বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

এক কিংবদন্তি সু চির গল্প

র ণ ক ই ক রা ম

এক কিংবদন্তি সু চির গল্প

দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি কেমন মানুষ। মুখে সারাক্ষণই মৃদু হাসি। শরীরের গড়নও মিয়ানমারের অন্য আট-দশজন সাধারণ নারীর মতো। কিন্তু তিনি মোটেও সাধারণ কেউ নন। মনের ভিতর তার বজ্রকঠিন শপথ। সম্মান করে অনেকেই তাকে সম্বোধন করেন ‘দ্য লেডি’। রাজনৈতিক জীবনের ২০ বছরের মধ্যে ১৫ বছরই কেটেছে বন্দীদশায়। কখনো গৃহবন্দী কখনো বা কারাগারে। এর বাইরেও যন্ত্রণা আর বঞ্চনার শেষ ছিল না। কিন্তু তিনি তবুও অবিচল থেকেছেন। নিজের শপথ থেকে নড়েননি একচুলও। জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশে গণতন্ত্রের পতাকা ওড়ানোর শপথটা তার মধ্যে ছিল অবিচ্ছেদ্যভাবে। তিনি অং সান সু চি। আফ্রিকানদের পরাজয়ের শেকল থেকে মুক্ত করতে যেমন লড়াই করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা, ঠিক তেমনি মিয়ানমারের জন্য সু চি। মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়ী শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)।

এই বিজয়ের মাধ্যমে সার্থক হলো তার ২৫ বছরের সংগ্রামের। আজ সেই জীবন্ত কিংবদন্তি সু চির গল্প।

 

 

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

সাবেক বার্মায় অং সান ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক। সু চির শরীরে সেই মহানায়কের রক্ত বইছে। সু চির জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন ইয়াঙ্গুনে। তিনি ছিলেন তার পরিবারের তৃতীয় সন্তান। জন্মের মাত্র দুই বছর পরই মিয়ানমারের স্বাধীনতা লাভের বছরে আততায়ীর গুলিতে মারা যান সু চির বাবা অং সান। মা খিন-চি মানুষ করতে লাগলেন সু চি ও তার দুই ভাই সান লিন ও সান উ-কে। কিন্তু ট্র্যাজেডি যেন ছেলেবেলায়ই সু চিকে বিদ্ধ করতে ওতপেতে বসেছিল। প্রিয় ভাই সান লিন মাত্র আট বছর বয়সে পানিতে ডুবে মারা গেল। ষাটের দশকের গোড়ায় ভারত ও নেপালে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন খিন-চি। সে সুবাদে ভারতে পড়তে আসেন সু চি। প্রথম দিলি­র লেডি শ্রীরাম কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে ভর্তি হন সু চি। এরপর রাজনীতি দর্শন ও অর্থনীতি নিয়ে পড়তে সোজা অক্সফোর্ডে পাড়ি দেন।

নামকরণ

অং সান সু চি নিজ পরিবারের তিন সদস্যের কাছ থেকে তার নামের পদবি গ্রহণ করেন। তার পিতার কাছ থেকে ‘অং সান’, তার পিতার নানী থেকে ‘সু’ এবং ‘চি’ তার মা খিন চির থেকে। তাকে প্রায়ই ডাউ অং সান সু চি নামে ডাকা হয়। তবে উচ্চারণের ক্ষেত্রে কেউ কেউ অং সান সু কিও করে থাকেন। এ ছাড়া তার রাজনৈতিক ত্যাগের জন্য তাকে এশিয়ার ম্যান্ডেলা নামে ডাকা হয়।

 

যোগ্য বাবার কন্যা

সু চির বাবা অং সান ছিলেন মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা ও সমরনায়ক। মিয়ানমারের নাটমাউক শহরে জন্ম নেওয়া অং সান ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাজনীতিতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি ‘অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট পিপল্স ফ্রিডম লিগ’ এই সংগঠনই মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। তিনি ১৯৪৫ সালে মিয়ানমারের জাতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হন এবং মিত্রবাহিনীর সঙ্গে একাত্ত্বতা ঘোষণা করেন। ১৯৪৭ সালে তার দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং দলটি মিয়ানমারের পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দেয়। ১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই মিয়ানমারের স্বাধীনতা-চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র ছয় মাস আগে আততায়ীর গুলিতে অং সান ও তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী নিহত হন।

সুখবঞ্চিত ব্যক্তিগত জীবন

রাজনীতিবিদ নন, সাধারণ গৃহবধূ হিসেবেই জীবন শুরু করেছিলেন সু চি। ব্রিটিশ নাগরিক মাইকেল অ্যারিসকে বিয়ে করেন। ১৯৭১ সালে। বিয়ের এক বছর পরই প্রথম সন্তান আলেক্সান্ডারের জন্ম। দ্বিতীয় সন্তান কিমের জন্ম ১৯৭৭ সালে। ১৯৮৮ সালে তার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে ছুটে আসেন দেশে।

মৃত্যুপথযাত্রী মাকে শেষবারের মতো দেখতে আসাই তার জীবনের টার্নিং পয়েন্টে জড়িয়ে পড়লেন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। এরপর ১৯৮৯ সালে গৃহবন্দী করা হলো তাকে। পারিবারিক জীবনেরও সমাপ্তি ঘটল সেখানেই। এরপর প্রায় দুই দশক গৃহবন্দী ও কারাগারে কাটালেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে শেষ দেখা ১৯৯৫ সালের বড়দিনে হলেও ছেলেদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এর চার বছর পর স্বামী মারা যান। ২০১০ সালে ১২ বছরের মধ্যে প্রথম ছোট ছেলে কিমের সাক্ষাৎ পান। চাইলেই তিনি মুক্তি পেতে পারতেন। কিন্তু স্বামী-সন্তানকে দেখতে একবার দেশ ছাড়লে আর কখনোই তাকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তাই দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে বন্দী জীবনকেই বেছে নিলেন। বিয়ের আগে স্বামী মাইকেলকেও বলে রেখেছিলেন সবকিছুর আগে তার দেশ।

রাজনীতি আর বন্দিত্বের কথা

অসুস্থ মাকে দেখতে জন্মভূমি মিয়ানমারে আসার পরই পাল্টে যায় সু চির জীবনের গতিপথ। তিনি জড়িয়ে পড়েন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে। গঠন করেন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। আর এতে সামরিক জান্তার চক্ষুশূলে পরিণত হন সু চি। সামরিক জান্তা গৃহবন্দী করে সু চিকে। ১৯৯০ সালে সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল জয়লাভ করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি সামরিক জান্তা। কিন্তু আন্দোলন চালিয়ে জান সু চি, পরিচিতি পান আপসহীন গণতন্ত্রকামী হিসেবে। যা আরও দৃঢ় হয় ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার মাধ্যমে।

গণতন্ত্রের পথে  দীর্ঘ লড়াই

মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেছে নোবেলজয়ী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। এখনো বিজয়ের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তবে এরই মধ্যে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন সেনাসমর্থিত ক্ষমতাসীন দল ইউএসডিপির (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

বিজয়ের উৎসবের জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে রয়েছেন সু চির সমর্থকরা। দেশটিতে গত রবিবার অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফল এখনো ঘোষণা করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখনো ভোট গণনা চলছে। তবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা তথ্যের ভিত্তিতে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন তাই উ। একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে এ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।

মিয়ানমারে এর আগের জাতীয় নির্বাচনকালে অং সান সু চি ছিলেন গৃহবন্দী। সে নির্বাচনে তার দল বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে ব্যর্থ হয়। বর্বর সামরিক শাসক তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকার গঠন করতে দেয়নি। এর ২৫ বছর পর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক অং সানের কন্যা সু চি (৭০) গত তিন দশক ধরে সহিংসতা এড়িয়ে দলের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য ব্যক্তিগত অনেক মূল্য দিতে হলেও তিনি হয়ে উঠেছেন দেশটির গণতন্ত্রকামী জনগণের আশা- আকাক্সক্ষার প্রতীক। তবে সমালোচকরা বলছেন, মানবাধিকার আইকন হিসেবে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পাওয়া সু চির সুনাম সম্প্রতি ক্ষয়ে এসেছে। মিয়ানমারের ক্ষীয়মাণ রাজনীতিতে প্রবেশের পর তিনি আদর্শবাদ থেকে সরে এসে কঠোর বাস্তবতার পথ বেছে নেন। তারা গৃহবন্দী অবস্থায় থাকা সু চির সঙ্গে মুক্ত সু চির মাঝে এক ধরনের পার্থক্য দেখতে পেয়েছেন।

এদিকে মিয়ানমারের এ নির্বাচনে সু চির দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও কিন্তু দ্বিধা থেকেই যাচ্ছে। সু চি জানেন, নির্বাচনে জয়ী হওয়াই শেষ কথা নয়। কারণ এর আগের নির্বাচনেও তার দল যুগান্তকারী বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। কিন্তু এ বিজয়কে প্রত্যাখ্যান করে জান্তা সরকার সু চির ঘনিষ্ঠ মিত্রদের কারারুদ্ধ করে। তাকেও গৃহ অন্তরীণ থাকতে হয় দুই দশক ধরে। কিন্তু এরপর ২০১১ সালে মিয়ানমারে এক ধরনের আধা বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। এ সরকার নানা ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। পরিবর্তন আসে অনেক কিছুতেই। আর সে পরিবর্তনের সূত্র ধরে এবার হয়তো সত্যি গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটবে।

 

অগ্নিকন্যার বর্ণিল জীবন

 

মহাত্ত্বা গান্ধীর আদর্শে..

অং সান সু চি রাজনৈতিক আঙিনায় পা রাখেন ১৯৮৮ সালে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মহাত্ত্বা গান্ধীর আদর্শে বিশ্বাসী। তার রাজনৈতিক জীবনেও সেই ছাপ স্পষ্ট। প্রিয় মাতৃভূমি আর বাবার স্বপ্নের দেশ মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গঠন করেন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি। ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে সু চির দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করার জন্যই গৃহবন্দী করা হয় তাকে। নির্বাসিত জীবনযাপনের শর্তে মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি ৮২ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়। ২৮ বছরের সামরিক শাসনের অবসানের সম্ভাবনায় মানুষের মধ্যে জাগে দেশ গড়ার আশা। কিন্তু জেনারেল থান শুয়ে সু চির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান। ওই বছরই আবার গৃহবন্দী হন শান্তিতে নোবেল জয়ী নেত্রী সু চি।

 

১৫ বছর বন্দীজীবন

একটা ছিমছাম বাড়ি। আর এই বাড়িতেই কেটেছে মিয়ানমারের জনক অং সানের মেয়ে অং সান সু চির নিঃসঙ্গ জীবনের ১৫টি বছর। ইনিয়া লেকের  কোলঘেঁষা ইয়াঙ্গুন শহরের অভিজাত এলাকার লেকের পাড়ে ইউনিভার্সিটি এভিনিউয়ের ৫৪ নম্বর বাড়ি। এই বাড়িতেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ১৫ বছর নিঃসঙ্গ কাটিয়েছেন সু চি। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় আত্মীয়স্বজন তো দূরের কথা , স্বামী বা সন্তানের সঙ্গেও ঠিকমতো দেখা হয়নি তার। কিন্তু চার দেয়ালে আটকে রেখেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে সামরিক সরকার তাকে সরাতে পারেনি। সু চির জনপ্রিয়তা দেখে ’৯০-এর নির্বাচনের আগেই তাকে গৃহবন্দী করে জান্তা সরকার। সেই থেকেই একাকী জীবনের শুরু। গৃহবন্দী করার পর ১৯৯৫ সালে স্বামী মাইকেল এরিসের সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছে। এর মাঝে এরিস বহুবার সু চির সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়েছেন। অনুমতি মেলেনি। দু-একজন গৃহপরিচারিকা ছাড়া তার একাকিত্বের জীবনে আপনজন কেউ ছিলেন না।

দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান

সবকিছুরই শেষ থাকে। প্রতিটি সূর্যোদয়ই নতুন। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৪ নভেম্বর ২০১০। ঘড়িতে সময় বিকাল ৫টা। গেটের ওপার থেকে দেখা গেল তাকে। বর্মি পোশাক আর মুখে সেই অমলিন হাসি। প্রিয় নেত্রীকে দেখতে পেয়ে চার দিকে শুধুই হাততালি আর জয়ধ্বনি। ভিড়ের মধ্য থেকেই একজন একটি ফুল তুলে দিলেন প্রিয় নেত্রীর হাতে। সেই ফুল চুলে গুঁজে নিলেন তিনি। দীর্ঘ সাড়ে সাত বছরের গৃহবন্দিত্বের শেষে অবশেষে মুক্তি পেলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা।

অমলিন একজন

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ের এই লড়াকু সৈনিককে সেদেশের সামরিক জান্তা দীর্ঘকাল গৃহবন্দী রাখার পর অবশেষে মুক্তি দিল। অথচ তার বাবা অং সান আধুনিক মিয়ানমারের শুধু প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, ছিলেন দেশটির সেনাবাহিনীরও প্রতিষ্ঠাতা। তার মেয়েকেই কিনা সেই সেনাবাহিনী গৃহবন্দী করে রাখে ১৫ বছর!  সামরিক জেনারেলরা গুলি আর বন্দুকের সঙ্গে বন্ধুতা করলেও সাম্য আর মানবাধিকার তাদের কাছে গৌণ বিষয়। সুচির বাবা আধুনিক মিয়ানমারের রূপকার। ১৯৪৭ সালে তার হত্যাকাণ্ডের অনেক পরে মিয়ানমারের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তার আগমন। সেই তো শুরু। জনগণের প্রতি সু চির অকৃত্রিম ভালোবাসা আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় শপথ। এই দুটি বিষয়কেই যত ভয় সামরিক জান্তার।

 

অন্যরকম ভালোবাসার গল্প

১৯৬৪ সালে অং সান সু চি অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজে তার স্নাতক ডিগ্রি লাভের জন্য ভর্তি হন। সেখানে অং সান সু চির দেখা হলো মাইকেল এরিস বলে একজন যুবকের সঙ্গে, যিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচয় পরিণত হলো ভালোবাসায়। সু চি তখন অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউজ কলেজের ছাত্রী। এর মধ্যেই অং সান সু চির অক্সফোর্ডের পালা শেষ হলো। তখন মাইকেল এরিস ভুটানের রাজপরিবারের সদস্যদের শিক্ষক হিসেবে এবং সেই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুবাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সেই ভুটানেই মাইকেল এরিস অং সান সু চির পাণিপ্রার্থী হলেন। মাইকেল এরিসের কথায়, তাদের

 বিয়ের আগে আট মাসে সু চি তাকে ১৮৭টি চিঠি লিখেছিলেন। ১৯৭২-এর ১ জানুয়ারি তাদের বিয়ে হলো। নববিবাহিত দম্পতি ঘুরে বেড়ালেন, ভুটান, নেপাল, অরুণাচল আর হিমাচল প্রদেশে। তাদের বিয়ে হয়েছিল সেই অঞ্চলের শীতের তুষার শুভ্রতায়। তার পরের ১৬টি বছর অং সান সু চি আদর্শ গৃহবধূর জীবনযাপন করলেন। ১৯৮৮ সালের ৩১ মার্চের সন্ধ্যায় মায়ের অসুস্থতার খবরে দেশে ফিরলেন সু চি। মাইকেল এরিস আর অং সান সু চি তখন কল্পনাই করেননি যে এই যাওয়াই তাদের স্বাভাবিক দাম্পত্যজীবনের অবসান ঘটাবে, ইতি টানবে তাদের শান্তি-সুখের জীবনের। সু চি সেখানে আটকে পড়লেন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নেশায়। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে তার পরিবারের সেই সফরটিই ছিল স্বামী মাইকেল এরিসের সঙ্গে অং সান সু চির শেষ দেখা। ১৯৯৯ সালের ২৭ মার্চ তার ৫৩তম জন্মদিনে মাইকেল এরিস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাদের অন্যরকম ভালোবাসার গল্পটি ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

