শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ধারাবাহিক উপন্যাস

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ২৪

রণক ইকরাম

অটোমান সূর্য সুলতান সুলেমান পর্ব ২৪

মুসলিম শাসকদের মধ্যে যেমন শীর্ষে, তেমন পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম সেরা শাসক তিনি। সুলতান সুলেমান খান। অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান। এই শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল রাজ্যের সেরাগ্লি বা হেরেম। রাজ্যের ক্ষমতাশালী সব নারীর বসবাসই ছিল এখানে। আবার কখনো কখনো সাধারণ যৌনদাসী থেকে সুলতানা হয়ে বিশ্ব কাঁপিয়েছেন কেউ কেউ। সুলতান সুলেমানকে নিয়ে অনেক গল্প লেখা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে আলোচিত-সমালোচিত টিভি সিরিয়াল মুহতাশিম ইউজিয়েল। আমাদের এই উপন্যাসের ভিত্তি সেই টিভি সিরিজ বা উপন্যাস নয়। মূলত ইতিহাসের নানা বইপত্র ঘেঁটে সুলতান সুলেমানের আমলটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিহাস আশ্রয়ী এই উপন্যাসের মূল ভিত্তি অটোমানদের ইতিহাস। বাকিটুকু লেখকের কল্পনা। উপন্যাসের শুরুর দিকে যুবরাজ সুলেমানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন পাঠক। সুলেমানের বাবা সুলতান প্রথম সেলিমের সর্বশেষ বিজয়, অসুস্থতা ইত্যাদি পথপরিক্রমায় সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলেমান। এর মধ্যেই হেরেম সংস্কৃতি, প্রাসাদ, প্রশাসনসহ নানা দিক উঠে এসেছে।

সুলেমান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন সূর্যোদয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য। সে যাত্রায় পীরে মেহমুদ পাশাকে স্বপদে বহাল রেখে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সুলতান। সবার প্রত্যাশার বাইরে পারগালি ইব্রাহিমকে বানিয়েছেন নিজের খাসকামরা প্রধান।

 এর মধ্যেই সুলতানের জীবনে যৌনদাসী থেকে প্রিয়পাত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আলেকজান্দ্রা। হেরেমের অভ্যন্তরীণ নানা দিক ছাপিয়ে রোডস অভিমুখে অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন সুলেমান। গল্পের এই পর্যায়ে এসেও চলছে যুদ্ধ প্রস্তুতি। অনেক পাঠকই সব খণ্ড একত্রে পাওয়ার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। আগামী একুশে বইমেলায় পুরো উপন্যাসটি বাজারে আসবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতি শনিবারের এ বিশেষ আয়োজনে আজ ছাপা হলো ২৪তম পর্ব।

 

[ পূর্ব প্রকাশের পর ]

‘আমি আশা করব আমাদের সবার অনুপস্থিতিতে আপনি আপনার দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করবেন।’ কাশেম পাশাকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব মনে করিয়ে দিলেন সুলেমান।

‘ইনশাআল্লাহ সুলতান।’

‘ইব্রাহিম আপনাকে একটা বিশেষ কাজের কথা বলবে। আপনি সেটা খেয়াল রাখবেন। আমার নির্দেশ। সেটা ইব্রাহিমের কাছ থেকেই বুঝে নেবেন।’

‘জি সুলতান।’

‘এখন আসুন। সবার সঙ্গ উপভোগ করুন।’

‘জি।’ বলেই অন্যদিকে চলে গেলেন কাশেম পাশা। ইব্রাহিম তখনো সেখানে দাঁড়িয়ে। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। বুঝলেন সুলেমান।

‘তোমাকে বলে দিচ্ছি, তুমি কাশেম পাশাকে বুঝিয়ে দিও। আমরা কেউ এখানে থাকব না। আমাদের অনুপস্থিতিতে হুররেমের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। কাশেম পাশা নিজে যেন তার খোঁজ রাখেন। মাহিদেভরান যেন তার ক্ষতি তো দূরে থাক, কাছেও ঘেঁষতে না পারেন। হুররেম বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, এ বিষয়ে যেন অন্য কেউ নাক না গলায়। সে যেই হোক। হুররেম যেন শতভাগ নিরাপদে থাকে। আমি কী বলেছি পারগালি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ।’ চোখ ঘুরিয়ে ইব্রাহিমকে কী যেন বুঝালেন সুলেমান। সম্ভবত মাহিদেভরান আর বেগম সুলতানার বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। ইব্রাহিম কুর্নিশ করে সুলতানকে আশ্বস্ত করলেন। তখনই সেখানে এসে উপস্থিত মাহিদেভরান। স্বভাবতই সরে যেতে চাইলেন পারগালি। বাদ সাধলেন সুলতান।

‘কোথায় যাচ্ছ পারগালি?’ সুলতানের প্রশ্ন শুনে অবাক হলেন পারগালি। সুলতানের স্ত্রী সামনে এলে সেখান থেকে সরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন সুলতান উল্টো প্রশ্ন করছেন কেন?

মাহিদেভরান সুলতানের কানের কাছে গিয়ে বললেন- ‘জাহাপনা কি আমার ওপর রেগে আছেন। আমায় ক্ষমা করে দিন। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন হবে না।’

বিরক্ত হলেন সুলেমান। ভ্রু কুঁচকে বললেন- ‘ওদিকে যাও। দেখছ না পারগালির সঙ্গে জরুরি আলাপ করছি?’ বলেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন সুলতান। মাহিদেভরানের চোখ ছলছল করে উঠল। দূর থেকেই পুরো ঘটনা খেয়াল করলেন বেগম সুলতানা। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তার ছেলের কাছে মাহিদেভরানের আবেদন কমতে কমতে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কেবল বুঝতে পারছেন না মাহিদেভরান নিজে। নইলে একের পর এক ভুল কেন করবেন?

সুলেমানের এমন আচরণ পারগালি ইব্রাহিমকেও ভাবিয়ে তুলল। ঘটনা আসলে কোনদিকে গড়াচ্ছে।

যুদ্ধের আগের শেষ রাতেও সুলতানকে পাশে পাচ্ছে, এটা ভেবেই আনন্দ লাগছে হুররেমের। এখন প্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। কেবল সুস্থই নয়, রীতিমতো চাঙ্গা অনুভব করছে। ঘরে খাবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুই মুখে তুলছে না হুররেম। সুলতান না এলে সে নাকি খাবে না। দানা হালিল এসে বলে গেছেন সুলতানসহ সব সভাসদ খেয়ে ফেলেছেন প্রার্থনা অনুষ্ঠানে। হুররেম তবু অপেক্ষায় সুলতান আসবে। সুলতানের অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুম চলে এসেছে টের পায়নি হুররেম। ঘুম যখন ভাঙল ততক্ষণে সুলতান চলে এসেছেন।

‘হুররেম? খাওনি তুমি?’

‘ওহ! সুলতান! আপনি এসেছেন?’ হুররেমের আদুরে জিজ্ঞাসা।

‘হুম। তুমি খাওনি কেন?’ আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন সুলতান।

‘আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একসঙ্গে খাব।’

‘কিন্তু আমি তো খেয়ে ফেলেছি।’

‘তাতে কী? চলুন আবার খাই।’

‘নাহ!’ বলেই হেসে ফেললেন সুলেমান।

‘তুমি বরং দ্রুত খেয়ে নাও।’

‘আপনাদের প্রার্থনা সভায় আমাকে নিলেন না কেন?’ অন্য সময় হলে হুররেমের এই প্রশ্নে খুব রেগে যেতেন সুলেমান। আঙ্গুল তুলে তার অবস্থান বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু এখন কেন যেন খারাপ লাগছে না। শান্তভাবে হুররেমকে বুঝিয়ে দিলেন সুলেমান।

‘সবার সেখানে যেতে নেই। তা ছাড়া তুমি তো সুস্থ নও। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।’

‘জি সুলতান।’

পাশেই নিজের ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র গোছগাছ করতে লাগলেন সুলতান। হুররেম সাহায্য করতে চাইল। কিন্তু সুলতান না করলেন। এই কাজটা তিনি নিজে করতেই বেশি ভালোবাসেন। সব কাজে অন্যের ওপর নির্ভর হওয়াটা সুলতানের অপছন্দ।

পেটের ক্ষুধা মেটানোর পর বিছানায় শুয়ে মনের ক্ষুধায় ছটফট করছে হুররেম খাতুন। দুই চোখ জুড়ে খেলা করছে লক্ষ কোটি রঙিন স্বপ্ন। একদিন সত্যি সত্যি সুলতানের স্ত্রীর মর্যাদা পাবে সে। শাহজাদার মা হবে। তার কথায় উঠবোস করবে প্রাসাদের সবাই! ভাবতেই সারা শরীরে উত্তেজনার কেমন যেন একটা ঢেউ খেলে যায়। সুলতান চলে এসেছেন বিছানায়। হুররেমের ভাবনা থামে। সব নিমগ্নতা সুলতানের বাদামি চোখের দিকে। হুররেম নয়, বরং সুলেমানকেই বেশি ক্ষুধার্ত মনে হলো। মাহিদেভরানের প্রতি বিতৃষ্ণা, নাকি হুররেমের প্রতি অতিপ্রেম? নাকি দীর্ঘদিনের যুদ্ধযাত্রার আগে শেষবারের মতো পূর্ণ আনন্দ লাভের চেষ্টা কে জানে। কিন্তু সুলতানকে একটু বেশিই উত্তেজিত মনে হচ্ছে। সুলতানের হাত আর ঠোঁটের ছোট ছোট অভিযানগুলো হুররেম খাতুনকে জাগিয়ে তুলছে। খিলখিলিয়ে হাসছে আবার হিসহিসিয়ে ফুঁসছে। সুলতানের মুখে কোনো কথা নেই। তবু রাজ্যের ব্যস্ততা। রাত পোহালেই যুদ্ধের ঝনঝনানি। এখন তাহলে  কেবল গোলাপের সুবাসেই মন ভরুক। ক্ষতি কী?

মাতরাকচি শেষ মুহূর্তে তার লেখার কাজ শুরু করেছেন। তিনি ঠিক জানেন পনেরশ একুশ সালের মে মাসের আঠারো তারিখ একদিন ঠিক ইতিহাস হবে। সুলতান সুলেমান খানের প্রথম বড় অভিযান। সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। দুপুরের খাবার সেরেই যে যার মতো তৈরি হতে শুরু করেছে। সুলেমান পরিবার পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছেন। বাবা সুলতান সেলিম খানের কবর জিয়ারত করেছেন। যুদ্ধযাত্রার ঠিক আগ মুহূর্তে সব সৈন্য আর জেনেসারিসদের উদ্দেশে দুর্দান্ত একটা বক্তব্য রাখলেন সুলেমান। চামড়ায় আঁকা মানচিত্রটাকে পদদলিত করলেন। তলোয়ারের আঘাতে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখিয়ে দিলেন ঠিক কোথায় কোথায় ছড়িয়ে দিতে হবে অটোমানদের বিজয়চিহ্ন। সবাই সমস্বরে জয়ধ্বনি করল। সর্বশেষ গোয়েন্দা তথ্য হাতে চলে এসেছে। রওনা করা যায় এখন। প্রাসাদের সামনে টিউলিপ বাগানে পদস্থ কর্মকর্তা ও নেতৃত্বস্থানীয় সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে আসরের নামাজ আদায় করলেন সুলতান। যুদ্ধের আগে বিশেষ মোনাজাতের পর তোপধ্বনির মাধ্যমে শুরু হলো যাত্রা। সুলতানের এক পাশে পারগালি ইব্রাহিম ও আরেক পাশে মাতরাকচি নাসু। তাদের আগে-পিছে সুলতানের দেহরক্ষী ও আরও এক দেড়শ সৈনিক। পেছনে পুরো বাহিনী। ততক্ষণে নৌবাহিনীরও যাত্রা শুরু করে দেওয়ার কথা। অল্পক্ষণের মধ্যেই সারা রাস্তায় ধুলো ছড়িয়ে কনস্টান্টিনোপলের সীমা ছাড়িয়ে গেল সুলতান বাহিনী। রাজধানী অতিক্রমের সময় সাধারণ মানুষ চারদিক থেকে তুমুল উৎসাহ আর জয়ধ্বনি দিল। সুলতান জানেন, এটাই তাদের সাফল্যের মূল অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে।

চলবে... পরবর্তী পর্ব আগামী শনিবার

সর্বশেষ খবর