শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

কবি ও কবিতা

অনুপম সেন

কবি ও কবিতা

কবিতায় মানুষ মর্তের সীমানা অতিক্রম করে, অমৃতের স্পর্শ পায়। কবিতা মানুষের মৃত্যুঞ্জয়ী অর্জন। শব্দের অসাধারণ শক্তি ছন্দের উন্মুক্ত পাখায় আরূঢ় হয়ে মানুষকে যে অগম্যলোকের অভিসারী করে, তার বিস্তার এত সুদূরপ্রসারী এবং গভীর যে, যিনি এই ছন্দোবদ্ধ শব্দরাজির স্রষ্টা তিনি যেন অসীমের স্রষ্টা। কবি অসম্ভবকে সম্ভব করেন। কবির কল্পনা জগৎ ও সংসারকে এমনভাবে আলোড়িত, মানুষকে এমনভাবে দুঃখবেদনা ও আনন্দে আন্দোলিত করতে পারে যে, তার আবেদন, অনেক সময় বাস্তবের সীমাবেষ্টিত আনন্দবেদনা ও দুঃখের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র ও মর্মস্পশী হতে পারে। তা স্থান-কালকে অতিক্রম করে ব্যক্তিবোধের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজনীনবোধে রূপান্তরিত হয়। কবির এই শক্তি আছে বলেই তিনি মহৎ। তিনিই আমাদের প্রতিদিনের জাগতিক ঘটনাগুলোর অনুভবকে অনন্তের জগতে, অমৃতের জগতে, অনির্বচনীয় সুধার জগতে এবং অভূতপূর্ব বোধের জগতে নিয়ে যান।

একজন মহৎ কবি, সাহিত্যিক বা শিল্পী আমাদের চারপাশের যে-জগৎ এমনকি মনের গহনের যে-জগৎ, যে-জগৎকে আমরা চিনি না, তাকে আমাদের সামনে এমনভাবে উদ্ভাসিত করেন যে, তার আলোকে আমরা আমাদের নতুন করে চিনি, নতুন করে দেখি। তাই আমরা দস্তয়ভস্কির উপন্যাস, শেকসপিয়রের নাটক পড়ে বা রবীন্দ্রনাথের গান শুনে যে-বোধে উদ্ভাসিত হই তা মর্তলোকের হয়েও অমরাবতীর।

নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ বা মহৎ গদ্য সবই কাব্যগুণে ঋদ্ধ বা কবিতা হয়, যখন তা বাস্তব জগৎ সম্পৃক্ত হয়েও পাঠকের মনের অতলান্ত অনির্বচনীয় সুপ্তবোধকে জাগ্রত করে। এই বোধ কবিরই বোধ। এই বোধ একই সঙ্গে অলৌকিক আনন্দের ও বেদনার।

এই উপলব্ধি থেকেই শেলির কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts’; একই ভাবনায় রবীন্দ্রনাথও বলেন, 'অলৌকিক আনন্দের ভার, বিধাতা যাহারে দেন, তার বক্ষে বেদনা অপার তার নিত্য জাগরণ।' কবি নিত্যজাগ্রত বলেই যা আপাতদৃষ্টে প্রচণ্ড কুৎসিত, বীভৎস, ভাঙ্গাচোরা বা দীর্ণ তা মানুষই হোক বা প্রকৃতিই হোক, কবির চৈতন্যে আলো ছড়ায়। সুন্দর ও কুৎসিতের সেখানে পাশাপাশি অবস্থান। সেখানে কখন সুন্দর কুৎসিত এবং কুৎসিত সুন্দর হয় বলা কঠিন। সেই সুন্দর ও কুৎসিতের অবস্থান যেমন বাইরের প্রকৃতিতে তেমনি আমাদের অন্তরেও। সেখানে আমরা যেমন পাই হেলেন, দ্রৌপদী, তিলোত্তমা, উর্বশী, ভেনাস, এডোনিস ও এপোলোকে, তেমনি দেখি সুর্পণখা, কুম্ভকর্ণ, ইয়াগো, তামোরা, কোয়সিমোদো ও ডোরিয়ান গ্রে-কে। বস্তুত কবি ও শিল্পীর কল্পলোকের সন্ধান অসম্ভব। কারণ তারা যেমন বাস্তবের দ্রষ্টা, তেমনি সেই বাস্তবের মধ্যে যে অচিন্তনীয়, অভূতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব রয়েছে তারও দ্রষ্টা ও স্রষ্টা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে, কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।' এর চেয়ে কবির বড় পরিচয় আর কী হতে পারে!

কবির সত্য, বাস্তবের সত্য বা প্রতিদিনের যে-সত্য তার চেয়ে অনেক বড় সত্য এই অর্থে যে তা আমাদের দিন যাপনের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ, মহৎ ও তুচ্ছ, সত্য ও মিথ্যার ঘটনাগুলোকে নতুন ব্যঞ্জনায় তুলে ধরে। আমাদের জীবনবোধে নতুন অর্থের বিস্তার ঘটায়। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, দারিদ্র্যের মধ্যে যে মর্মন্তুদ বেদনা, রিক্ততা, বঞ্চনা ও হাহাকার রয়েছে কবির বাণীতে তার প্রকাশ হয় এভাবে, 'পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি' (সুকান্ত) অথবা- 'চেরাপুঞ্জির থেকে একখানি মেঘ ধার দিতে পারো গোবি সাহারার বুকে' (যতীন্দ্রনাথ) একটু ছোঁয়া একটু কথার মধ্য দিয়ে প্রেমকে কবি অপরূপ করে তোলেন, 'একটু ছোঁয়া লাগে একটু কথা শুনি, তাই দিয়ে মনে মনে রচি যম ফাল্গুন' (রবীন্দ্রনাথ)। উদ্ধৃত এই পঙ্ক্তিগুলোর মধ্যে কেবল আবেগই নয়, রয়েছে অসামান্য উপলব্ধি ও বুদ্ধির প্রকাশ, রয়েছে জীবনের পূর্ণতার জন্য হাহাকার।

কবির অসাধারণ কল্পনার বিস্তার, সৃষ্টিশক্তি ও বাস্তবের সীমারেখাকে অতিক্রম করে যাওয়ার দিব্যদৃষ্টিকে দার্শনিকরাও ভয়ের চোখে দেখেছেন। প্লেটো, তার গণরাজ্য বা রিপাবলিক থেকে কবিদের বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন। কবিদের সম্পর্কে প্লেটোর শঙ্কা অমূলক ছিল না। কবিরা বাস্তবের দাস নয়। তাই যখন প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা তৎকালীন গ্রিক সমাজের দাস ব্যবস্থাকে প্রকৃতির মতো অলঙ্ঘনীয় ভেবেছিলেন, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি ভেবেছিলেন, ইউরিপিডিস এই ব্যবস্থার বিলোপ চেয়েছিলেন। যারা প্রকৃত কবি প্রচলিত সমাজব্যবস্থার মধ্যে মনুষ্যত্বের অবমাননা তাদের ব্যথিত না করে পারে না। তারা সবসময় মানুষকে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে চান। কবির কণ্ঠেই তাই আমরা শুনি, 'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই' (চণ্ডীদাস); 'কবি, তবে উঠে এসো- যদি থাকে প্রাণ তবে তাই লহো সাথে, তবে তাই করো আজি দান। অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু। চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু সাহস বিস্তৃত বক্ষপট। এ দৈন্য-মাঝারে, কবি একবার নিয়ে এসো স্বর্গ হতে বিশ্বাসের ছবি' (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

কবিরা যে সবসময় এরকম প্রত্যক্ষভাবে সমাজের বন্ধন ও গণ্ডিকে ভেঙে মানুষকে মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষা দেন, তা নয়। কিন্তু যেখানে তাদের সৃষ্টি যথার্থ কবিতা হয়ে ওঠে, সেখানে তারা যদি খল চরিত্রও সৃষ্টি করেন সেই চরিত্রের মালিন্যের মধ্য দিয়েও মানুষের স্বমহিমা উদ্ভাসিত হয়, যেমন শেকসপিয়রের শাইলক। কবির নীরব অশ্রু কি ধিকৃত নিষ্পেষিত শাইলকের জন্য ঝরে নি! কবি কি দেখেন নি শাইলক ও তার সহধর্মীদের মানবিক মূল্যবোধের অভাব তাদের নিগৃহীত জীবনের মানবিক পরিমণ্ডলেই। ব্যক্তি বালজাকের সহানুভূতি ছিল ফরাসি রাজতন্ত্রের প্রতি, কিন্তু তার সৃষ্ট-সমাজ ও চরিত্রগুলো কি এই সমাজের শ্বাসরুদ্ধকর অবক্ষয়কে প্রকাশ করে নি! কবিরা, শিল্পীরা যখন বাস্তবকে তার আংশিকতায় বা সার্বিকতায় তুলে ধরতে সচেষ্ট হন, তখন তারা এই বাস্তবের মধ্যে যা নেই তারও ইঙ্গিত দিয়ে যান। একজন প্রকৃত স্রষ্টা, যিনি কবি, তিনি জানেন বাস্তবকে বা বর্তমানকে কেবলমাত্র বাস্তবের আলোকে সৃজন করা যায় না। কারণ বর্তমানের, বাস্তবের গ্লানি-অবক্ষয়ের উদ্ঘাটনের মধ্যেই রয়েছে মানুষের যথার্থ মুক্তি ও স্বাধীনতাকে উন্মোচন করার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ; যা-আছে তারই মধ্যে রয়েছে যা-নেই তার শেকড় এবং তার জন্যই যথার্থ কবি-হৃদয়ের হাহাকার। তারা মানুষের ও প্রকৃতির মধ্যে পূর্ণতা খোঁজেন বলেই তাদের মধ্যে সবসময় একটা বিয়োগবোধ কাজ করে; এই বিয়োগবোধ বর্তমানের, পারিপাশ্বর্িকের সীমাবদ্ধতার মধ্যে; মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের অপূর্ণতায়। এই বিয়োগবোধ থেকে কবি কালিদাস বলেছেন, সুন্দরকে দেখে অথবা মধুর-শব্দ শুনে আমার মনে যুগযুগান্তরের স্মৃতি উদ্বেল হয়ে ওঠে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-

'নারিকেল দলগুলি কাঁপে বায়ুভরে

আলোকে ঝিকিয়া। জাগে মহাব্যাকুলতা

মনে পড়ে বুঝি সেই দিবসের কথা

মন যবে ছিল মোর সর্বব্যাপী হয়ে।'

ওয়াল্ট হুইটম্যান মানুষ ও মানুষ, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এই বিচ্ছেদ মেটানোর ভার কবিকেই দিয়েছেন।

'‘All these separations and gaps shall be taken up and hooked and linked together,
The whole earth, this cold, impassive, voiceless earth, shall be completely justified,
Trinitas divine shall be gloriously accomplish’d and compacted by the true son fo God, the poet
Nature and Man shall be disjoin’d and diffused no more.’

কবিদের এই যে নাস্তির অনুসন্ধান, বাস্তবের বন্ধনকে অতিক্রম করে পূর্ণতার জন্য আর্তি, তার তীব্র গভীর প্রকাশ দেখি শিল্প পুঁজির বিকাশের পরেই। বদলেয়ার, মালার্মে, এলুয়ার, অাঁরগ, ইয়েটস, ইলিয়ট, অডেনের কাব্য সাধনায়, পরাবাস্তববাদীদের কবিতায় ও শিল্পকৃতিত্বে। ঘটনা ও কালকে উলঙ্ঘন করার এই প্রয়াস আরও স্পষ্ট হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার বিশেষত মার্কজের জাদুবাস্তববাদী রচনায়। কবিরা সংবেদনশীল বলে তারা যখন দুচোখ মেলে চারপাশে তাকিয়েছেন, যা দেখেছেন তা তাদের ব্যথিত করেছে, যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছে। এই যন্ত্রণা থেকে, মানুষ থেকে মানুষের, মানুষ থেকে প্রকৃতির এই বিচ্ছেদ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সব মহৎ কাব্য ও কবিতা।

কবিদের সংবেদনশীলতার মূলে রয়েছে সুতীব্র জীবন-পিপাসা। তারা রূপ-রসগন্ধময় পৃথিবী থেকে অঞ্জলিভরে দান গ্রহণ করে পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জীবনের যে আরতি করেন, তারই প্রকাশ ঘটে কবিতায় ও শিল্পে। কবি যে বলেন, ‘I have immortal longings in me.’ (শেকসপিয়র), জীবনের সেই অমর-পিপাসাই কবিদের দিব্য-দৃষ্টিসম্পন্ন করে, চারপাশের জগৎকে অতিক্রম করার সাহস দেয়। এই জীবনবোধের রসিক হয়েই কবি বিভূতিভূষণের অপু সংসারে বারবার পরাজিত হয়েও জীবনের ক্ষেত্রে অপরাজিত।

 

সর্বশেষ খবর