শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

ক্ষণজন্মা বাঙালি শিল্পী এস এম সুলতান

ফখরে আলম

ক্ষণজন্মা বাঙালি শিল্পী এস এম সুলতান

১৮ বছর বয়সে ১৯৪১ সালের দিকে সুলতান নড়াইলের অন্ধকার গ্রাম মাছিমদিয়া থেকে কলকাতা চলে যান। কলকাতা আর্ট কলেজে কিছুদিন লেখাপড়ার পর তিনি ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড ঘুরেছেন। পৃথিবীর খ্যাতিমান শিল্পীদের সঙ্গে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। ইউরোপের চিত্রকর্মের রূপ দেখে ১৯৫৩ সালে সুলতান দেশে ফিরে আসেন। শুরু হয় তার নতুন জীবন। সুলতান কৃষক, জেলের আত্দা শরীরে ধারণ করে মাসের পর মাস জেলেপলি্লতে কাটিয়েছেন। কৃষকের বীজবপন, ফসল রক্ষা করা, ফসল কাটা এ দৃশ্য খুব কাছ থেকে দেখেছেন। মাছ ধরার উৎসবে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেও পোলো দিয়ে শৈল, বোয়াল মাছ ধরেছেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৫ এই সময় সুলতান যশোর ও নড়াইলের বেশকিছু জেলে ও কৃষিপলি্লতে থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। খুব কাছ থেকে কৃষক জেলের 'নামতা' মুখস্থ করে সুলতান ছবি অাঁকার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। অাঁকা শুরু করেন পেশিময় কৃষক আর জেলে। ১৯৫৩ সালের আগে সুলতান এমন পেশিময় মানুষের ছবি অাঁকেননি।

আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমার সঙ্গে সুলতানের পরিচয় হয়। ১৯৮২ সালে তিনি অনেক বড় ক্যানভাসে 'জেলের জীবন' ছবিটি অাঁকেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী চিত্রকর্মে আমি দেখেছি জেলেরা উৎসব করে মাছ ধরছে। সব জেলে পেশিময়। এমনকি মাছও খুব হৃষ্টপুষ্ট। ছবিতে পেশিময় জেলে রমণীও ছিল। সম্ভবত, এ ছবিটি হারিয়ে গেছে কিংবা তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে এমন মাছ ধরার আরেকটি ছবি তিনি অাঁকেন। এ ছবিটিও আমি দেখেছি। ১৯৯৪ সালে সুলতান 'মাছ ধরা' নামের আরেকটি ছবি অাঁকেন। এ বছর ১০ অক্টোবর তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পেশিময় জেলের শরীরে রং ছড়িয়েছেন। কিন্তু ছবিটি সম্পন্ন হয়নি। তার ছবিতে উঠে এসেছে সাজানো-গোছানো পরিপাটি গ্রাম। গ্রামের পাশে প্রবাহমান জলকর। সেখানে গ্রামের মানুষ মাছ ধরছে। কৃষক জেলে পোলো, জাল, বর্শা নিয়ে মাছ ধরতে নেমেছে। মাছ ধরার এই উৎসবে নারীরাও অংশ নিয়েছে। আনন্দ করে হৈ-হল্লা করে মাছ ধরছে। এই উৎসবের সব মানুষ পেশিময়। শক্তপোক্ত। মাথায় বাবরি চুল। কেউ কেউ ফ্যাটা বেঁধে রেখেছে। উদোম শরীর। শুধু সামান্য বস্ত্র দিয়ে নিম্নাঙ্গ ঢাকা। নারীদের পোশাকও একই রকম। জেলে রমণী 'কাঁছা' বেঁধে মাছ ধরছে। তারাও খুব স্বাস্থ্যবান। বলবান। সুলতানের সঙ্গে মাছ ধরা উৎসব নিয়ে, জেলের জীবন নিয়ে মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও আমার কথা হয়েছে। সুলতান বলেছেন, 'আমার ছবির মতোই জেলেরা মনেপ্রাণে পেশিময়। আমি আবহমান কালের বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য মন থেকে ক্যানভাসে এঁকেছি। আমাদের মাছ ধরার বিষয়টি উৎসবের। খালবিল, নদীনালা ভরা মাছ আর মাছ। জেলেরা স্বাধীনভাবে সেখানে মাছ ধরে। কিন্তু এখন আইন করে নদীতে নামা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, জাল যার জলা তার। কিন্তু জেলের হাতে জাল নেই। সরকার মুক্ত জলকরে মাছ ছাড়ছে। টাউট মধ্যস্বত্বভোগী সুবিধাবাদীরা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। জেলেরা তাদের বাড়ির পাশের খালবিলে নামতে পারছে না। তাদের পূর্বপুরুষের পেশা থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। জেলেরা কোনো দিনই রুগ্ন ছিল না। চক্রান্ত করে তাদের রুগ্ন রাখা হয়েছে। আমি মাছ ধরার আমাদের গ্রাম বাংলার চিরকালীন উৎসবকে ক্যানভাসে ধরে রেখেছি। জেলেদের জীবন-সংগ্রাম আমার ছবির বিষয়।' সুলতানের সঙ্গে তার চিত্রকর্ম নিয়ে নানা সময় কথা বলেছি। কিন্তু তিনি খুবই দৃঢ়তার সঙ্গে ছবি সম্পর্কে একই রকম বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। আমি প্রশ্ন করি, আপনার ছবির মানুষ সব সময় গর্জে ওঠে। এরা পেশিময়। বাংলাদেশের কৃষক জেলে শ্রমিকের সঙ্গে আপনার ছবির মিল কোথায়? তিনি বলেছেন, 'আমার দেশের মানুষ পেশিময়। সব বাঙালি আমার দৃষ্টিতে শক্তিশালী। এদের স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। খাবার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। হাতিয়ার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করে এদের দমিয়ে রাখা হচ্ছে। শারীরিক দিক দিয়ে পুষ্টিহীনতা, রোগা লিকলিকে এই মানুষদের ছবি আমরা সচারচার দেখতে পেলেও আমাদের দেখায় ভুল রয়েছে। আসলে এরা আমার চিত্রকর্মের মতোই পেশিময়। এ জন্যে আমি এ দেশের মানুষকে তুলির অাঁচড়ে পেশিময় করি। তাদের শরীরে খাঁটি রং ছড়াই।

প্রকৃত চেহারা এঁকে আমি বাঙালির ভেতরে বিদ্রোহ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি।' আপনি কেন ছবি অাঁকেন? সুলতান তার বিখ্যাত ছবি 'ফাস্ট প্লানটেশন' সম্পর্কে বলেছেন, 'ছবিটিতে আমি দেখিয়েছি আদম মাটির কাছে এসেছেন। পেশিময় হাতে বৃক্ষ রোপণ করছেন। এর মানে হচ্ছে আদম পুরো সভ্যতাকে রক্ষা করছেন।' সুলতানের ছবির বিষয় আবহমান বাংলা। বাংলার কৃষক, জেলে, গৃহবধূ, বেঁদে তার চিত্রকর্মে বারবার ফুটে উঠেছে। তিনি প্রকৃত বাঙালিকে চিত্রিত করেছেন। ইতিহাসকে ধরে রেখেছেন।

 

 

সর্বশেষ খবর