার' পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। দখলদার পাকিস্তানিরা সামরিক হামলার পাশাপাশি স্বাধীনতাকামী মানুষ বিশেষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক প্রচারযুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর জবাব দেওয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-আদর্শ প্রচার ও জনগণের সংগ্রামী চেতনা জোরদার করার জন্য বাঙালিরাও প্রচারযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের শিক্ষক, অধ্যাপক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রপত্রিকা এবং বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। জাতির সেই মরণপণ সংগ্রামের নয় মাসে শত্রুর অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব প্রদান এবং স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত করার ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সার্বিক পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান এমএনএ। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশবাসীকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করা এবং শত্রুপক্ষের প্রচার-প্রোপাগান্ডার জবাবদানের জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সংবাদ, সংবাদ ভাষ্য, সংবাদ পর্যালোচনা, কথিকা, নিবন্ধ, গল্প, নাটক, কবিতা, নকশা ইত্যাদি প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এ ব্যাপারে যারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে শওকত ওসমান, ড. আনিসুজ্জামান, ড. এ আর মলি্লক, ড. মজহারুল ইসলাম, সৈয়দ আলী আহসান, ড. খান সারওয়ার মুর্শিদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, রণেশ দাশগুপ্ত, এম আর আখতার মুকুল, ফয়েজ আহমদ, জহির রায়হান, সেকেন্দার আবু জাফর, অধ্যাপক আবদুল হাফিজ, অধ্যাপক বদরুল হাসান, গাজীউল হক, আলমগীর কবীর, আলী যাকের, ওয়াহিদুল হক, অজয় রায়, আবদুল তোয়াব খান, কামাল লোহানী, মহাদেব সাহা, মাহবুব তালুকদার, নির্মলেন্দু গুণ, সুব্রত বড়ুয়া, আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী, মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী, আমিনুল হক বাদশা, মোস্তফা মনোয়ার, পারভীন হোসেন, নাসরীন আহমদ, সলিমুল্লাহ, আমির হোসেন প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শিল্পীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, অজিত রায়, রথীন্দ্রনাথ রায়, কাদেরী কিবরিয়া, স্বপ্না রায়, রফিকুল হক, কল্যাণী ঘোষ, মঞ্জুর আহমদ, মান্না হক, অরূপ রতন চৌধুরীর নাম।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে স্বাধীন বাংলা বেতার ছিল বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামে অফুরন্ত উদ্দীপনা ও প্রেরণার উৎস। স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনাও ছিল বিপজ্জনক। ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি ছিল অবধারিত। তবু সেই উত্তাল দিনগুলোতে প্রতিদিন সূর্যাস্তের পর বাংলাদেশের মানুষ রেডিও ঘিরে বসত স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনার জন্য। শুনে বৃদ্ধি পেত তাদের মনোবল ও উদ্দীপনা। বিশেষ করে এম আর আখতার মুকুলের 'চরমপত্র' শোনার জন্য মানুষ সারাদিন অপেক্ষা করত কখন সন্ধ্যা হবে। শুধু বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এবং দেশান্তরী বাঙালিদের মধ্যেই নয়, চরমপত্র অনুষ্ঠানটি অসাধারণ জনপ্রিয় ছিল পশ্চিম বাংলার মানুষের মধ্যেও। চরমপত্র শোনার জন্য কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় পান-বিড়ির দোকানে ভিড় জমে যেত।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আরেকটি জনপ্রিয় বেতার অনুষ্ঠান ছিল 'আকাশ বাণী' কলকাতা থেকে প্রচারিত 'সংবাদ পরিক্রমা'। বেশির ভাগ দিনই সংবাদ পরিক্রমা লিখতেন প্রণবেশ সেন। আর প্রতিদিন দরাজ গলায় আবেগ দিয়ে পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সুলিখিত ও সুপঠিত 'সংবাদ পরিক্রমার' আবেদন ছিল বিপুল ও ব্যাপক।

এই সময়কার একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। সাপ্তাহিক 'বাংলার বাণী'র প্রথম পৃষ্ঠায় আমার লেখা 'মুজিব কারাগারে, মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে' শীর্ষক একটি বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল। 'আকাশ বাণীর' 'সংবাদ পরিক্রমা' অনুষ্ঠানে সম্পাদকীয়টি হুবহু পাঠ করে শোনান দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা ও বিভিন্ন মুক্ত এলাকা থেকে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আওয়ামী লীগের মুখপত্র 'জয়বাংলা', মুজিববাহিনীর মুখপত্র 'বাংলার বাণী', 'দি পিপল', 'জন্মভূমি', 'অভিযান', 'দাবানল', 'স্বাধীন বাংলা', 'বিপ্লবী বাংলাদেশ', 'বাংলার মুখ' প্রভৃতির নাম। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণার জন্য প্রকাশিত এসব পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো ছিল অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব পত্রিকা নিয়ে কেউ ধরা পড়লে তার একমাত্র শাস্তি ছিল তাৎক্ষণিক প্রাণদণ্ড। তবে তার মধ্যেও বিশেষ করে সাপ্তাহিক 'জয়বাংলা' ও 'বাংলার বাণী' পত্রিকা দুটি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে দেশের ভিতরে পাঠানো হতো।

'বাংলার বাণী' ছিল শেখ ফজলুল হক মণির পত্রিকা। সেই সময় 'বাংলার বাণী'র সম্পাদক হিসেবে মাঝে মধ্যেই আমাকে তার সঙ্গে বা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুবনেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে হতো। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মধ্য দিয়ে দুটি ব্যাপার আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এক. মুজিববাহিনীর নীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণের ক্ষেত্রে শেখ মণির ভূমিকাই মুখ্য। আর দুই. চার যুবনেতা বাংলাদেশ ইস্যুর ত্বরিত সামরিক সমাধানের বিরোধী ছিলেন। তারা চাইছিলেন আদর্শভিত্তিক কঠোর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে, যাতে এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-আদর্শবিরোধী পরগাছারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর সেভাবেই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অপরদিকে মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে দেশকে মুক্ত করা। তারা নানা কারণে চাইছিলেন না যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হোক। শেষ পর্যন্ত সরকারের লক্ষ্যই অর্জিত হয়।

কলকাতায় পৌঁছার পর প্রথম দেখা হয় শেখ মণি ও অন্য তিন যুবনেতার সঙ্গে। পরের দিনই ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে গিয়ে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন আমার সঙ্গে। তিনি আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করার নির্দেশ দেন। সেই অনুসারে স্বাধীন বাংলা বেতারে সংবাদ পর্যালোচনা শুরু করি। যুদ্ধ চলাকালে আরও কয়েকবার দেখা করেছি তার সঙ্গে। একাধিকবার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীর সঙ্গেও দেখা করেছি। তাদের সঙ্গে কথাবার্তায়, বিশেষ করে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলোচনায় মনে হয়েছে মুজিবনগর সরকারের নেতারা একটি বিষয় ভেবে উদ্বিগ্ন। সেটা হলো- যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে জনগণের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে এবং রাজনৈতিক শক্তির প্রভাব ও কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়তে পারে। এ জন্য তারা চাইছিলেন যত দ্রুত সম্ভব মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিণতিতে পৌঁছে দিতে।

এখানে উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে। সেই ধারাতেই সরকারের উদার সহায়তা পেয়েছে বিপ্লবী সরকার, মুক্তিযোদ্ধা এবং বেতার-পত্র-পত্রিকা। আর রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইকে বেগবান করার জন্য নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও যারা প্রচার মাধ্যমে কাজ করেছেন অকৃত্রিম দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার চেতনাই ছিল তাদের প্রেরণার উৎস। তবে কলকাতায় যে থিয়েটার রোডকে কেন্দ্র করে শুধু স্বাধীনতার লক্ষ্যেই সর্বাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে তা নয়, সেখানে বসে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্তও চালানো হয়েছে। এই কুচক্রীদের নাটের গুরু ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। তার বিশিষ্ট সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন মাহবুবুল আলম চাষী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ। স্বাধীনতার পরিবর্তে কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে আপসরফায় পৌঁছার জন্য মার্কিন কূটনীতিকদের সহযোগিতায় ষড়যন্ত্র করেছিলেন মোশতাক এবং তার সহচররা। তবে এটা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মোশতাকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং তাকে জাতিসংঘে লবিংয়ের জন্য প্রেরিত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধানের পদ থেকে বরখাস্ত করে প্রতিনিধি দল থেকেই বাদ দেওয়া হয়।

শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে শরণার্থী শিবিরের কথা বলেছি। এগুলোর সংখ্যা ছিল অনেক, পরিচালনা করতেন বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা। শিবিরগুলোতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল ঠিকই, তবে সমস্যা ছিল অনেক। বিশেষ করে সুপেয় পানি এবং ওষুধপথ্যের সংকট ছিল তীব্র। এক কোটি শরণার্থীর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা মোটেই কোনো সহজসাধ্য কাজ ছিল না। মানুষ কায়-ক্লেশে কোনোমতে থাকত এসব শিবিরে। এসব শিবিরে প্রাণভয়ে দেশত্যাগী বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের পাশাপাশি ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ব্যাকুল অগণিত তরুণ-যুবকও ছিল।

এমনি একটি শিবিরের একদিনের অভিজ্ঞতার কথা এখানে তুলে ধরছি। এই শরণার্থী শিবিরটি ছিল বনগাঁর চাঁদপাড়ায়। সেই যুদ্ধের বছর ঈদুল ফিতরের দিন। মুজিব বাহিনীর অন্যতম কর্ণধার, যুবনেতা আবদুর রাজ্জাক তখন কলকাতায়। সেদিন সকালে তিনি বললেন, 'চল চাঁদপাড়া ক্যাম্পে কাটাব ঈদের দিনটি'। তার সঙ্গে জিপে চড়ে কলকাতা থেকে বনগাঁ পৌঁছলাম। ঈদের দিন রাজ্জাক ভাইকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে সবাই খুব খুশি। দেখলাম তরুণ-যুবকদের অনেকের গায়ে জামা নেই, পায়ে নেই জুতা-স্যান্ডেল। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই কারোর। সবার মুখেই এক কথা, 'রাজ্জাক ভাই, আমাদের অবিলম্বে ট্রেনিংয়ে পাঠান।' তিনি আশ্বাস দিলেন, 'সে ব্যবস্থা হচ্ছে?'।

দুপুরে খেতে বসলাম সবাই একসঙ্গে। সারিবদ্ধভাবে। বহু লোক। শুরুটা ভালোই ছিল। কিন্তু শেষটা হলো অন্যরকম। খাবারের টান পড়ল। সামান্য বিশৃঙ্খলাও দেখা দিল। তবে শেষ পর্যন্ত সবকিছু আবার ঠিকঠাক হয়ে গেল। কিন্তু পেটপুরে খাওয়া হলো না বলতে গেলে কারোরই। সেদিন সেই ঈদের দিনেও না। ফলে মুখে কেউ কিছু না বললেও সবার মনেই জেগে রইল বেদনা বোধ। পরিবেশটাই হয়ে গেল বিষণ্ন।

বিকালে বিদায়ের আগে সবাই যুবনেতা আবদুর রাজ্জাককে ধরল কিছু বলার জন্য। তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। দেশের কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা, যুদ্ধের কথা, আদর্শের কথা বলতে গিয়ে একপর্যায়ে তিনি বললেন, 'আজ এই ঈদের দিনে আমরা পেটপুরে খেতে পাইনি। কিন্তু এ জন্য দুঃখ করলে চলবে না। কারণ, আমরা এখন দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। আমরা লড়াই করছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য, বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। শুধু ঈদের দিন নয়, প্রতিদিন, শুধু আমরাই নই, বাংলাদেশের সব মানুষ যাতে পেটভরে খেতে পায়, কাপড় পায়, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা পায় সে জন্যই আমরা লড়াই করছি। এ লড়াইয়ে আমরা জিতবই এবং স্বাধীনতা আমাদের ভাত-কাপড়, আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিও এনে দেবে। এ বিশ্বাস নিয়েই আমরা লড়ছি।

সেই বক্তৃতায় আবদুর রাজ্জাক ঠিকই বলেছিলেন। মাতৃভূমি পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হবে, স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ ভাত-কাপড় পাবে, মানুষের মতো বাঁচতে পারবে, এই স্বপ্ন আর বিশ্বাসে উজ্জীবিত হয়েই সেদিন জীবনপণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশবাসী। আজ ৪৩ বছর পর জোর দিয়েই বলা যায়, সম্পূর্ণভাবে না হোক, আংশিকভাবে হলেও বাংলার মানুষের সেই স্বপ্ন ও আশা পূরণ হয়েছে।

লেখক : সম্পাদক, ডেইলি সান।

 

 

 

সর্বশেষ খবর