মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নিরাপত্তায় ডিজিটাল চোখ

লাকমিনা জেসমিন সোমা

নিরাপত্তায় ডিজিটাল চোখ

ঢাকা মহানগরীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি উদ্যোগে বৃদ্ধি পেয়েছে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার ছবি : জয়ীতা রায়

ঘড়িতে সময় তখন রাত ১টা বেজে ৬ মিনিট। গুলশানের প্রধান সড়কগুলোতে লোক চলাচল অনেকটাই কম। এলাকার অভিজাত শপিংমল ‘শপার্স ওয়ার্ল্ডে’ তখনো অবস্থান করছিল কিছু ক্রেতা। রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে সেদিকেই যাচ্ছিলেন ঢাকার যুবলীগ নেতা সিরাজুল হক মিল্কী। হঠাৎ মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করল সাদা পাঞ্জাবি পরা এক ঘাতক। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মিল্কী। বাঁচার আশায় শেষবারের মতো উঠে দাঁড়াতে গেলেন। কিন্তু পারলেন না। ঘাতকের উপর্যুপরি গুলিতে মুহূর্তেই নিথর হয়ে পড়ে রইল তার দেহটি। সহযোগিতাকারী অপর ঘাতকের সঙ্গে মোটরসাইকেলে পালিয়ে গেলেন মূল ঘাতক। পুরো দৃশ্যটি ধারণ হলো শপিংমলের সামনে থাকা সিসি (ক্লোজ সার্কিট) ক্যামেরায়। ২০১৩ সালের এই সিনেমাটিক খুনের ঘটনা দেখেছিল সবাই। শুধু তাই নয়, ওই রাতেই অভিযান চালিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মূল ঘাতককে গ্রেফতার করতে পেরেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল ডিজিটাল চোখ তথা সিসি ক্যামেরার কল্যাণে। দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ ঘটনার পর থেকেই মূলত ঢাকা মহানগরীর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি উদ্যোগে বৃদ্ধি পায় সিসি ক্যামেরার ব্যবহার। গত বৃহস্পতিবারও রাজধানীর ওয়ারীর স্বামীবাগ এলাকায় রিয়াদ হোসেন নামে এক কিশোরকে খুন করে ‘ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত হওয়ার নাটক’ সাজানোর চেষ্টা করে হত্যাকারীরা। পরে ঘটনাস্থলে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে আসল তথ্য বেরিয়ে আসে। পুলিশ জানতে পারে, ‘ঘরোয়া হোটেলের’ মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেলসহ ৬-৭ জন মিলেই খুন করেছিল নিজেদের হোটেলের কর্মচারী রিয়াদকে। এভাবেই সাম্প্রতিককালে বড় বড় হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ প্রমাণ ধরে রাখছে সিসি ক্যামেরা। সে কারণে ক্রমবর্ধমান অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের নিরাপত্তার তাগিদে এই ক্যামেরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে রাজধানীর মানুষ। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।

জানা যায়, রাজধানীতে প্রথম ১৯৯৮ সালে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নেয় পুলিশ। এরপর ২০১০ সালের জুনে নগরীর ৫৯টি পয়েন্টে ১৫৫টি ক্যামেরা ও ৩১টি ডিসপ্লে বোর্ড স্থাপন করে সরকার। ‘নাইটিভিশন’ বৈশিষ্ট্যের এসব ক্যামেরা ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে মুভ করতে পারে এবং ২০০ মিটার পর্যন্ত দূরের দৃশ্য কাছে আনতে পারে। কিন্তু তারপরও ২০১২ সালের ৫ মার্চ গুলশানে খুন হন সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলী। ঘটনার পর কূটনৈতিক জোনকে আরও সুরক্ষিত করতে নতুন করে বৃহৎ পরিসরে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অবশেষে ১৪ মে গুলশান, বারিধারা এবং নিকেতনে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি মনিটরিং ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ১০০ সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। জানা গেছে, পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্পের আওতায় আরও ৭০০টি ক্যামেরা লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলো মনিটরিং করছে মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ছাড়াও গুলশান, বারিধারা এবং নিকেতন সোসাইটির প্রতিনিধিরা।

কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই নয়, প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বাড়ছে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার। এরই অংশ হিসেবে ওয়ার্ডবাসীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্প্রতি ৮০টি সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন দক্ষিণ সিটির এক নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওয়াহিদুল ইসলাম মিল্টন। কাউন্সিলরের কার্যালয়, জাগরণী সংসদ এবং একতা কেবল অপারেটরের কার্যালয় থেকে এগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে। সরেজমিন দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সি ব্লক, এ ব্লকসহ বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক লাইন ও খুঁটিতে লাগানো হয়েছে এসব ক্যামেরা। এতে ওই এলাকার ৮০ ভাগ চুরি-ছিনতাই কমে গেছে বলে জানান স্থানীয়রা। কাউন্সিলর মিল্টন জানান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই তিনি আরও ২০টি ক্যামেরা স্থাপনের ব্যবস্থা করছেন। একইভাবে দক্ষিণ সিটির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিরাপত্তায়ও বসানো হয়েছে ৪৩টি সিসি ক্যামেরা। এখানেও কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ক্যামেরাগুলো বসিয়েছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, পুরান ঢাকার লালবাগ সড়ক, পলাশীবাজার, আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন স্থান ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সামনে এ ক্যামেরাগুলো বসানো হয়েছে। কাউন্সিলর অফিস থেকেই এগুলোর চিত্র পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যদিও এটি খুব শিগগিরই স্থানীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন কাউন্সিলর হাসিবুর। এলাকাবাসী বলেন, সিসি ক্যামেরা বসানোর ফলে এই এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক সেবন, ইভ টিজিংসহ নানা অপরাধ  অনেক কমেছে। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং শপিংমলগুলো ঘুরে সিসি ক্যামেরার এমন বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে অনেকে বলছেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড বাড়ছে তাতে এই তিন-চারশ সিসি ক্যামেরা দিয়ে মোটেও নগরীর আইনশৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণ কিংবা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া সিসি ক্যামেরাগুলো ভিআইপি এলাকায় থাকায় বাড্ডা-রামপুরা-বনশ্রীর মতো বহু এলাকায় অপরাধপ্রবণতা কমছে না। বরং পর্যবেক্ষণের অভাবে দিন দিন আরও বাড়ছে।

অন্যদিকে প্রথম দফায় পুলিশ যে ১৫৫টি ক্যামেরা বসিয়েছিল সেগুলোর অধিকাংশই এখন নষ্ট।  অকেজো এসব ডিভাইস নগরবাসীর নিরাপত্তায় কোনো কাজেই আসছে না।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর