রবিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ইউনিভার্সাল স্টুডিও হলিউড

লাকমিনা জেসমিন সোমা

ইউনিভার্সাল স্টুডিও হলিউড

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটের লস এঞ্জেলেসে রয়েছে হলিউডের বিখ্যাত ইউনিভার্সাল স্টুডিও। এটি বিশ্বের অন্যতম চমকপ্রদ থিমপার্ক। আর এই স্টুডিও ঘুরে এসে লিখেছেন- লাকমিনা জেসমিন সোমা

থিমপার্কে রয়েছে মজার সব চরিত্র। তেমনই এক চরিত্র বেটলজুসের সঙ্গে লেখিকা

 

হলিউডের ডায়েরি থেকে...

হলিউডের প্রাণই হলো ইউনিভার্সাল স্টুডিও। সেখানে দর্শনার্থীদের জন্য মূল আকর্ষণ  ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য তৈরি ভিন্ন ভিন্ন স্টুডিও। বাস ট্যুরের মাধ্যমে এগুলো ঘুরে ঘুরে দেখানো হয়।

 

তীরে এসে তরী ডুবল। দেশে ফেরার ঠিক দুদিন আগে শেষ সম্ভাবনাটুকুও নিভে গেল। স্যান্ডিয়াগো থেকে লস এঞ্জেলেসে চামান চুমকি নামে একজন বাংলাদেশি আমেরিকান ভদ্রমহিলা আমাকে লিফট দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটিও ভেস্তে গেল। মধ্যরাতে তিনি জানালেন, ‘কাল সকাল ৯টার মধ্যে যদি ফোন পাও, তবে ১০ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে রাস্তায় দাঁড়াবে। ফোন না পেলে কিছু মনে কর না।’

ফোনটা মুঠোর মধ্যে রেখেই বিছানায় গেলাম। সত্যি বলতে সে রাতে মান-অভিমান আর উৎকণ্ঠার মধ্যেও ছোট্ট একটি সম্ভাবনার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে ঘুমুতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সকাল ৯টা বাজল, কোনো ফোন এলো না। সাংবাদিকতার পাশাপাশি যেদিন থেকে ফিল্ম নিয়ে আগ্রহবোধ করেছি সেদিন থেকেই স্বপ্ন দেখেছি হলিউড ভ্রমণের। আর সেই ফিল্ম নিয়ে কাজ করে যেদিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান্ডিয়াগোতে পড়ার সুযোগ পাই সেদিন কেবল একটি কারণেই খুশি হয়েছিলাম। তা হলো হলিউড ভ্রমণের সুযোগটা যেন আমার হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিল। ইউনিভার্সিটির তত্ত্বাবধানেই ওখানে যাওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর তিন মাস সেখানে থাকাকালীন বহুবার বহুভাবে পরিকল্পনা করেছি আর কোনো না কোনো কারণে তা বানচাল হয়ে গেছে। এই ভদ্রমহিলাই ছিল আমার শেষ ভরসা। যাই হোক, সকাল ৯টায় ফোন না এলেও বেলা ১১টায় হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের বুক চিরে হাইওয়ে-ফাইভ বেয়ে আমি যখন হলিউডের পথে তখনো যেন নিজেকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। যাবতীয় জল্পনা-কল্পনা আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পাহাড় ডিঙিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম হলিউডে।  হলিউডের প্রাণই হলো ইউনিভার্সাল স্টুডিও। সেখানে দর্শনার্থীদের জন্য মূল আকর্ষণ ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য তৈরি ভিন্ন ভিন্ন স্টুডিও। বাস ট্যুরের মাধ্যমে এগুলো ঘুরে ঘুরে দেখানো হয়। বর্ণনা করা হয় কোন সিনেমা কোন স্টুডিওতে কীভাবে ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া বিখ্যাত সিনেমার বিশেষ অংশের লাইভ শোগুলোও অনেক মজার। আর বিশেষ আকর্ষণের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বিখ্যাত সব মুভি অবলম্বনে তৈরি রাইডগুলোও। বড় ছোট সবার কাছেই এটি বেশ জনপ্রিয়। আছে স্পেশাল কিছু স্টেজ বা মঞ্চ যেখানে সিনেমায় ব্যবহৃত আধুনিক প্রযুক্তির খেল দেখে চমকে যাবে দর্শক। এছাড়া হলিউডের সিনেমা সংক্রান্ত দুর্লভ সব সংগ্রহ দেখতে অনেকেই ছুটে যান গ্যালারিতে।

 

স্টুডিও ট্যুর : রোল-ক্যামেরা-অ্যাকশন। নায়িকার সাজে বসে আছেন একজন। এই বুঝি অমূল্য সুযোগ হলিউডের নায়িকার সঙ্গে একটি ছবি তোলার। তবে আপনি এই আকর্ষণকে এড়িয়ে যাবেন যখন দেখবেন পাশেই সেই স্বপ্নের স্টুডিও। অর্থাৎ হলিউডের ইউনিভার্সাল স্টুডিও দেখার শ্রেষ্ঠ সুযোগ। বলা হয় ‘স্টুডিও ট্যুর’। সাইট-সিং বাসে চড়ে এ বিশাল স্টুডিও ঘুরে দেখার সময় একজন গাইড (বর্ণনাকারী) বড় স্ক্রিনে মুভির সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যটি ঠিক কোন জায়গায় কীভাবে ধারণ করা হয়েছিল তা সরাসরি দেখান বা বর্ণনা করতে থাকেন। সমগ্র স্টুডিও দুটি অংশে বিভক্ত। ‘ব্যাকলট’ এবং ‘ফ্রন্টলট’। দর্শনার্থীদের হলিউডে প্রবেশ করেই ৪০-৪৫ মিনিটের এ ট্যুরটি আগে সম্পন্ন করে নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। এটি ‘ব্যাকলট  ট্যুর’ নামেও পরিচিত।  ১৩টি ‘সিটি ব্লক’ নিয়ে চার একর জমির ওপর এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বড় স্টুডিও। ফ্রন্ট লট ও ব্যাক দুভাগে বিভক্ত। ১৯১৫ সাল থেকে এটি দর্শনার্থীদের জন্য চালু রয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত সব মুভি যেমন- সাইকো, ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ডস, ব্যাক টু দ্য ফিউচার, দ্য স্টিং, দ্য গ্রেট আউটডোর, হাই দ্য গ্রিনচ স্টোল ক্রিসমাসের দৃশ্য ধারণের ইতিহাস স্বচক্ষে দেখলাম এই ভ্রমণে।

‘খুন করে লাশ কোলে করে মোটেল থেকে বের হচ্ছেন নরম্যান ব্যাটস। হাতে তখনো রক্তমাখা ছুরি। মোটেলের সামনে পানি জমা রাস্তা ও ভেজা কার দেখলেই বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। কারের পেছনে বক্সের মধ্যে লাশটি লুকিয়ে ফেলল নরম্যান।’ স্বপ্ন না, সত্যি। রবার্ট ব্লোচের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সাইকো’ অবলম্বনে মুভির বিখ্যাত চরিত্র নরম্যান ব্যাটস। বাস থেকেই আপনি সরাসরি এ দৃশ্য দেখতে পাবেন। তবে ভুল করেও অটোগ্রাফ চাইবেন না। কিছু একটা বললেই সাইকো নরম্যান আপনাকেও খুন করতে তেড়ে আসবে। অন্তত আমাদের ভ্রমণের সময় এমনটিই ঘটেছিল।

ককশিট, রাবার ও হালকা উপকরণ দিয়ে তৈরি নিউইয়র্ক সিটি দেখলে আপনার তাক লেগে যাবে। এটি এমন একটি স্টুডিও যে ক্যালিফোর্নিয়ায় থেকেও আপনার মনে হবে নিউইয়র্ক সিটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মুভিতে নিউইয়র্কের দৃশ্যে  শুটিং করার জন্য এ স্টুডিওটি নিয়মিত ব্যবহৃত হয়।

>> থিমপার্কের আরও সব স্টুডিও, স্টেজ, রাইড ও মজার লাইভ-শোগুলো থাকছে পরবর্তী সংখ্যায়

বাসে চড়ে দেখতে পেলাম আরও অদ্ভুত সব দৃশ্য। সবই সাজানো, তবু যেন সত্যি। বাসটি এমন এক বাড়ির সামনে গিয়ে থামল যেখানে ছোট্ট টালির ছাউনি দিয়ে তৈরি বাড়ির চাল থেকে বৃষ্টি ঝরছে। হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস এসে ভাসিয়ে দিল বাসের চাকা। আবার মুহূর্তেই রোদের আলোয় ঝোপের ভিতর থেকে ডেকে উঠল বুনো পাখি।

মুভির রোমান্টিক দৃশ্য ধারণের জন্য ইউনিভার্সাল এই স্টুডিওর একটি দিকে প্রকৃতিকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, দর্শকের মন এমনিতেই রোমান্টিক হয়ে হয়ে উঠবে। পাহাড়ি সবুজের মধ্যে শুভ্র কাঠের সারি সারি ডুপ্লেক্স বাড়ি, চিলেকোঠা। বারান্দার ধার ঘেঁষে তৃণলতায় মুখ গুঁজে কী যেন চিবুচ্ছে হরিণের পাল।

কিংকং : থ্রি-ডি-থ্রি-সিক্সটিডি : ইউনিভার্সাল স্টুডিতে বাস ট্যুরের সময় অন্যতম আকর্ষণ কিংকং মুভির জগতে ঘুরে আসা। বাসে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখবেন একটি ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করেছেন। আপনার বাসটি দুই হাতে তুলে আছাড় মারছে কিংকং বিশাল আকৃতির একটি শিম্পাঞ্জি। বনের মধ্যে মারামারি করছে পশুগুলো। আপনি কখনো পাহাড় থেকে পড়ে যাচ্ছেন। আবার কখনো মনে হবে কোনোরকম গুল্মলতায় ঝুলে গেছেন। মূলত এটি পিটার জ্যাসনের কিংকং মুভি অবলম্বনে একটি থ্রি-ডি-থ্রি-সিক্সটিডি মঞ্চ যা ২০১০ সালে নতুন করে চালু হয়।

ভূতুড়ে রেলস্টেশন : প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে একটু বেশিই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। আর তা যদি হয় ৮.৩ মাত্রার! একটি রাত আবহর মধ্য দিয়ে ট্রেন স্টেশনে এসে থামল আমাদের বাস। হঠাৎ স্টেশনে রেড অ্যালার্ম বাজতে লাগল। আমরা অনুভব করলাম ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। খসে পড়তে থাকল লোহালক্কড়। বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বিস্ফোরণ হয়ে আগুনের ফুলকি এসে পড়ছে বাসের জানালায়। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। তৈরি হলো ভুতুড়ে পরিবেশ। পাশেই গাড়ির ভাগাড় থেকে লক্কড়ঝক্কড় একটি বাস এসে আমাদের বাসকে আঘাত করতে লাগল। অথচ বাসে কোনো ড্রাইভারই নেই। এর মধ্যেই হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে থেকে গেল ভূমিকম্প। সবাইকে চমকে দিয়ে স্টেশনের দোতলার সিঁড়িঘর বেয়ে প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে এলো পানির স্রোত। আমরা সবাই ভিজে গেলাম এবং ডুবতে থাকল বাসের চাকা। বুঝতে পারলাম, এভাবেই হরর বা ভয়ের মুভির দৃশ্য ধারণ করা হয়।

 

বিমান বিধ্বস্তের স্টুডিও

ইউনিভার্সাল স্টুডিও পুরোটাই চমকে ভরপুর। এক মুহূর্তের জন্যও মন সরে আসে না এ চমকের কারণে। তেমনই অদ্ভুত এক দৃশ্যের দেখা মিলল। আমরা অনেক সিনেমায় বিমান বিধ্বস্ত হতে দেখি। বিশেষ করে অ্যাকশন মুভিতে এটি খুবই কমন। কীভাবে এ ধরনের স্যুটিংগুলো হয় দেখলে তাক লেগে যাবে। তুষার মঞ্চের পাশেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে একটি বিশাল বিমান। বিমানটির ইঞ্জিন থেকে তখনো কালো ধুঁয়া উড়ছে। ভেঙেচুরে পড়ে আছে সিট। পাশেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি অনবরত হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে। বিমানের সঙ্গে ধ্বংস হয়েছে আরও কিছু প্রাইভেট কার, বাড়িঘর ও অন্যান্য রাস্তাঘাট। দেখে একবারও মনে হবে না এটি পুরোটাই সাজানো। একটি বিমান দুর্ঘটনার পুরো ছবি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বিমান বিধ্বসের দৃশ্য থেকে সরে এলাম।  বাসে করে দ্রুত ঘটনাস্থল ছাড়লাম আমরা।

 

 

এছাড়া এখানে রয়েছে বেশ কিছু স্টেজ বা মঞ্চ। ডিজনি নির্মিত ‘পাইরেটস অব দি ক্যারিবিয়ান’, ‘দি প্রিন্সেস ডায়েরিস’ এর মতো অনেক জনপ্রিয় সিরিজ মুভি তৈরিতে এ স্টুডিওর ব্যাকলট বা পেছনের অংশ ব্যবহার করা হয়েছে। শুভ্র তুষারের ভিতর স্যুটিংয়ের জন্য রয়েছে আলাদা মঞ্চ।

সর্বশেষ খবর