শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৪

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৪

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক তিনি। মুসলিম শাসকদের মধ্যেও সবার শীর্ষে সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লিও বা হেরেম। এটা কেবল সুলতানের মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রেই নয়, রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা গল্প-উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা।

 

উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয় পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। এবারের পর্বে দেখা যাবে ফরাসি দূতের আগমনকে কেন্দ্র করে সবার ব্যস্ততা ও ইব্রাহিমের ব্যক্তিগত ভাবনা। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো চতুর্দশ পর্ব।

[পূর্ব প্রকাশের পর]

ফ্রান্স থেকে পাঠানো প্রথম ফ্রান্সিস অ্যান্টনিও রিকন ও অন্যান্য শুভেচ্ছাদূতের সম্মানে আয়োজিত জলসা বেশ ভালোমতোই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এই আয়োজনে আলেকজান্দ্রাকে না দেখে প্রথমে বেশ চটে গিয়েছিলেন সুলতান সুলেমান। পারগালি ইব্রাহিমকে পেছনের কারণ জিজ্ঞেস করতেই ইব্রাহিম জানান, ইচ্ছে করেই আলেকজান্দ্রাকে এখানে রাখা হয়নি। কারণ সুলতানের প্রিয় পাত্রী সবার সামনে এসে নাচুক এটি ইব্রাহিম চাননি। ইব্রাহিমের এই ব্যাখ্যা সুলতানের বেশ পছন্দ হলো। তিনি আর কথা বাড়াননি। ইশারায় রাতের জন্য আলেকজান্দ্রা ওরফে হুররেমকে তৈরি রাখার কথা বললেন কেবল। ইব্রাহিমও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

ওদিকে মাহিদেভরান সারা খাতুনকে নিয়ে সুলতানের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। সারা খাতুন যখন সুলতানার প্রিয় ভায়োলিন হাতে নিয়ে সুর তোলার চেষ্টা করছিলেন, তখনই অকস্মাৎ সেখানে এসে হাজির হলেন সুলতান সুলেমান খান। সারা খাতুন কুর্নিশ করে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করলেন। সুলতান অবশ্য সেখানে খুব বেশি সময় কাটালেন না। মাহিদেভরানের কুশল জানার পর মুস্তফার খোঁজ নিলেন। এরপর ঘুমন্ত মুস্তফার কপালে একটা চুমু খেয়েই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন। মাহিদেভরান স্বামীকে ডাকতে গিয়েও থমকে গেলেন। একটা চাপা কষ্টের নীরব ঝড় বয়ে গেল মাহিদেভরানের বুক চিরে। টপ টপ করে দুগাল বেয়ে ঝরে পড়লো কয়েক বিন্দু অশ্রু। অটোমানদের ঐশ্বর্য আর দুনিয়াজোড়া খ্যাতির পেছনে এমন কত অশ্রুর সাগর লুকানো কে জানে!

আজ সুলতানকে ভালোবাসার কথা বলতেই হবে। আলেকজান্দ্রা থেকে হুররেম খাতুন হয়েছেন। সুলতানের প্রিয় তালিকায় নাম উঠিয়েছেন। এখন হুররেমের কেবলই এগিয়ে চলার পালা। থেমে থাকলে চলবে না। ক্রিমীয় তাতারদের হাতে সব খুইয়ে এখানে আশ্রিত হয়েছেন। সব ভুলে এখন কেবল নিজেকে উপরে তোলার পালা। আর এই পরিক্রমায় সুলতানই তার একমাত্র অবলম্বন। সুলতানকে মুগ্ধ করার জন্য তাই আজ একেবারেই অন্যরকমভাবে সেজেছেন হুররেম। অনেকটা আরব নারীর মতো ঘাঘরা আর জড়োয়ায় সাজিয়েছেন নিজেকে। অলঙ্কার আর গহনায়ও এসেছে বৈচিত্র্য। সুলতান কক্ষে ঢোকার পর অন্যদিনের মতো বিছানা থেকে নেমে এলেন না হুররেম। ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢেকেই বললেন,

‘জাহাপনা, বেয়াদবি নেবেন না। আমার সালাম জানবেন। বিশেষ কারণে বিছানা থেকে নামতে পারলাম না। তাই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো। আপনাকে অভিবাদন জানাতে পারলাম না।’

সুলেমান এগিয়ে এসে বিছানায় বসলেন। দৃষ্টিজুড়ে তীব্র কামনা। পুরুষালি মুখে দুষ্টুমির হাসি।

‘তা কী সেই বিশেষ কারণ? হুররেম খাতুন?’

সুলেমান সহজাত হওয়ায় স্বস্তি বোধ করলেন হুররেম।

‘আমি চাইনি প্রথম ঝলকেই আপনি আমাকে দেখে ফেলেন। বিছানায় এসে আমার ঘোমটা তুলে দেখলেই কারণটা বুঝতে পারবেন।’

‘তাই?’

সুলেমানের কণ্ঠ আর মুখে স্পষ্ট হাসির রেখা। গায়ে জড়ানো কাফতানটা খুলে পাশে রাখলেন। এরপর এগিয়ে গেলেন হুররেম খাতুনের দিকে।

আলতো করে হুররেমের ঘোমটাটা টেনে দিলেন। এরপর একদৃষ্টে হুররেমের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। হুররেম তখন চক্ষু বুজে স্পর্শকাতর হয়ে ওঠার অপেক্ষায়। সুলেমান হুররেমের চিবুকের নিচে হাত বুলিয়ে মুখটা উপরের দিকে উঠালেন।

আবেগে হুররেমের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ভ্র কুঁচকে গেছে তার। বিষয়টা দৃষ্টি এড়ালো না সুলেমানেরও। মৃদু হাসলেন তিনি। তারপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলেন হুররেমকে।

‘চোখ খুলবে না হুররেম খাতুন?’

সুলেমানের কণ্ঠে তখনো হাসির রেশ। বিষয়টা বেশ উপভোগ করছেন সুলতান।

‘যদি আপনার আজ্ঞা হয়।’

চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর দিলেন হুররেম।

‘খোলই না।’

এবার আস্তে করে চোখ খুললেন হুররেম খাতুন। হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন সুলতান সুলেমান খান।

‘সাজটা কিন্তু দারুণ হয়েছে।’

বলেই পেছন থেকে একটা হাত সামনে নিয়ে এলেন সুলেমান। তার হাতে একটা ময়ূরের পালক। পালকটা হুররেমের কপাল চোখ মুখে বুলাতেই চোখ দুটো মুদে এলো হুররেম। আরেকটা হাত পেছন থেকে টেনে ধরলো হুররেমকে। হুররেমও আবেগে টেনে ধরলেন সুলতানকে। সুলেমানের হাত সচল হলো। কমতে থাকল হুররেমের ভূষণ। সাদাটে ফর্সা মোম ত্বকের আনাচে-কানাছে ভ্রমণ করতে থাকল ময়ূরের পালক। ততক্ষণে বিছানায় শয্যা গ্রহণ করেছেন দুজনই। হুররেম তার ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারল না। সুলেমানের আগ্রাসী হাত হুররেমকে শিহরিত করে তুলল। তখন আর মুখে ভাষার কোনো দরকার নেই। নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকলো। সূর্য চাঁদের মতোই দ্রুত মানব-মানবীর চিরন্তন প্রণয়ের সূত্রপাত। রাত আস্তে আস্তে গভীর হয়। গভীর হয় প্রণয়ের যাত্রাও। প্রকৃতির নিয়মেই এক সময় যাত্রা বিরতি আসে। সুলতানের কোলে মাথা রেখে ক্লান্তিতে চোখ বুজে থাকে হুররেম। নীরবতা ভাঙেন সুলতান নিজেই।

‘খারাপ লাগছে হুররেম খাতুন।’

‘আপনার সঙ্গ খারাপ লেগে উপায় আছে সুলতান?’

জবাবে তুষ্ট হয়ে হুররেমের কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন সুলতান।

‘সুলতান অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম?’

‘কী কথা হুররেম খাতুন? কিছু দরকার?’

‘না কিছু দরকার নেই। এমনি একটা কথা বলতাম যদি আপনি কিছু মনে না করেন।’

‘আচ্ছা বলো। সমস্যা নাই।’

‘মানে। ইয়ে...’

‘মানে মানে করছো কেন? তুমি কী ভয় পাচ্ছো?’

‘নাহ—! ভয় পাব কেন?’

‘তাহলে বলে ফেল।’

‘আমি আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি সুলতান। আপনি কখনো আমায় ছেড়ে যাবেন না। আমার কেউ নেই। এই এতিমকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না।’

বলেই চোখ বুজে শক্ত করে সুলেমানকে জড়িয়ে ধরলেন হুররেমে। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সুলেমান কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো নিশ্চুপ থাকলেন কিছুক্ষণ।

তারপর হুররেমের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

‘আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই হুররেম। তোমার যখন যা দরকার আমাকে বলবে। অথবা আমি ইব্রাহিমকে বলে দিচ্ছি তোমার খেয়াল রাখার জন্য। তোমার কোনো চিন্তা নেই।’

‘আমার কিচ্ছু চাই না সুলতান। আমি কেবল আপনাকে চাই। আপনি পাশে থাকলে আমার পৃথিবী পূর্ণ লাগে। আপনি ছাড়া বাকি সব শূন্য লাগে। আমি আপনার শাহজাদার মা হতে চাই।’

এবার থমকে গেলেন সুলতান। এক ঝটকায় হুররেমকে বুক থেকে সরিয়ে দিলেন। হুররেমের কথার কোনো উত্তর দিলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে কাফতান জড়িয়ে নিলেন। কোনো দিকে না তাকিয়ে খাস কামরার পাশের ছোট ঘরটির দিকে এগিয়ে গেলেন। পারগালি ইব্রাহিমের ডাক পড়লো।

সুলতান তখন একা একাই ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। ইব্রাহিমের আসতে কিছুক্ষণ দেরি হলো।

‘হুজুর আমাকে ডেকেছিলেন?’

‘এত দেরি? পারগালি? থাকো কোথায়?’

‘মাফ করবেন জাঁহাপনা বাবুস সালামের পাশেই ছিলাম।’

‘এত রাতে সেখানে কী?’

‘জাঁহাপনা ক্রিমীয় বণিকদের সঙ্গে রাতে একটা ছোট্ট গণ্ডগোল হয়েছে সে বিষয়েই শুনছিলাম।’

‘আচ্ছা কী হয়েছে জেনে দ্রুত ব্যবস্থা নাও। দরকার হলে আমাকেও জানাইও।’

‘জি জনাব।

এরপর কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ কেটে গেল। কারও মুখে কোনো কথা নেই।

‘হুজুর বেয়াদবি মাফ করবেন। এখন কী কোনো বিশেষ কারণে আমায় ডেকেছেন?’

‘নাহ! তেমন কিছু না। তোমার খবর বলো কেমন আছো পারগালি?’

এত রাতে এভাবে ডেকে এনে সুলেমান কুশলাদি জিজ্ঞেস করছেন ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে ইব্রাহিমের। খানিকটা থমকে গেল সে। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘এই আছি হুজুর। সব আপনার কৃপা।’

‘তোমার প্রতি আমার অনেক বিশ্বাস। তুমি আমার আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি। কখনো সে বিশ্বাস ভেঙ না ইব্রাহিম।’

‘হুজুর আমার কী কোনো ভুল হয়েছে?’

ইব্রাহিমের কণ্ঠে দ্বিধা আর ভয়।

‘না। সেরকম কিছু না। সামনে অনেক কাজ। তাই আগে থেকেই তোমাকে সাবধান করে রাখছি।’

‘হুজুর তেমন কিছু করার আগে যেন আমার মরণ হয়। আমি আপনার দাস। আর আপনার দাস হয়েই বাকি জীবনটা বিশ্বাসী থেকে কাটিয়ে দিতে চাই। এর বেশি কিছু আর চাওয়ার নেই।’

‘হুম। হারেমের খবর বলো ইব্রাহিম।’

‘হারেমের নতুন কোনো খবর নেই হুজুর। আপনার কোনো নির্দেশ?’

‘না। হুররেমের দিকে একটু খেয়াল রেখো।’

‘জি হুজুর। আমি কী তাকে খাস এর মর্যাদায় রাখার ব্যবস্থা করবো।’

‘করতে পারো।’

পায়চারি করতে করতেই উত্তর দিলেন সুলেমান। ইব্রাহিম তখনো অবনত চিত্তে দাঁড়িয়ে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে সুলতান সুলেমান খান অনেকটাই বিক্ষিপ্ত। এলোমেলো। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন করাটা ঠিক হবে না। হিতে বিপরীত হতে পারে।

‘ইব্রাহিম, হারেমের কাউকে তোমার পছন্দ হয়?’

সুলেমান আচমকা এমন একটা প্রশ্ন করে বসবেন ভাবতে পারেননি ইব্রাহিম। তাই কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন। একটু লজ্জাও পেলেন। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না।

‘চুপ কেন ইব্রাহিম? লজ্জা পাচ্ছ? আমার কাছে লজ্জা কিসের। আমি তো কেবল তোমার সুলতানই নই। তোমার ভাই, বন্ধুও। আমাকে এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।’

‘না, জাঁহাপনা। সবই আপনার কৃপা। আমি ভয় পাচ্ছি না। ঠিক কী উত্তর দেব বুঝে উঠতে পারছি না।’

‘আচ্ছা যাও উত্তর দিতে হবে না। আমি আজ থেকে হারেমের সুবিধা তোমার জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম। তুমিও পুরুষ মানুষ। বিনোদনের দরকার তোমারও আছে।’

‘ধন্যবাদ জনাব।’

‘হুম। ইব্রাহিম...’

বলেই থামলেন সুলেমান।

‘জি হুজুর।’

‘হুররেম মেয়েটাকে কেমন লাগে তোমার?’

‘জি। সুন্দর।’

‘উহু। সৌন্দর্যের কথা বলছি না। মেয়ে হিসেবে তাকে তোমার কেমন মনে হয়?’

‘মাফ করবেন হুজুর। আমি তো আর তাকে ভালোমতো চিনি না, তাই ভালো-মন্দ কোনো কিছু বলতে চাই না।’

‘এটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছ। এভাবে কারও সম্পর্কে কিছু বলা যায় না।’

‘জি হুজুর।’

‘তবে একটা কাজ করতে পার ইব্রাহিম।’

‘হুকুম করুন হুজুর।’

‘হারেমের ভেতর ওর সম্পর্কে খোঁজ লাগাও। ভালোমতো জানার চেষ্টা কর। আচ্ছা ওর কী কোনো কাছের বান্ধবী আছে হারেমে।’

‘থাকার কথা। কী যেন একটা মেয়ে। ওই মেয়েটা সারাক্ষণই ওর কাছে কাছে থাকে।’

‘মেয়েটা দেখতে কেমন?’

‘ভালোই।’

‘তাহলে তো হয়েই গেল। তুমি তার সঙ্গে সময় কাটাও। হুররেম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করো।’

‘জি হুজুর।’

‘পারলে আজই ডেকে পাঠাও।’

‘আজই?’

ইব্রাহিমের কণ্ঠে বিস্ময়।

‘কেন নয়? রক্ষী? কে আছ?’

দ্রুতই একজন ছুটে এলো।

‘দানা হালিলকে ডাকো।’

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলেন দানা হালিল।

‘জি হুজুর?’

‘হুররেম খাতুনের সঙ্গে সব সময় থাকে একটা মেয়ে। ওর নাম যেন কী?’

‘হুজুর, ইসাবেলা।’

‘হুম। তাকে তৈরি করে আনো দ্রুত।’

সুলতানের কথায় সায় দিলেন দানা হালিল। ইব্রাহিম তখন নীরব দর্শক। তীব্র ইচ্ছা করছিল সুরোর সায়রার কথা সুলতানকে বলে দিতে। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নেই। ব্যক্তিগত জীবনেও সুলতানের পছন্দ বেছে নিতে হচ্ছে।

‘কথা শেষ হয়নি দানা হালিল। ইসাবেলাকে পারগালি ইব্রাহিমের জন্য তৈরি করে আনো। খাস কামরা প্রধানের জন্য এটা আমার উপহার। আর আজ রাতে তুমি আশপাশে থাকবে। ইব্রাহিমের ছুটি।’

‘জি।’

বলেই একবার সুলতানের মুখের দিকে আরেকবার ইব্রাহিমের মুখের দিকে তাকালেন হারেমের রক্ষী দানা হালিল।

‘যাও!’

সুলতানের ধমক শুনে দ্রুত বিদায় নিল দানা হালিল। এবার ইব্রাহিমের দিকে তাকালেন সুলতান।

‘ইব্রাহিম কি চিন্তিত?’

‘জি না হুজুর।’

‘তাহলে এমন অন্যমনস্ক কেন?’

‘কই না তো’

‘ওহ! বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা যাও। এখন তোমার ছুটি। তোমার কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম করো। আর ইসাবেলার সঙ্গে কী বিষয়ে কথা বলবে মনে থাকবে তো?’

‘জি অবশ্যই।’

‘আবার দেখো কেবল কথা বলেই রাত কাটিয়ে দিও না যেন! হাঃ হাঃ হাঃ’

সুলতানের হাসিটা খুব অশ্লীল মনে হলো ইব্রাহিমের কাছে। তেমন কোনো ভাব ভঙ্গিমা দেখা গেল না। উল্টো সুলতানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল।

ইশারায় ইব্রাহিমকে বেরিয়ে যেতে বলল সুলতান। ইব্রাহিমও বিদায় নিলেন সুলতানের কাছ থেকে। কি যে হচ্ছে আর হতে যাচ্ছে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না ইব্রাহিমের। এত রাতে এত কিছু ঘটে যাবে কল্পনাই করেনি। কিন্তু এসব কিছুতে স্বয়ং সুলতানের নির্দেশ জড়িত। এখন আর কিছুই করার নেই। তখনই হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা— ইসাবেলা মেয়েটা যেন কেমন?

হারেমের ভেতর হৈচৈ পড়ে গেছে। এত রাতে ইসাবেলাকে স্মরণ করার ব্যাপারটা চোখে পড়েছে সবার। এর মধ্যেই দানা হালিল সবাইকে নিশ্চিত করেছেন সুলতান নয়, খাস কামরা প্রধান ইব্রাহিমের কক্ষই ইসাবেলার গন্তব্য। এ নিয়ে হারেমের মেয়েদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হলো।

তবে ইসাবেলাকে খুশিই মনে হলো। মাত্রই চোখ দুটো লেগে এসেছিল। পুরোপুরি ঘুম আসার আগেই দানা হালিলের ডাক ওকে চমকে দিয়েছে। এখন অবশ্য ঘুম কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। অজানা-অচেনা অভিজ্ঞতার চিন্তায় বেশ পুলক অনুভব করছে।

খুব করে সাজার চেষ্টা করল। হুররেম থাকলে ভালো হতো। ইসাবেলা যেমন হুররেমকে ভালো মতো সাজিয়ে দেয়, তেমন করে হয়তো সেও ইসাবেলাকে সাজিয়ে দিত। কিন্তু এখন তো সে উপায় নেই। নিজে নিজেই সাজতে হবে। হারেমের অন্য মেয়েরাও ঘুমে ব্যস্ত।

দানা হালিল দুয়েকবার কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু ইসাবেলাই তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। ইসাবেলার জন্য নতুন পোশাক, নতুন গয়না এসেছে। এই হারেমে আসার পর এ ধরনের পোশাক আর সাজের সুযোগ এবারই প্রথম পেল সে।

সবকিছুই কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে তার কাছে।

অনেকক্ষণের চেষ্টায় সাজগোজ প্রায় শেষ হলো।

‘ইসাবেলা, আর কতক্ষণ?’

দানা হালিল তাগাদা দিতে আসতেই বলল,

‘এই তো শেষ।’

ততক্ষণে কক্ষে ঢুকে গেছে দানা হালিল।

‘দেখেছ, আমার ম্যাজিক। আমাকে বলেছিলে আমি ব্যবস্থা করে দিলাম।’

‘কী ব্যবস্থা?’

‘উমা, পারগালি ইব্রাহিমের কথা আমাকে বলেছিলে না।’

‘উহ! হ্যাঁ।’

‘আমার উপহার চাই কিন্তু।’

‘উপহার পাবে। হুররেম খাতুনও তোমার জন্য উপহার তৈরি রেখেছে দানা হালিল। এত উতলা হওয়ার কিছু নেই।’

‘এখন তবে যাওয়া যাক, নাকি?’

‘হুম। খাস কামরা প্রধান পারগালি ইব্রাহিম তার কক্ষে অপেক্ষা করছেন। দ্রুত যেতে হবে।’

বের হওয়ার আগে কড়া সুগন্ধি মেখে নিল ইসাবেলা।

মনে প্রবল আকাঙ্ক্ষা ইব্রাহিম হয়তো এই সুবাস আর সুবাসিত মানুষ দুটোকেই সাদরে গ্রহণ করে নেবেন!

চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর