শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৮

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ১৮

 মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমনি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। এই শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লি বা হেরেম। রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে। সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান। এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয়পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। এবারের পর্বে দেখা যাবে সুলেমানের রোডস অভিযানের পরিকল্পনা সম্পর্কে সবার অভিমত ও প্রস্তুতির নানা দিক। প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো আঠারোতম পর্ব।

 

[পূর্ব প্রকাশের পর]

সুলতানের ছেলে হওয়ার কারণে কি না কে জানে মোস্তফার মধ্যে এক ধরনের ঔদ্ধত্য দেখা যাচ্ছে। অথচ অটোমান উত্তরাধিকারীদের এ শিক্ষা দেওয়া হয় না। সে কারণেই মোস্তফার গালে হাত রেখে আদরের সুরে বুঝিয়ে দিলেন ইব্রাহিম। মোস্তফা তবু মানছে না।

‘তাহলে কি উনি আমার ছবি এঁকে দেবেন না?’

‘নিশ্চয়ই দেব শাহজাদা। আপনার নির্দেশ অমান্য করি কী করে?’

এবার মাতরাকচি নিজেই মুখ খুললেন।

মাতরাকচির কথায় খুশি মনে হলো শাহজাদা মোস্তফাকে। মুহসিন আর রব পাশেই দাঁড়ানো ছিল। ইশারায় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন পারগালি।

‘শাহজাদাকে মাহিদেভরান সুলতানের কাছে নিয়ে যাও।’

এবার আর কোনো কথা বলল না মোস্তফা। চুপচাপ মুহসিনের আঙ্গুল ধরে  হেরেমের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

নির্বিষ আলস্যে একের পর এক দিন কেটে যাচ্ছে মাহিদেভরানের। একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন। মানিসায় থাকাকালে যদিওবা খানিকটা আনন্দ ছিল, এখানে আসার পর সব কেমন যেন পাল্টে গেছে। সময়ের পিঠে চড়ে মাহিদেভরানের প্রিয়তম সুলেমান যেন দূর থেকে আরও দূরে চলে যাচ্ছেন। অনেক ভেবেও এর কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না মাহিদেভরান। এদিকে শাহজাদা মোস্তফা বড় হচ্ছে। তাকে ঘিরেই এখন বাকি সব চিন্তা। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে করে নতুন শাহজাদা আসাটা যেমন অসম্ভব নয়, ঠিক তেমনি মোস্তফার একচ্ছত্র আধিপত্যটাও মোটামুটি ঝুঁকির মুখে। সব কিছুই মাহিদেভরানের উপলব্ধির আয়নায় দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

মোস্তফাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মাহিদেভরানের পেছন দিকে এসে বসল সারা খাতুন। আলত করে মাহিদেভরানের চুলে হাত রাখল। তারপর সেই চুল গুছিয়ে দিতে আরম্ভ করল। ঘুমানোর আগে সারা খাতুনের এমন সাহচর্যটা মাহিদেভরানের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

‘ওই মিসরীয় মেয়েগুলোকে আদব-কায়দা শেখানো হচ্ছে?’

সারা খাতুনকে জিজ্ঞাসা করলেন মাহিদেভরান সুলতান।

‘জি সুলতানা। ইনারন খাতুনকে বেশ ভালোমতো বলে দেওয়া হয়েছে। এবার আর এলোমেলো কিছু হবে না।’

‘হুমম। বেগম সুলতানার চোখে পড়লে কিন্তু আরও বেশি বিপদ হতো। হারেমের রীতির বাইরে কোনো কিছু তার পছন্দ নয়।’

সারা খাতুন আর মাহিদেভরানের আলাপন তখনো চলছিল। হঠাৎই সেখানে হাজির হলেন উম্মুস আলাতুন। তিনি একজন খোজা। গেট অব ফেসিলিটির পাশেই প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন। তার আরেকটা পরিচয় হচ্ছে মাহিদেভরান তাকে মানিসা থেকে নিয়ে এসেছেন। স্পষ্ট করে বললে, উম্মুস আলাতুন মাহিদেভরানের খাস লোক। গোপন সংবাদদাতা। কাজ করার ফাঁকে ব্যতিক্রম কিছু চোখে পড়লেই মাহিদেভরানের কাছে ছুটে আসে সে।

‘মাফ করবেন মালিকা, এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করলাম বলে।’

‘কোনো সমস্যা নেই আলাতুন। তুমি নির্ভয়ে বল। আমি জানি কারণ ছাড়া তুমি এখানে আসনি।’

আলাতুনকে অভয় দিলেন মাহিদেভরান।

‘আমার ওপর এই বিশ্বাস রাখার জন্য ধন্যবাদ মালিকা। একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর এনেছি। এখানেই বলব? নাকি...’

সারা খাতুনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল আলাতুন। মাহিদেভরান বুঝতে পারলেন।

‘কোনো সমস্যা নেই আলাতুন। সারা খাতুন আমার খাস লোক। তুমি তার সামনে বলতে পার।’

‘মালিকা, আলেকজান্দ্রা মানে হুররেম খাতুনের খবর রাখতে বলেছিলেন। আজ দুপুরে তিনি খাস কামরা প্রধান পারগালি ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা করেছেন।’

আলাতুনের কণ্ঠে উত্তেজনা থাকলেও মাহিদেভরানের মধ্যে কোনো আগ্রহই খুঁজে পাওয়া গেল না। মাহিদেভরান বললেন,

‘ইব্রাহিম খাস কামরা প্রধান। আর হুররেম জাঁহাপনার খাস বাঁদি। এদের মধ্যে দেখা হতেই পারে। এখানে খবরটা কোথায় আলাতুন?’

‘মাফ করবেন সুলতানা। আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারিনি। আসলে এদের দেখা করাটা যে খুবই স্বাভাবিক বিষয় তা আমি নিজেও জানি। কিন্তু মালিকা— হুররেম খাতুন হারেমের বাইরে এসেছিলেন আজ। পারগালি ইব্রাহিমের প্রশাসনিক কক্ষে গিয়েছিলেন। আর আমি যতটুকু জানি নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া হারেমের মেয়েদের নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ। হুররেম খাতুন কেবল সেই সীমাটাই ছাড়িয়ে যাননি বরং কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে পারগালির সঙ্গে দেখা করেছেন।’

এবার একটু আগ্রহ খুঁজে পেলেন মাহিদেভরান।

‘ওদের মধ্যে কি ধরনের কথা হয়েছে বলতে পার।’

‘জি না মালিকা। দেখা করার বিষয়টি ছাড়া আমার কাছে আর কোনো তথ্য নেই।’

‘আচ্ছা, তুমি এখন যাও। সকালে এসে তোমার বকশিশ নিয়ে যেও।’

আলাতুন চলে যেতেই স্বরূপে ফিরল সারা খাতুন।

‘মালিকা— পারগালি ইব্রাহিম তো আমাদের পক্ষের মানুষ। তার সঙ্গে হুররেম খাতুনের কী কাজ?’

‘সেটাই তো আমাকে ভাবাচ্ছে সারা খাতুন।’

‘নিশ্চয়ই বদ মেয়েটা ইব্রাহিমকে বাগে আনতে চাইছে। যাতে করে ওর সব ষড়যন্ত্র বাস্তবে রূপ দেওয়া সহজ হয়।’

সারা খাতুনের কথাটা গভীর রেখাপাত করল মাহিদেভরানের মনে। সত্যিই কী তবে পারগালিকে সঙ্গে নিয়ে কোনো ফন্দি করছে হুররেম?

‘মালিকা হুররেম খাতুন নিয়ম ভেঙে হারেমের বাইরে গেছেন— এই কথাটা বেগম সুলতানাকে জানিয়ে দিই। প্যাঁচ লাগবে।’

সারা খাতুনের কথা শুনে আঁতকে উঠলেন মাহিদেভরান।

‘পাগল হয়েছ! হুররেম অন্য কোনো কাজে যায়নি। পারগালি ইব্রাহিমের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। পারগালি ইব্রাহিম জাঁহাপনার খাস কামরা প্রধান। নিয়ম ভাঙার বিষয়টি পারগালির অজানা নয়। এরপরও যদি তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন তাহলে বুঝতে হবে অন্য কোনো ঝামেলা আছে। আপাতত আমরা এটার সঙ্গে না জড়ানোই ভালো।’

‘তাই বলে হুররেমকে এভাবে ছেড়ে দেবেন মালিকা?’

‘ছেড়ে দিচ্ছি না সারা। বাগে পাওয়ার অপেক্ষা করছি। এই নাগিনকে সুলেমানের জীবন থেকে সরাতে হবে। ওর কত বড় সাহস সুলেমানের খাস কামরা প্রধানকেও হাত করতে চাইছে।’

‘অসভ্য মেয়েটার বুদ্ধি আছে মালিকা।’

‘আমিও দেখি এই বুদ্ধির জোরে হুররেম খাতুন কতদূর যেতে পারে।’

‘কিন্তু মালিকা সুলতানই তো আপনার থেকে দূরে দূরে থাকছেন। এই সুযোগে হুররেম কিন্তু সুলতানের খুব কাছে চলে যাচ্ছে!’

সারা খাতুনের কথা শুনে অল্পক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন মাহিদেভরান। মাঝে মাঝে সারা মেয়েটা খুব বড় কথা বলে ফেলে। কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও এর তাত্পর্য কিন্তু অনেক বড়। এই কথাটাও খারাপ বলেনি সে। এরপরও মাহিদেভরান নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন।

‘ভুলে যেওনা সারা আমি এখনো এখানকার সুলতানা। আমার সমকক্ষ কেউ নেই। আমার সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। আমি সুলতান সুলেমানের একমাত্র বৈধ স্ত্রী এবং শাহজাদা মোস্তফার মা।’

সারা খাতুন বুঝতে পারলেন মাহিদেভরানের মেজাজ বিগড়ে গেছে। স্বভাবতই আর কথা বাড়াবে না সে।

কনস্টান্টিনোপলের আকাশে বাতাসে যুদ্ধের সুর। অল্পদিনের মধ্যেই হয়তো সেই সুর যুদ্ধের গন্ধ বয়ে আনবে। জেনেসারিস থেকে শুরু করে কনস্টান্টিনোপলের বণিকরাও সুলতানার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনায় মত্ত। অধিকাংশের বিশ্বাস সুলতান ঠিক শেষ পর্যন্ত বিজয় ছিনিয়ে আনবেন। হয়তো খুব শিগগিরই অটোমানদের পতাকাতলে মাথা নুইয়ে দেবে রোডসের দস্যুরা। সুলতান সেলিম খানের মৃত্যুর পর চারপাশে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। সুলেমানের সিংহাসনে আরোহণ করার মাধ্যমে যে নতুন সূর্যোদয় হয়েছিল তারই বাস্তবায়ন দেখতে চাইছে তুর্কিরা। আর সবকিছুর অগ্রভাবে একজনই। তিনি অটোমান সূর্য— সুলতান সুলেমান স্বয়ং। তিনি নিজেই  যুদ্ধযাত্রার ছক আঁকছেন। সুলতানের দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই তার বড় অভিযান। এর আগে মিসরীয়দের বিদ্রোহ দমন করলেও সেটি তেমন কোনো অভিযান ছিল না। সুলতান ক্ষমতায় অরোহণের ঠিক পরপরই মিসরে বিদ্রোহের খবর আসে। সেই বিদ্রোহ দমনে সফল হয়েছেন সুলতান। কিন্তু রোডস অভিযান এত সহজ কোনো বিষয় হবে না। এটাই সবাইকে বোঝাচ্ছিলেন সুলতান। পীরে মেহমুদ পাশা, পারগালি ইব্রাহিম, আহমেদ পাশা, হাসান জং, মাতরাকচি নাসুসহ সবাই নিবিড় শ্রোতা। সুলতানের কথার ফাঁকে পীরে মেহমুদ পাশা ঢুকে পড়লেন হঠাৎ করেই।

