শিরোনাম
শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৫

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৫

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা শাসক তিনি। মুসলিম শাসকদের মধ্যেও সবার শীর্ষে সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লি বা হেরেম। এটা কেবল সুলতানের মনোরঞ্জনের ক্ষেত্রেই নয়, রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা গল্প-উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা।

 

উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সিংহাসনে তখন সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিম। সুলতান সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় অটোমান সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান খান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয়পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। এবারের পর্বে দেখা যাবে সুলেমানের রোডস অভিযানের পরিকল্পনা সম্পর্কে সবার অভিমত ও প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্ব। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো পঞ্চদশ পর্ব।

 

[পূর্ব প্রকাশের পর]

সকাল সকাল হারেমের ভিতর হৈচৈ পড়ে গেছে। ইসাবেলা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হেকিম হালিমের নেসা আর মালিদ আগা তাকে নিয়েই ব্যস্ত। অবশ্য তেমন কিছু হয়নি। পুরো ব্যাপারটাকেই মানসিক চাপ আর শারীরিক দুর্বলতা বলছে হেকিমরা। পারগালি ইব্রাহিমকে খুব বিব্রত আর বিপর্যস্ত মনে হলো। এ নিয়ে হারেমের মেয়েদের মধ্যে হাসাহাসির রোল পড়ে গেল। ঘটনা কী? সেজেগুজে পারগালি ইব্রাহিমের ঘরে গেল, ফিরল অসুস্থ হয়ে। ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যেই সেখানে দেখা গেল সুরুর সায়রাকে। পারগালি ইব্রাহিমের দিকে ক্ষোভের দৃষ্টিতে একবার তাকাল। পারগালি তখনো আড়ষ্ট ৎঙ্গিতে পায়চারি করছেন। বেগম সুলতানার পক্ষ থেকে মনজিলা খাতুন এসে খোঁজ নিলেন ইসাবেলার। সুলতানের নির্দেশ রাখতে গিয়ে এমন বাজে অবস্থা তৈরি হবে ভাবতে পারেনি পারগালি। কেউ কী বিশ্বাস করবে, এমন একটা বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল সামান্যই! আপাতত সেটা ভেবে মন খারাপ করতে রাজি নন ইব্রাহিম। সামনে অনেক সময়, অনেক কাজ। এমন ছোট্ট বিষয় নিয়ে এখন থেমে গেলে চলবে না। এরপরও সবকিছু ছাপিয়ে সুরুর সায়রার কথা বারবার মনে পড়ছে ইব্রাহিমের।

বেগম সুলতানার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন সুলতান সুলেমান।

‘জাফর আগার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছে। আপনার কী অভিমত আম্মা? আমি কী ঠিক করেছি?’

‘অবশ্যই। তুমি যা ভালো মনে করেছ সেটাই করেছ। অটোমান সাম্রাজ্যের দায়িত্ব তোমার কাঁধে। তাই এরকম দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে চলবে কেন?’

সুলেমানের মা আয়েশা হাফসা সুলতানের দৃঢ় কণ্ঠের জবাব অনুপ্রাণিত করল সুলতান সুলেমানকে।

‘বিষয়টি কেবল দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ছিল না আম্মা। সেই মানিসা থেকে জাফর আগার নির্যাতনের বিষয়ে শুনে এসেছি। মিসরীয়দের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, আনাতেলিয়ার কৃষকদের ওপর জুলুম নির্যাতনসহ শত শত অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। আর এসবের কোনোটাই অটোমানদের ন্যায়বিচার আর সত্যের শাসনের সঙ্গে যায় না।’

‘তুমি তোমার বাবার মতোই কথা বলছ। তোমার বাবাও বারবার ন্যায়বিচার আর সততার কথা বলতেন।’

‘জি আম্মা। আপনার অনুমতি পেলে আমি রোডস অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করতে চাই।’

‘এখনই?’

বেগম সুলতানার কণ্ঠে খানিকটা সংশয় দেখা গেল।

‘এখনই বলতে প্রস্তুতি শুরু করব। সার্বিক দিক বিবেচনা করে তারপর দিন-তারিখ ঠিক করে রওনা করব।’

সুলেমান মাকে ব্যাখ্যা দিলেন। বেগম সুলতানা একটু থামলেন। কাঁসার গ্লাসটা হাতে নিয়ে একটু গলা ভিজিয়ে নিলেন। তারপর বললেন,

‘অভিযানের কাজ শুরুর আগে জেনেসারিসদের খোঁজ নাও। নৌবাহিনী, অস্ত্রাগারের কী অবস্থা দেখে নাও। সবার আগে যেটা খোঁজ নিবে সেটা হচ্ছে রাজ কোষাগারের বর্তমান অবস্থা। আমি জানি এর সবই হয়তো তোমার মাথায় আছে। এরপরও তোমার বাবাকে আমি দেখেছি যে কোনো অভিযান শুরুর আগে এই বিষয়গুলো উনি ভালো করে দেখে নিতেন। মা হিসেবে আমি তোমাকে সেসব মনে করিয়ে দিচ্ছি।’

‘অবশ্যই আম্মা। আপনার কাছ থেকে নির্দেশনা নেওয়ার জন্যই আমি এসেছি। আর হ্যাঁ জেনেসারিসদের মধ্যে আমার প্রতিশ্রুত পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা এর মধ্যেই বিতরণ হয়ে গেছে। ওরা সবাই যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে আছে। খাসকামরা প্রধান পারগালি ইব্রাহিমের সঙ্গে আমি নিজেও বাইরে বেরিয়েছিলাম। বাজারে ঘুরে বেড়িয়েছি। আল্লাহর রহমতে দেশি-বিদেশি বণিক এবং সাধারণ জনতার মধ্যেও সব বিষয়ে মোটামুটি সন্তুষ্টি পেয়েছি। সবাই বড় একটি অভিযানের জন্য মুখিয়ে আছে।’

‘হুমম। আমি সেটা জানি। সবাই সুলতান সুলেমান খানের অগ্রযাত্রা দেখার আশায় বসে আছে। তুমি সভাসদ যারা আছেন উজিরে আজম পীরে মেহমুদ পাশা, ফেরাত পাশাসহ সবাইকে নিয়ে বসে তারপর যুদ্ধের পরিকল্পনা কর। আমি জানি, তোমার নেতৃত্বে অটোমানদের পতাকা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’

‘আপনি কেবল আমার জন্য দোয়া করবেন আম্মা। আমি যেন ঠিকভাবে এগোতে পারি।’

বলেই মায়ের কাফতানে চুমু খেলেন সুলতান সুলেমান। তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হলো শাহজাদা মুস্তাফা।

বাবাকে দেখেই দৌড়ে এসে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে।

সুলেমানও পরম স্নেহে পুত্রকে কোলে তুলে নিলেন।

‘আমার সিংহ পুত্র কেমন আছ?’

সুলেমানের প্রশ্ন।

‘ভালো নয়।’

মুস্তাফা মন খারাপ করে উত্তর দিল।

‘কেন কী হয়েছে? আম্মু বকেছে?’

পাশেই দাঁড়ানো মাহিদেৎরানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন সুলেমান।

‘উহু।’

মাথা নাড়ে মুস্তাফা।

‘তাহলে? তাহলে কী হয়েছে?’

‘আম্মু তোমার কাছে যেতে দেয় না। বলে তুমি খুব ব্যস্ত।’

‘আচ্ছা এই কথা? আম্মুতো মিথ্যে বলেনি। আমার কত কাজ! এত বড় একটা সাম্রাজ্যের সুলতান আমি। ব্যস্ত তো থাকিই।’

‘এখন আমি তোমার সঙ্গে খেলব।’

পুত্রের আবদারে থতমত খেয়ে গেলেন সুলেমান। সামনে কত কাজ! তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন—

‘আমিতো এখন খেলতে পারব না বাবা। আমার কাজ আছে।’

‘ছাড়...’

বলেই বাবার কোল থেকে দৌড়ে মাহিদেৎরানের দিকে চলে গেল মুস্তাফা।

রাগে সুলতানের চোখ গরম হয়ে এলো। বুঝতে পারলেন মাহিদেৎরান।

‘জাঁহাপনা কিছু মনে করবেন না। মুস্তাফা বাচ্চা মানুষ। আমি ওকে বুঝিয়ে বলব।’

‘মাহিদেৎরান, তুমি মুস্তাফাকে হেতিজার কাছে দিয়ে এসো। হেতিজার সঙ্গে থাকলে ওর ভালো লাগবে। আমি চললাম।’

বলেই মাহিদেৎরানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বেগম সুলতানার দিকে তাকালেন সুলেমান। তারপর কক্ষ ত্যাগ করলেন।

জেনেসারিসদের মাঝখানে এসে ভালোই লাগছে পারগালি ইব্রাহিমের। এত কাছ থেকে দুর্ধর্ষ এই যোদ্ধাদের সঙ্গে কখনোই মেশা হয়নি। তাদের জীবনাটাই কেমন যেন অদ্ভুত। এরা সবাই অল্পতেই আনন্দ পায়। যুদ্ধ আর অভিযান এদের কাছে নেশার মতো। কারও কারও কাছে যুদ্ধই জীবন। এর বাইরে সবকিছুই মিথ্যে। সুলতান সুলেমান খানকে নিয়ে প্রায় সব জেনেসারিস যোদ্ধারই প্রবল উচ্চাশা। তাদের বিশ্বাস সুলেমানের নেতৃত্বে অটোমানদের শাসন সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। পারগালির সঙ্গে আরেকজন এসেছেন জেনেসারিসদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি হাসান জং। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। সেই সেলিম খানের আমল থেকেই সুলতানের ব্যক্তিগত সহচর হিসেবে বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আর সে কারণে হাসান জংয়ের প্রতি সুলেমান খানেরও প্রবল শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। পারগালি ইব্রাহিম যখন জেনেসারিসদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে কথা বলছিলেন, হাসান জং তখন কিছুক্ষণের জন্য বাইরে বেরিয়েছিলেন। একটু পর যখন ফিরলেন, তখন সঙ্গে নিয়ে এলেন আরেকজনকে। লোকটার সারা মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। মাথায় অদ্ভুতভাবে একটা পাগড়ি বাঁধা। গায়ের পোশাক দেখে মনে হয় বেশ কদিন ধোয়া হচ্ছে না ওগুলো। লোকটার হাতৎর্তি কাগজ। কাছাকাছি আসতেই পারগালি ইব্রাহিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন হাসান জং।

‘ইনি মাতরাকচি নাসু। ইনি একজন গণিত, ইতিহাসবিদ, শিক্ষক, পেইন্টার, তলোয়ারবিদ সর্বোপরি একজন পণ্ডিত।’

পারগালি মাতরাকচি নাসুকে অভিবাদন জানালেন।

‘ইনি পারগালি ইব্রাহিম। আমাদের সুলতানের খাস কামরা প্রধান। অটোমান সাম্রাজ্যের শীর্ষ চার সিলমোহরের একটি তার দখলে।’

পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বললেন হাসান জং।

‘আমি উনাকে চিনি। সুলতানের ছোটবেলার বন্ধু। সুলতান তাকে আপন ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। সেই সুদূর পারগায় তার জন্ম। কিন্তু ছোটবেলায় ছিঁড়ে যাওয়া সেই নাড়ির টান এখন তার হৃদয়ের গভীরে কেবল মিটি মিটি করে জ্বলছে। আপাতত তার জীবনের পুরোটাই সুলতান সুলেমান এবং অটোমানদের জন্য উৎসর্গ করা। আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ এবং স্পষ্টবাদী।’

আশ্চর্য! লোকটা ইব্রাহিম সম্পর্কে এত কথা কী করে জানে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে ইব্রাহিম। মাতরাকচি নাসু সম্পর্কে আগ্রহ বোধ করলেন পারগালি।

‘আপনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন দেখছি!’

পারগালির ঠোঁটে মৃদু হাসি। জবাবে মাতরাকচিও একটু হাসলেন কেবল।

‘আমি আগেই বলেছিলাম, উনি পণ্ডিত মানুষ। অনেক কিছুই জানেন।’

হাসান জং যোগ করলেন।

‘হুম। তাইতো দেখছি। বসুন মাতরাকচি।’

ইশারায় মাতরাকচি নাসুকে বসার অনুরোধ করলেন ইব্রাহিম।

‘ইনি সুলতাননামা নামে একটা লেখা লিখছেন। ইতিহাস। বাইরে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেন আর লিখেন। সুলতান সেলিম খান একবার তাকে একশো স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিয়েছিলেন তার কাজে খুশি হয়ে। আমি ভাবলাম আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে আপনি তাকে সুলতান পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবেন। এতে তার যেমন সুবিধা হবে, তেমনি আমাদেরও কাজে দিতে পারে।’

হাসান জং বিনয়ের সঙ্গে মাতরাকচি নাসু সম্পর্কে পারগালিকে বুঝিয়ে বললেন।

‘হুম। কাজের মানুষ বটে। উনাকে সুলতানের কাছে নিয়ে যাব আমি। উনাকে আমার ভালো লেগেছে হাসান জং।’

পারগালির কথা শুনে হাসান জং এবং মাতরাকচি নাসু দুজনেই বিনয়ের সঙ্গে অভিবাদন জানালেন খাস কামরা প্রধানকে।

এরপর আরও কিছুক্ষণ জেনেসারিসদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন পারগালি ইব্রাহিম। অন্যান্য আলাপের পাশাপাশি সুলতানের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জেনেসারিসদের মতামত এবং সুলতানের নির্দেশনাও জানিয়ে দিলেন ইব্রাহিম।

অনেক্ষণ ধরেই নিজের ঘরে পায়চারি করছেন সুলতান সুলেমান। মাথার ভিতর যুদ্ধ জয়ের চিন্তা। বাবা সেলিম খানের আমলে তৈরি মানচিত্রটা ঘরের ভিতর বিছিয়ে রেখেছেন। এটার ওপর দিয়েই হাঁটাচলা করছেন। পারগালির খোঁজ করেছেন। কিন্তু সে নেই। জেনেসারিসদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে জেনে খুশিই হলো সুলেমান। এরপর পীরে মেহমুদ পাশাকে ডাকলেন।

‘উজিরে আজম আপনার শরীর ভালো।’

‘জি জনাব।’

‘আর কী অবস্থা বলুন।’

‘মাফ করবেন সুলতান ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি কিসের অবস্থা জানতে চেয়েছেন?’

ৎয়ে ৎয়ে সুলেমানকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন পীরে মেহমুদ পাশা।

‘আমি রাজ্যের অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করেছি। জাফর আগার মৃত্যু, রোডস অভিযানের প্রস্তুতিসহ আমার সব সিদ্ধান্তের বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।’

‘ওহ! হুজুর মিশ্র প্রতিক্রিয়া। প্রথমত মহান সুলতানের সিদ্ধান্তের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল। সবার মধ্যে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়েছে যে আপনি আপনার বাবা মহামান্য সুলতান সেলিম খানের চেয়েও বেশি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই বিষয়টি সবাই পছন্দ করেছে।’

‘আর অপছন্দ?’

সুলেমানের পাল্টা প্রশ্ন।

‘আপাতত কোনো অপছন্দ নেই। তবে বাজপাখি রক্ষক থেকে পারগালি

ইব্রাহিমের খাস কামরা প্রধান হওয়া নিয়ে অনেকে কানাঘুষা করেছে। এ ছাড়া জাফর আগার মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্তে কম-বেশি সবাই খুশি। এতে করে অটোমানদের ন্যায় বিচার আর সুশাসনের নজির আবারও প্রতিষ্ঠিত হলো। যে  ৬০০ মিসরীয় পরিবারকে আপনি নাগরিকত্ব দিয়েছেন তারা প্রত্যেকে খুশি। শুধু তাই নয় সাধারণ মিসরীয়রাও আপনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। আনাতেলিয়ার কৃষক ও কনস্টান্টিনোপলে বাণিজ্যরত দেশি-বিদেশি বণিকরাও খুশি।’

‘আপনার কী মনে হচ্ছে আমি ঠিক পথে এগোচ্ছি?’

‘অবশ্যই। এটাই সঠিক রাস্তা। আমারতো মনে হয় আপনার নেতৃত্বে অটোমান সাম্রাজ্য অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।’

‘আচ্ছা। আপনার কি মনে হচ্ছে না, আমাদের অভিযানে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।’

‘জি। অভিযান হতে পারে।’

একটু যেন ইতস্তত করলে পীরে মেহমুদ পাশা। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ালো না সুলতান সুলেমানেরও।

‘আপনি কি কিছু লুকাতে চাইছেন পাশা?’

সুলতানের প্রশ্ন চমকে দিল পীরে পাশাকে।

‘জি না। বলছিলাম কি আরেকটু সময় নিলে হতো না?’

‘সময়? কেন বলুনতো? সবাই কি তৈরি নয়?’

‘জি তৈরি। আমি বলছিলাম আপনি নিজে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানা, নৌবাহিনী, জেনেসারিস ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলে নিলে ভালো হতো।’

এবার হাসলেন সুলতান। তারপর বললেন—

‘পাশা আপনি ভুল বুঝছেন। ওসবতো আমি করবই। হুট করে নিশ্চয়ই আমি অভিযানে বেরিয়ে পড়ব না? একেবারে প্রাথমিক পর্যায় বলেই আপনার সঙ্গে পরামর্শ করছি। আপনি উজিরে আজম আপনার সঙ্গে প্রথমে পরামর্শ না করলে কি চলে? বাকি সব আস্তে আস্তে হবে।’

‘আপনি যা ভালো বুঝেন সুলতান। আমাকে কেবল নির্দেশ দিবেন। আমি আপনার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।’

‘হুম। আপনি আপনার দিক থেকে প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন। কোথাও কোনো কিছুর দরকার পড়লে আমাকে জানাবেন। আপাতত আমাদের গন্তব্য রোডস। রোডস অভিযানের জন্য রণপরিকল্পনা নিয়ে আমি কয়েকদিনের মধ্যেই সবার সঙ্গে বসব। আপনার দিক থেকে আপনিও একটা পরিকল্পনা তৈরি করুন।’

‘জি সুলতান।’

‘আপনি এখন আসতে পারেন।’

পীরে পাশা বিদায় নিচ্ছিলেন। সেই মুহূর্তে আবার ডাকলেন—

‘পাশা...’

‘জি সুলতান।’

‘রাজকোষের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানেন?’

‘মাফ করবেন, এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার ক্ষমতা কেবল আপনারই। তবে আমি যতদূর জানি আপনার বাবা সেলিম খানের বদৌলতে রাজ কোষাগার এখন কানায় কানায় পূর্ণ। আপনি চাইলে আমি প্রধান কোষাধ্যক্ষ খালিদ আগাকে পাঠিয়ে দিতে পারি। সে আপনাকে বিস্তারিত বলতে পারবেন।’

‘ধন্যবাদ, পাশা।’

সত্যিইতো—! অটোমানদের নিয়ম অনুসারে রাজকোষাগারের তথ্য কেবল সুলতানই জানতে পারেন। অন্যদের সেটা জানার কথা নয়। খামোখাই পীরে পাশাকে প্রশ্ন করেছেন সুলতান।

এর মধ্যেই সেখানে এসে হাজির হয়েছেন রাজকোষের প্রধান কোষাধ্যক্ষ খালিদ আগা। সুলতানকে কুর্নিশ করলেন তিনি।

‘হুজুর, আমায় ডেকেছেন?’

‘কী অবস্থা?’

‘জি সুলতান ভালো।’

‘রাজকোষের অবস্থা কেমন?’

‘জি ভালো।’

‘পরিসংখ্যান বলুন।’

কাফতানের পকেট থেকে খতিয়ান বের করলেন খালিদ আগা। তারপর বলতে শুরু করলেন—

‘মহামান্য সুলতান সেলিম খান রাজকোষ পূর্ণ করেই রেখেছেন। সর্বশেষ হিসাবমতে আমাদের রাজকোষে এই মুহূর্তে ৯৩ লাখ ৭০ হাজার ৩২০ স্বর্ণমুদ্রা রয়েছে। যা যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।’

‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন অভিযান চালানোর মতো অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের রয়েছে।’

‘অবশ্যই হুজুর। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে কম করে হলেও দুটি বড় অভিযান পরিচালনা করা যাবে। আর তাছাড়া জাফর আগাকে দিয়ে সুলতান সেলিম খান নৌ বাহিনী ও নৌবহর তৈরি করিয়ে রেখেছেন। এখানেও আমাদের খরচ কমে আসবে। এর বাইরে বাৎসরিক আয়তো যোগ হবেই।’

‘ভালো কথা বলেছেন। এই মুহূর্তে আমাদের বাৎসরিক আয় কত?’

‘পরিসংখ্যান বলছে অটোমানদের এই মুহূর্তে গড় বাৎসরিক আয় ১৫ লাখ স্বর্ণমুদ্রার চেয়েও বেশি। এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা আরও কিছুটা বেশি।’

‘হুম। আর বাৎসরিক খরচ?’

‘সাধারণ বছরের ক্ষেত্রে ৭/৮ লাখ স্বর্ণমুদ্রায় হয়ে যায়। তবে উৎসব কিংবা অন্যান্য উপলক্ষ থাকলে এই ব্যয় ১০/১২ লাখেরও বেশি হয়।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। প্রতি মাসে একবার করে আপনি আমাকে রাজকোষের অবস্থা জানিয়ে যাবেন। আসার আগে খাস কামরা প্রধান পারগালি ইব্রাহিমের কাছ থেকে সময় জেনে নেবেন।’

‘জি সুলতান। আমি কি এখন যাব?’

‘যেতে পারেন। এমন বিশেষ কিছু আছে যা আমাকে জানাতে চান?’

একটু যেন চিন্তায় পড়ে গেলেন খালিদ আগা। তারপর বললেন—

‘হুজুর মাফ করবেন। আপাতত মনে পড়ছে না। তবে তেমন কিছু মাথায় আসলেই আমি সবার আগে আপনাকে জানাব।’

‘তাই যেন হয়।’

‘জি।’

ইশারায় খালিদ আগাকে কক্ষ ত্যাগ করতে বললেন সুলেমান। সঙ্গে সঙ্গেই পারগালির প্রবেশ।

‘সুলতান আমায় স্মরণ করেছিলেন?’

‘পারগালি, বাইরে গিয়েছিলে?’

‘জি হুজুর। জেনেসারিসদের সঙ্গে আলাপ হলো।’

‘কী বলছে ওরা?’

‘ওরা আপনার ওপর দারুণ খুশি। বিশেষ করে ওই পাঁচ হাজার স্বর্ণমুদ্রা পাওয়ার পর আপনার নেতৃত্বে নতুন অভিযানে যাওয়ার জন্য পাগলই হয়ে আছে ওরা।’

‘আচ্ছা। কেউ বাজে কিছু বলেনি?’

‘একদমই নয়।’

‘এরপরও ওখানে আমাদের দু-একজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়োগ দিয়ে দাও। যেন সব তথ্য সবার আগে হাতে আসে।’

‘সেই ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে।’

‘মানে?’

‘আমি হাসান জংকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে মহামান্য সুলতান সেলিম খানের পনেরজন বিশ্বস্ত সেনা আছেন। তাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমি আপনার পক্ষ থেকে তাদের জরুরি তথ্য দানের জন্য বকশিশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছি।’

‘বেশ করেছ। তোমার কাজে আমি খুশি।’

‘সব আপনার কৃপা সুলতান।’

‘তারপর গতকাল রাতের কথাতো কিছুই বললে না ইব্রাহিম। কেমন কাটল?’

সুলতানের ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি। পারগালি ইব্রাহিমের উত্তর আসার আগেই সুলতানের কক্ষের দূত এসে হাজির হলো।

‘কী হয়েছে?’

সুলতানের প্রশ্ন।

‘হুজুর হাসান জং এসেছেন।’

‘ভিতরে পাঠিয়ে দাও...ইব্রাহিম সে আলাপে পরে আসছি।’

‘জি হুজুর।’

ইব্রাহিম তখনো লজ্জা পাচ্ছে। সুলতানের ঠোঁটেও মৃদু হাসি।

‘হাসান জং বলুন, কী খবর এনেছেন?’

‘হুজুর জেনেসারিসরা অভিযানের জন্য তৈরি। আর তারা আপনার সিদ্ধান্তে দারুণ খুশি। ওদের বিশ্বাস আপনার নেতৃত্বে ওরা ঠিক বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারবে।’

‘হুম। ধন্যবাদ হাসান জং। পারগালি আমাতে সে কথাই বলছিল। আপনারা দুজন এ ধরনের যোগাযোগগুলো বাড়ান। আমার বাবার বিশ্বস্ত লোকদের কাছে টানুন। আমাকে যেমন জানাতে পারেন, তেমনি ছোটখাটো বিষয়গুলো পারগালির সঙ্গে আলাপ করতে পারেন। মনে রাখবেন সামনে অভিযান। এখন ছোটখাটো কোনো ভুলও করা যাবে না।।’

‘জি হুজুর। অবশ্যই। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’

‘আপনার ওপর সে বিশ্বাস আমার আছে। আপনি কেবল আপনার ধারণা ও বিষয়গুলোর ওপর নজর রাখুন। এতেই চলবে।’

‘আপনার যেমন হুকুম সুলতান!’

 

চলবে .... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর