বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

একাত্তরের শরণার্থী

একাত্তরের শরণার্থী

একাত্তরে অনেক রক্ত আর বেদনার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। নয় মাসের যুদ্ধে রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার সবুজ জমিন। পাকবাহিনীর রাইফেল, কামান, মেশিনগানের শব্দে কেঁপে ওঠে প্রতিটি জেলা শহর। আর এই পরিস্থিতিতে পূর্ববঙ্গের মানুষের দেশত্যাগের হিড়িক পড়ে। ঢাকা, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল প্রভৃতি জেলার মানুষের জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য হয়ে ওঠে মুখ্য আশ্রয় ঘাঁটি। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ভারতের আদমশুমারি অনুযায়ী ত্রিপুরা রাজ্যের মোট লোকসংখ্যা ছিল এক কোটি পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ৮২২ জন। অন্যদিকে আগরতলা শহরের লোকসংখ্যা ছিল ৫৯ হাজার ৬৮২ জন। অথচ মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশের শরণার্থীতে আগরতলার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়। আগরতলার সাংখু, ধর্মতলা, বিলোনিয়া, আগরতলা, কৈলাশ শহর, কসবা ও সোনামুড়া সীমান্তের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শরণার্থীরা আশ্রয় নেয়। ওই সময় রাজ্য সরকার চরম সংকটে পড়ে। তারপরও ভারতের জনগণ বন্ধুর মতো পাশে দাঁড়িয়েছিল। মে থেকে শরণার্থীর সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। ২১ মে লম্বছড়ার এক শরণার্থী শিবিরে গিয়ে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র সিংহ বলেন, 'পূর্ব বাংলার আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলন, গণতন্ত্রের আন্দোলন। পৃথিবীর কোনো স্বৈরশক্তি এই আন্দোলন দমন করতে পারবে না। এ আন্দোলন জয়যুক্ত হবেই।' নভেম্বরে ত্রিপুরার শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেয় প্রায় নয় লাখ শরণার্থী। ত্রিপুরায় ওই সময় লোকসংখ্যা ছিল ১৬ লাখ। ডিসেম্বরে মাত্র চার হাজার বর্গমাইল এলাকায় বাংলাদেশের ১৫ লাখ শরণার্থী সেখানে আশ্রয় নেয়। পূর্ব বাংলার ভাষা, সংস্কৃতিতে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিল ত্রিপুরাবাসী। অন্যদিকে বর্বর পাকবাহিনী সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী শিবিরেও গুলি চালিয়েছিল। ওই সময় দুজন শরণার্থী নিহত হন। আহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। আগরতলার জলিলপুরে এক শরণার্থী শিবিরে পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন ১৩ শরণার্থী। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ভারত সরকার ওই সময় নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছিল। ২৬ মার্চ লোকসভায় অধ্যাপক সমর গুহ বাংলাদেশের শরণার্থী ও সহযোগিতা বিষয়ে বিল উত্থাপন করেন। তিনি আকাশবাণীতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণার দাবি জানান। এ প্রচারণায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ ঢাকা থেকে বহিষ্কৃত বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতিবেদন সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক লোকসভায় উত্থাপিত বাংলাদেশ সম্বন্ধীয় রেজুলেশন গৃহীত হয়। ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করতে নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সন্তোষজনক পদক্ষেপ নেয়নি। আগরতলায় শরণার্থী শিবিরে একটি নার্সিং ইউনিট তৈরি করা হয়। ওই ক্যাম্প থেকে খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়া হতো। শিবিরে মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের একটি চিত্রকলা প্রদর্শনী হয়, যা সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী শিবির থেকে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ। এ দলে যুক্ত ছিলেন ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, মুস্তাফা মনোয়ার, সৈয়দ হাসান ইমাম প্রমুখ। তারা গান গেয়ে, আবৃত্তি করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করত। কখনো আর্থিক সহযোগিতা তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা হতো। একাত্তরের শরণার্থী শিবির থেকে রচিত হয়েছিল যুদ্ধযুদ্ধের বীজমন্ত্র। বিজয়ের ৪০ বছর পরও তা অক্ষুণ্ন রয়েছে। শেখ মেহেদী হাসান

 

 

সর্বশেষ খবর