‘সুলতান আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই— এটাই কিন্তু রোডস অভিমুখে অটোমানদের প্রথম অভিযান নয়।’

‘ঠিক বলেছেন পাশা। আমি সেটা জানি। আর জানি বলেই আমি এবার আরও বেশি সতর্ক হতে চাই। ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ার মতো বোকা আমি নই পাশা। এই অভিযানের পুরনো ইতিহাস কি আপনি সবাইকে একটু মনে করিয়ে দিবেন?’

‘আগের অভিযানের কথা?’

পীরে মেহমুদ পাশা নিশ্চিত হতে চাইলেন।

‘হুমম।’

‘হুজুর এর আগে রোডস অভিযানে আমাদের একাধিক ব্যর্থতার নজির আছে। সুলতান মেহমুদ প্রায় ২০০ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে রোডসে অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হন। পরে আপনার দাদা সুলতান বায়োজিদও রোডস বিজয় করতে চেয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য তার অভিযানও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।’

‘এবার আর আমরা ব্যর্থ হব না পাশা। ইনশাআল্লাহ জয় আমাদের হবেই।’

দৃঢ় কণ্ঠে বললেন সুলতান।

পীরে মেহমুদ পাশা আরও কিছু বলতে চাইলেন।

‘হুজুর আপনার দাদার অভিযানের সঙ্গে আরও কিছু লুকানো সত্য আছে। আপনার অবশ্য জানা থাকার কথা। এরপরও মনে করিয়ে দিতে চাই।’

‘অবশ্যই পাশা। নির্ভয়ে বলুন। আমাদের সবারই এ সম্পর্কে জানা থাকা দরকার।’

‘হুজুর আপনার দাদার অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর সুলতান বায়োজিদের সৎ ভাইকে রোডস আর ভেনিসের দস্যুরা বন্দী করে রাখে। পরবর্তীতে তারা তাকে অটোমানদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। উল্টো তাদেরই হত্যা করা হয়েছে। এখন আপনার দাদার সন্তানরা সেখানে কারাবাস করছেন। আপনাকে জানিয়ে রাখতে চাই তারা কিন্তু আপনাকে শত্রুজ্ঞান করে। অটোমানদের ঐশ্বর্য ওদের মনে ঘৃণার বীজ তৈরি করেছে। রোডস আর ভেনিসের দস্যুরা মিলে আপনাদের সম্পর্কে ওদের মনে প্রবল প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এটা নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে।’

‘আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন পীরে পাশা। এই অভিযান সফল করতে হলে ছোট ছোট বিষয় থেকে শুরু করে সব বিষয়ে সমানভাবে সাবধান থাকতে হবে। অল্প একটু ভুলও আমাদের পূর্বপুরুষদের পরিণতি ডেকে আনতে পারে।’

‘জি জনাব। আপনি ঠিক কথাটিই বলেছেন। আর অভিযান শুরুর আগে আমাদের সর্বশেষ গুপ্ততথ্যও জেনে নিতে হবে।’

অনেক্ষণ চুপ থাকার পর মুখ খুললেন হাসান জং।

‘সেজন্য তো আপনি আছেনই হাসান জং। আপনার লোকদের এখনই খবর পাঠান। পারগালি তুমি মাতরাকচির সঙ্গে কথা বল। আমি চাই রোডসে কম করে হলেও পাঁচশো মানুষ আমাদের পক্ষে কাজ করুক। সেজন্য চেনা-জানা পরিচিত লোকদের বণিক হিসেবে সেখানে পাঠিয়ে দাও। যার যার দায়িত্ব ভাগ করে দাও। এদের কাজ হবে সেখানকার স্বাভাবিক পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া। সেখানকার যে কোনো ঝামেলা এরা উসকে দেবে। আবার আমরা যখন আক্রমণ করব তখন প্রাসাদের দরজা খুলে দেওয়া থেকে শুরু করে আমাদের সবকিছুতে ওরা সাহায্য করবে।’

চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে কথাগুলো বললেন সুলতান সুলেমান খান জং এ বাহাদুর। দৃষ্টিজুড়ে বিজয়ের নেশা।

‘অতি উত্তম পরিকল্পনা জাঁহাপনা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আমি ঠিকভাবে পালন করব।’

পারগালির সহজ উত্তর।

‘যুদ্ধ জাহাজের কী অবস্থা? আহমেদ পাশা?’

‘কাজ চলছে হুজুর। আমার লোকেরা দিন রাত পরিশ্রম করছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ওগুলো তৈরি হয়ে যাবে। এরপর আপনাকে দেখাতে নিয়ে যাব হুজুর।’

‘শুনুন আহমেদ পাশা ২০০ কিংবা ২৫০ নয়, আমি চাই কম করে হলেও ৫০০ যুদ্ধ জাহাজ থাকবে আমাদের বহরে। এবারের অভিযানে আমি কোনো খাদ রাখতে চাই না।’

‘কিন্তু হুজুর আমাদের তো ৩০০ জাহাজের পরিকল্পনা ছিল।’

রেগে গেলেন সুলেমান।

‘মূর্খের মতো কথা বলবেন না পাশা। আমি তো বলেছি এই পরিকল্পনায় আমি কোনো ফাঁক রাখতে চাই না। আমার পূর্ব পুরুষদের মতো ব্যর্থ হতে চাই না। বরং তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চাই। আর সেজন্য আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকতে হবে। রাজকোষাগার থেকে অর্থ নিন। দ্রুত বাঁশ কাঠ জোগাড় করুন। এর মধ্যেই আমি আরও ২০০ জাহাজ তৈরি দেখতে চাই।’

‘জি সুলতান।’

একেবারে চুপসে গেছেন আহমেদ পাশা। সুলতানের কাছে এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি বুঝতে পারছেন তিনি। কিন্তু যতক্ষণে বুঝতে পারলেন ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

পারগালি কিছু বলার জন্য উসখুস করছিল। সাধারণত কিছু বলতে চাইলে পারগালি তার দুহাত চুলকায়। এমন অবস্থা এর আগেও বেশ কয়েকবার খেয়াল করেছেন সুলতান। সেজন্য পারগালিকে এরকম দেখেই জিজ্ঞেস করলেন,

‘পারগালি, কিছু বলবে?’

সুলেমানের এই এক গুণ। কীভাবে যেন সব বুঝে যান। অবাক হয়ে ভাবে পারগালি।

‘হুজুর মাতরাকচির সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তিনি হালকা অথচ দ্রুতগামী জাহাজের কথা বলছিলেন। এতে আমাদের যেমন অনেক সময় বেঁচে যাবে তেমনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও সুবিধা হবে। খরচও অনেক কম হবে।’

‘কারিগররা কী বলে?’

সুলতান জানতে চাইলেন।

‘আমি আপনার অনুমতি ছাড়াই ছোট্ট পাতলা একটি জাহাজ তৈরি করেছি। আর সেটি দারুণ মনে হচ্ছে আমার কাছে। আপনি মাতরাকচিকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না।’

মাতরাকচির দিকে আঙ্গুল ইশারা করলেন পারগালি। সুলতান কিছু বলার আগেই বলতে শুরু করলেন মাতরাকচি।

‘হুজুর আমার কাছেও একেবারে উপযুক্ত মনে হচ্ছে। আমি ঠিক যেমন ভেবেছি তেমন। যদি বড় জাহাজগুলোতে আমাদের রসদ থাকে তাহলে ছোট জাহাজগুলো আগে পাঠিয়ে দেব। সেখানে কেবল অল্পদিনের রসদ আর সৈন্যদের অস্ত্রশস্ত্র থাকবে। প্রথমে ২০০ ছোট জাহাজ রোডসের দিকে যাবে। ওরা জানবে আমাদের জাহাজ মাত্র ২০০। কিন্তু পেছনে থাকা বাকি ৩০০ জাহাজের ধাক্কাটা ওরা আর সামলাতে পারবে না। তখন আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত।’

‘দারুণ! চমৎকার প্রস্তাব। আহমেদ পাশা আপনি পারগালির পছন্দমতো বাকি জাহাজগুলো তৈরির ব্যবস্থা নিন। পরিকল্পনাটা আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে। অভিনন্দন পারগালি এবং মাতরাকচি!’

ইব্রাহিম আর মাতরাকচি নাসু দুজনেই মাথা ঝাঁকিয়ে সুলতানের অভিনন্দন বার্তা গ্রহণ করলেন। ওদিকে আহমেদ পাশা রাগে ফুঁসছেন। পারগালির কোনো কিছুই তার পছন্দ নয়। আর এখন তো সুলতান সরাসরি পারগালির প্রস্তাবে সায় দিলেন, প্রশংসা করলেন। প্রবল হিংসুটে আহমেদ পাশার খারাপ লাগারই কথা!

‘অস্ত্রাগারের কী অবস্থা পীরে পাশা?’

‘হুজুর রাতদিন কাজ চলছে। এখানে আসার আগেও আমি আর খাস কামরা প্রধান ইব্রাহিম পাশা অস্ত্রাগার ঘুরে এসেছি। আপনি চাইলে যে কোনো সময় পরিদর্শনে যেতে পারেন।’

পীরে পাশার উত্তরের সঙ্গে আরও কিছু যোগ করলেন পারগালি ইব্রাহিম। বললেন, ‘হুজুর আমার মনে হয় জলদিই আপনার সেদিকে একটা যাওয়া উচিত। আপনি গেলে একদিকে যেমন নিজের চোখে অগ্রগতি দেখে আসতে পারবেন, ঠিক তেমনি অন্যদিকে কর্মীরাও কাজে বিশেষ উদ্যম পাবে।’

‘হুমম। যাব। কালই। ব্যবস্থা কর ইব্রাহিম।’

সেদিনের মতো বিশেষ সভা শেষ হয়ে গেল। সুলতান হারেমের দিকে চলে গেলেন। মোস্তফাকে একটু সময় দেওয়া দরকার।

‘তুমি কাজটা একদম ঠিক করনি হুররেম। খুব বাজে একটা কাজ হয়েছে।’

হুররেমকে কড়াভাবে কথাগুলো বলল ইসাবেলা। জবাবে খিল খিল করে হেসে উঠল হুররেম।

‘তোমার কী হিংসে হচ্ছে ইসাবেলা? কী ভাবছ তুমি? তোমার ইব্রাহিমকে আমি নিয়ে যাব?’

হুররেমের হাসি তখনো থামছে না।

‘আমি তা বলিনি হুররেম। আমি বুঝাতে চেয়েছি তুমি সুলতানের খাস বাঁদি। আর ওদিকে পারগালি ইব্রাহিম সুলতানের খাস কামরা প্রধান। তুমি তার আহ্বান ছাড়াই তাকে চুমু খেয়েছ। এখন যদি পারগালি তোমার শাস্তির ব্যবস্থা করে তখন কী হবে?’