 

কীর্তি-সম্মাননায় ভাস্বর

কেবল গণতন্ত্রের সংগ্রামীই নন সু চির জীবনটার পুরোটাই কীর্তি আর সম্মাননায় ভাস্বর। তার লেখা বই পুরস্কার আর অন্যান্য অর্জনের দিকে একটু চোখ বুলানো যাক।

বই

লেটারস ফ্রম বার্মা (বার্মার চিঠি), ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার অ্যান্ড আদারস (ভয় থেকে মুক্তি ও অন্যান্য), ডের ওয়েগ জুর ফ্রেইহেইট, বার্মাস রেভলুশন অব দ্য  স্পিরিট : দি স্ট্রাগল ফর ডেমোক্রেটিভ ফ্রিডম অ্যান্ড ডিগনিটি, অং সান অব বার্মা : আ বায়োগ্রাফিকাল পোট্রেইট বাই হিজ ডটার,  অং সান, বার্মা অ্যান্ড ইন্ডিয়া : সাম আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল লাইফ আন্ডার কলোনিয়ালিজম। এই বইগুলোতে অবশ্য তার সঙ্গে একাধিক সহলেখক কাজ করেছেন।

পুরস্কার

এক জীবনে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সু চি। তার এসব পুরস্কারের মধ্যে উলে­খযোগ্য হচ্ছে থোরোলফ রাফটো স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), শাখারভ পুরস্কার (১৯৯১), নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৯১), সিমন বলিভার আন্তর্জাতিক পুরস্কার (১৯৯২), জওহরলাল নেহরু পদক (১৯৯৩), লিবারাল ইন্টারন্যাশনালের দেওয়া স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৫), রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড (১৯৯৯), যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘প্রেসিডেনসিয়াল মেডাল অব ফ্রিডম’ (২০০০), ওলফ পামে পুরস্কার, অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘সম্মাননাসূচক অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া’ (১৯৯৬), সহনক্ষমতা ও অহিংসা প্রচারের জন্য ইউনেস্কো মদনজিৎ সিং পুরস্কার (২০০২), কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের মেমোরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ল’স, ভয় থেকে মুক্তি পদক (২০০৩) ইতিহাসে মাত্র চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে কানাডার সম্মাননাসূচক নাগরিকত্ব (২০০৭), এলএসইএসইউ (লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস স্টুডেন্টস ইউনিয়ন)-এর সম্মাননাসূচক সভাপতি কংগ্রেসীয় স্বর্ণপদক (২০০৮), প্রেমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল ক্যাটালুনা (২০০৮), গ্লাসগো স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৯) ইত্যাদি।

শিল্প-সংস্কৃতি-সংবাদমাধ্যমে

২০০৬ সালে নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকার তৈরি ‘আমাদের সময়ের ৫০ নায়ক’ তালিকায় সবার ওপরে রাখা হয় সু চিকে। ২০০৮ সালে সু চিকে বিশ্ব গণতন্ত্রের ১৫ জন কীর্তিমানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ইউরোপ-ভিত্তিক ‘ডিফারেন্ট ভিউ’ সংস্থা। জন বুরম্যান ১৯৯৫ সালে বিয়ন্ড রেঙ্গুন নামে যে চলচ্চিত্র তৈরি করেন, তার অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিলেন অং সান সু চি। খ্যাতনামা জ্যাজ স্যাক্সোফোন বাদক ওয়েইন শর্টার তার বিখ্যাত একটি কম্পোজিশনের নাম রেখেছিলেন সু চির নামে। আইরিশ রক ব্যান্ড ইউ-টু এর ২০০১ সালের ‘ওয়াক অন’ শীর্ষক গানটি সু চিকে নিয়ে রচনা করা হয় ও উৎসর্গ করা হয়। এরপর এই গানটি যেসব অ্যালবামে ছিল সেগুলো নিষিদ্ধ করে মিয়ানমার সরকার।

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর