রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিচ্ছেদেই আনন্দ ব্রিটিশদের

তানভীর আহমেদ

♦ ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল

♦  ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে ভোট : ১,৬১,৪১,২৪১ (৪৮.১%)

♦  ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে ভোট : ১,৭৪,১০,৭৪২ (৫১.৯%)

 

ব্রিটেনের জনগণ ইইউ থেকে সরে আসার পক্ষে ভোট দিল। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের  ঘোষণা দেন ডেভিড ক্যামেরন। এখন পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও তা অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে। নতুন নেতা নির্বাচন করা হবে কনজারভেটিভ পার্টির কনফারেন্সে। ২৮টি দেশভুক্ত জোট ইইউর সঙ্গে ব্রিটেনের দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময়ের সম্পৃক্ততার অবসান হয়। গত ২৩ জুন ইইউতে থাকার পক্ষে এ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় ৪৬ মিলিয়নের বেশি ভোটার ভোট  দেন। দেশটির ইতিহাসে এটি তৃতীয় জাতীয় গণভোট ছিল। ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে, লন্ডন ও স্কটল্যান্ডবাসী ইইউতে থাকার পক্ষে  ভোট  দেন। তবে ব্রিটেনের ইইউ ত্যাগের পক্ষে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে উত্তর ইংল্যান্ডে। সেখানকার ওয়েলস এবং ইংলিশ শায়ার্স  ভোটাররা ব্যাপক সংখ্যায় দেশটির ইইউ ত্যাগের পক্ষে ভোট  দেন। ৪  কোটি ৬৫ লাখ ১ হাজার ২৪১ জন  ভোটার দেশজুড়ে ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোট দেন। ভোট প্রদানের হার ৭২ দশমিক ২ শতাংশ।

 

যা পাচ্ছে

অভিবাসীর সংখ্যা কমবে

ইউরো-গ্রাম থেকে মুক্তি পাবে ব্রিটেন।

শিল্পবাণিজ্য, কর্মসংস্থান ইইউয়ের শর্ত থেকে মিলবে মুক্তি

 

যা হারাচ্ছে

সস্তায় শ্রমিক

ইইউয়ের আর্থিক সহায়তা

বাড়তে পারে মূল্য বৃদ্ধি এবং সুদের হার

বিনা ভিসায় ইইউয়ের যে কোনো দেশে ভ্রমণ

 

ইইউ-তে ব্রিটেনের ৪৩ বছর

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর  গোটা ইউরোপ মহাদেশে ব্যাপকভাবে জাতীয়তাকরণে পুরো ইউরোপে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ধাপে ধাপে সে অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। ইইউ ইউরোপ মহাদেশের ২৭টি দেশের  একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জোট। এর অধীনে অভিন্ন মুদ্রা (ইউরো), ইউরোপীয় সংসদ ও বাণিজ্য আইন রয়েছে। ইউরোপে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১২ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ থেকে বেরিয়ে গেল ব্রিটেন। ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপট অনেকটাই বদলে যাবে।

 

এখনো ব্রিটিশ ডমিনিয়ন

যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন রাষ্ট্রটি চারটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র  ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড নিয়ে গঠিত। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে অনেকগুলো দ্বীপ রয়েছে। দ্বীপগুলোকে একসঙ্গে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ নামে ডাকা হয়। ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরোটোরিজে আছে আরও ১৪টি দ্বীপ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিব্রাল্টার, অ্যাংগোলা, ফকল্যান্ড, সেন্ট হেলেনা ইত্যাদি।

 

ব্রিটেন ছাড়তে চায় স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড

ইইউ থেকে ব্রিটেনের বিদায় নেওয়ার পর ইইউর ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন অঙ্ক কষছেন বিশ্লেষকরা। এবার ব্রিটেন ডমিনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেসে আসছে স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড থেকে। এ কথা মোটেও নতুন নয়। গণভোটে ইইউ ছাড়ার পক্ষে ব্রিটিশদের জনরায় স্পষ্ট হওয়ার পর, খোদ ব্রিটেন ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে। উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের ভোটাররাই বিপুলহারে ইইউতে রয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের ভোটাররা ছেড়ে যাওয়ার পক্ষে বেশি ভোট দেওয়ায় ব্রিটেন ইইউ ছাড়ে। স্কটল্যান্ডের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে যুক্তরাজ্য ইইউ ছেড়ে চলে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়াতে স্বাধীনতার দাবিতে দ্বিতীয় গণভোট ঠেকানো অসম্ভব হয়ে উঠবে। এর আগে ২০১৪ সালে একবার স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতার বিষয়ে গণভোট হয়েছিল।

 

বৈশ্বিক অর্থ বাজারে ঝাঁকুনি

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বের হয়ে যাওয়াটা গণভোটে নিশ্চিত হয়েছে। এ খবরেই বড় রকমের ঝাঁকুনি খেয়েছে বৈশ্বিক অর্থ বাজার। বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পরপরই ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের নাটকীয় দরপতন ঘটে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো তাদের বিশ্লেষণে জানায়, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে সবচেয়ে থাক্কাটা খেল। পাউন্ডের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে এক দিনে সর্বোচ্চ দরপতন এটি। একপর্যায়ে পাউন্ডের দর ১০ শতাংশ কমে ১ দশমিক ৩৩০৫ ডলারে নেমে আসে, যা ১৯৮৫ সালের পর সর্বোচ্চ দরপতন। শুধু তাই নয়, ইউরোপজুড়ে শেয়ারবাজারগুলো ব্যাপক দরপতন নিয়েই চালু হয় পরবর্তী দিন। পাউন্ডের দর কমায় বিদেশ থেকে আমদানিতে বেশি গুনতে হবে ব্রিটেনকে; অন্যদিকে পণ্যের দাম সস্তা হওয়ায় লাভবান হবেন দেশটির রপ্তানিকারকরা।

 

 

শঙ্কায় ব্রিটেনের অর্থনীতি

১৯৭৫ সাল থেকে ব্রিটেনের সমৃদ্ধির ভিত্তি হলো ইইউ সদস্যভুক্ত হওয়া। এখান থেকে বেরিয়ে আসা মানে আরও এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি নেওয়া। যে মন্দায় অর্ধ মিলিয়ন চাকরি ছাঁটাই করতে হতে পারে। জোটের মধ্যে থাকলে কাজের অধিকার, কাজে ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বেতনসহ নিশ্চয়তা ছিল। জোট ত্যাগ করার ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসার মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থ ও বিনিয়োগ চলে যাবে ব্রিটেনের বাইরে। মূল্যস্ফীতি মন্দা ও বাড়িঘরের দাম পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

যে কারণে ইইউ ছাড়ল ব্রিটেন

♦ অভিবাসী ইস্যুতে ক্যামেরনের ব্যর্থতা

♦ ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির উত্থান

♦ কাজে আসেনি বেক্সিটের নেতিবাচক অর্থনৈতিক  হুঁশিয়ারি

♦ স্বাস্থ্য খাতে ৩৫ কোটি পাউন্ড খরচ বাঁচানোর স্লোগান উদ্বুদ্ধ করেছে ভোটারদের

♦ লেবার পার্টির এমপিদের প্রচারণা কাজে আসেনি

 

ব্রিটেন ইউরোপিয়ান জোট ত্যাগের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয় অভিবাসনের জোয়ার ঠেকাতে না পারা। বর্তমানে ব্রিটেনে নেট মাইগ্রেশন ৩৩ লাখ। এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি এসেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো থেকে। জোটবদ্ধ থাকার কারণে জোটের অন্য দেশগুলোর নাগরিকদের অবাধ চলাচলে বাধা নেই। জোটে থাকার কারণে অবাধ প্রবেশাধিকারে ব্রিটিশ সরকার চাইলেও ইউরোপিয়ান নাগরিকদের ব্রিটেনে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারেনি।

এ ছাড়া কাজে আসেনি বেক্সিটের নেতিবাচক অর্থনৈতিক হুঁশিয়ারি। যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে অর্থনৈতিক হুমকির মুখে পড়বে এই  নেতিবাচক প্রচারণা আর হুঁশিয়ারি মানুষকে এত বেশি দেওয়া হয়েছে  যে মানুষ তা বিশ্বাস করেনি।

ইইউ ছাড়ার পক্ষের শিবিরের স্লোগান ছিল, ইইউ ছাড়লে সপ্তাহে ৩৫ কোটি পাউন্ড খরচ বাঁচবে। আর তখন তা স্বাস্থ্যসেবা খাতে (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এনএইচএস) বরাদ্দ করা যাবে।

এমন আকর্ষণীয় স্লোগান সব বয়সের, সব রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষকে ইইউ ছাড়ার পক্ষে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। অন্যদিকে জনগণ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কথায় কান দেয়নি। ডেভিড ক্যামেরন সাধারণ নির্বাচনে দুবার এবং অতীতে দুটো গণভোটে জয়ের সাফল্য পেলেও এবার তার ভাগ্য বিফলে গেছে। যুক্তরাজ্যের বিরোধী দল লেবার পার্টি ইইউয়ে থাকার পক্ষে যথেষ্ট প্রচারণা চালায়নি বলে অভিযোগ আছে। গণভোটে জয়ের জন্য ইইউয়ে যুক্তরাজ্যের থাকার পক্ষে শিবিরের দরকার ছিল লেবার ভোটারদের।

কিন্তু লেবার পার্টির ৯০ শতাংশ এমপি ইইউ-এর পক্ষে হওয়ার পরও তারা সমর্থকদের মনোভাব ঠিকমতো বুঝতে পারেনি।

শেষতক বলা হচ্ছে, এবার বয়স্ক মানুষরা বেশি ভোট দিয়েছেন। বয়স্ক মানুষের ভোটই ইইউ ছাড়ার পক্ষকে জয় এনে দিয়েছে। ২০১৫ সালের ভোটেও ৬৫ বা তার ওপরের বয়সী মানুষের ৭৮ শতাংশই ভোট দিয়েছে। যেখানে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ভোটারদের মাত্র ৪৩ শতাংশ ভোট দিয়েছে। আর ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ভোট দিয়েছে মাত্র ৫৪ শতাংশ। এছাড়া ইনডিপেনডেন্স পার্টির উত্থান তো অবিস্মরণীয়।

 

বাজল ক্যামেরনের বিদায় ঘণ্টা

ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে আহ্বান জানিয়েছিলেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। কিন্তু ভোটের ফলাফল গেল তার বিপক্ষে। এরপরই পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। ডাউনিং স্ট্রিটে আসার পর থেকেই দলের পেছন সারির  নেতাদের এই গণভোট আয়োজনের চাপ থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। ওদিকে ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির উত্থান, বিচ্ছিন্ন অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে গণক্ষোভ ও অভিবাসনের ব্যাপারে জন-অসন্তোষ থাকার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার দাবি জোরালো হয়। ২০১০ সালের নির্বাচনের আগে ক্যামেরন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি অভিবাসনের হার কমিয়ে আনবেন। কিন্তু তিনি সে প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। ফলে ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি আবারও সে প্রতিশ্রুতি  দেন। এতে তার নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়।   সেটাই কাল হলো এবার।

সর্বশেষ খবর