ইসাবেলার কথা শুনে আরেকবার হাসে হুররেম। মনের ভিতর তার বিশাল পরিকল্পনা। আর হুররেমকে বলছে সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে।

‘ধুর বোকা মেয়ে। তাকাও আমার দিকে। দেখ ভালো করে। আমি কী দেখতে অসুন্দর? আমার এই দেহাবয়ব স্বয়ং সুলতানকে চুম্বকের মতো কাছে টানে। সেই তুলনায় ইব্রাহিমতো চুনোপুঁটি। ইব্রাহিমকে কাত করাও আমার কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। আমিতো দেখেছি ইব্রাহিমের চোখেমুখে কিসের চাউনি ছিল। আর কখনো শুনেছ কোনো পুরুষকে চুমু খাওয়ার অপরাধে কোনো নারীর শাস্তি হয়েছে? বোকা মেয়ে কোথাকার।’

ইসাবেলার তবু সংশয় কাটে না। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,

‘কিন্তু আমার কাছে তো মনে হয়েছে পারগালি ইব্রাহিম তেমন মানুষ নন।’

‘হয়তো তোমার কথাও ঠিক ইসাবেলা। কিন্তু ভুলে যেও না যেমনই হোক পারগালি ইব্রাহিমও কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ত মাংসের মানুষই। ভুল তিনিও করতে পারেন।’

‘এটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছ হুররেম। কিন্তু আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। তুমি কখন যে কোনো বিপদ ডেকে আন।’

‘ভয় পেওনা ইসাবেলা। আমি বিপদ নয়, সৌভাগ্য ডেকে আনছি। আমার পাশে থাক। আমি শাহজাদার মা হব। আর তুমি হবা সুলতানার সবচেয়ে কাছের মানুষ।’

‘এটা কী সত্যি হবে? নাকি কেবলই স্বপ্ন?’

‘স্বপ্ন কেন হবে ইসাবেলা? সব বাস্তব হবে। তুমি শুধু আমার পাশে থাকবে। কি থাকবে না?’

চোখ গরম করে ইসাবেলাকে জিজ্ঞেস করল হুররেম। এমন চোখে তাকালে ইসাবেলা কেন, যে কেউই হুররেমকে হ্যাঁ বলে দেবে। ইসাবেলাও না করতে পারল না।

‘শোনো আজ আবার তোমাকে পারগালির কাছে পাঠাব। দানা হালিলের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। সুলতান আমাকে ডেকেছেন। আর তুমি যাবে পারগালির কাছে। আমি সুলতানের কক্ষে যেয়ে সব ব্যবস্থা করব।’

‘আজই!’

‘তোমাকে না বলেছি ভয় পাবে না। আমরা কেন ভয় পাব? আমাদের ভয়ের কিছু নেই। আমরা বরং সব প্রতিকূলতাকে জয় করব। একদিন সব আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। তখন আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।’

হুররেমের দাঁতে দাঁত চেপে এসেছে। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে কোনোকিছু বলতে গেলেই এমন হয় হুররেমের।

‘ইব্রাহিম যদি আমাকে দেখে বিরক্ত হয়?’

‘হবে না। কারণ তুমি ইব্রাহিমের কাছে যাবে সুলতানের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে। বললাম তো সে ব্যবস্থা আমি করব। এ নিয়ে তোমার কোনো চিন্তা নেই।’

‘উহ! হুররেম তোমাকে আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি।’

‘কী কথা?’

‘হেরেমের একটা মেয়ে আমাকে হুমকি দিয়েছে।’

‘হুমকি, তোমাকে? কার এত বড় সাহস?’

প্রচুর মেজাজ খারাপ হচ্ছে হুররেমের।

‘কী যেন নাম মেয়েটার? সুরোর সায়রা। ও বলে কি না ইব্রাহিমের কাছে গেলে নাকি আমাকে সে খুন করে ফেলবে।’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। সেটাই বলেছে।’

‘তা তুমি আমাকে আগে বলনি কেন?’

‘মনে ছিল না।’

‘আচ্ছা ওকেও আমিই মজা দেখাব। তুমি কোনো টেনশন কর না।’

চলবে...পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর