বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

একজন প্যাট্রিসিয়া যেভাবে বাংলাদেশি

একজন প্যাট্রিসিয়া যেভাবে বাংলাদেশি

ব্রিটিশ নাগরিক প্যাট্রিসিয়া কার গাজীপুরের শ্রীপুরে গড়ে তুলেছেন ‘শিশুপল্লী প্লাস’। অসহায়, নির্যাতিত, দরিদ্র মা ও সন্তানকে এখানে আশ্রয় দেন, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ দেন। স্বাবলম্বী করে তাদের পুনর্বাসন করেন, দেন নতুন জীবনের আলো। ২৯ বছর ধরে বাংলার মায়েদের তিনি এভাবেই মাতৃস্নেহ দিয়ে চলেছেন। অনবদ্য এই অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার তাকে দিয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। শ্রীপুরের শিশুপল্লী প্লাসে মিডিয়াবিমুখ, হাস্যোজ্জ্বল প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন— তানভীর আহমেদ, শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ ও তানিয়া তুষ্টি। ছবি তুলেছেন রিয়াজ খান

 

বাংলাদেশ প্রতিদিনকে শিশুপল্লী প্লাসের প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিসিয়া কার

আমি শুধু চেয়েছি দুস্থ, অসহায়, নির্যাতিত মায়েরা যেন তার সন্তানকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচে

শিশুপল্লী প্লাস বাংলাদেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি মায়ের সঙ্গে শিশুকে আশ্রয় দেয়। তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা, পুষ্টি, প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে। গত ৩০ বছর ধরেই দুস্থ অসহায় শারীরিক অথবা মানসিকভাবে নির্যাতিত মায়েদের সন্তানসহ পুনর্বাসনের কাজ করছি আমরা। এই দীর্ঘ সময়ের যাত্রা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রতিদিনই আমাদের নতুন ধরনের সমস্যা ও সংকটের সমাধান খুঁজতে হয়। আমাদের সার্ভে বলছে, উত্তরবঙ্গ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেসব মা আমাদের এখানে আশ্রয় নেয় তাদের বেশিরভাগই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার। দরিদ্রতা ও সামাজিক দুরবস্থায় তাদের টিকে থাকাই যখন কঠিন হয়ে পড়ে তখন পাশে এসে দাঁড়ায় শিশুপল্লী প্লাস। তারা যখন এখানে আসে, আমরা শুরুতেই তাকে আস্বস্ত করি, আপনি এখানে নিরাপদ। শিশুপল্লী প্লাসে পরদিন তাদের যখন ঘুম ভাঙে তারা প্রথম এটা টের পায়, তারা এখানে নিরাপদ। তাদের জন্য খাবার আছে। তাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কীভাবে এই মায়েদের সন্তানসহ পুনর্বাসিত করা যায় সেটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আমরা নানাভাবে এই মায়েদের সাহায্য করি। শুরুতেই নির্যাতিত মায়েদের আমরা কাউন্সেলিং করি। তাদের আস্থা অর্জনের পর নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার এই প্রয়াসে আমরা অবিচল। কী করে তাদের আরও উন্নত সেবা প্রদান করা যায় সেটাই আমাদের চ্যালেঞ্জ। এখানে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকার জো নেই। মায়েদের পুনর্বাসনের জন্য তাদের স্বাবলম্বী করার গুরুত্ব অনেক। এখানে কৃষিকাজ, হাতের কাজ, ব্যবসা পরিচালনাসহ নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তারা তাদের গ্রামে বা নিজের ঠিকানায় ফিরে গিয়ে যে কাজ করতে চান আমরা সেটাই তাদের প্রশিক্ষণ দেই। এসব প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারেও আমরা তাদের সচেতন করি। তাদের সন্তানদের জন্যও সুশিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়। কীভাবে তাদের সন্তানকে লালনপালন করতে হবে, তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে, আমরা সেই প্রশিক্ষণও তাদের দেই। তাদের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষক আছে, চিকিৎসক আছে, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট আছে। শিশুপল্লী প্লাস মায়েদের শুধু প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায় তা নয়। আমাদের প্রতিদিনই একটি পরিবার হিসেবে এখানে আশ্রয় নেওয়া মা ও সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশিক্ষণের দেখভাল করতে হয়। সব কিছু এত বড় পরিসরে ঠিকভাবে পরিচালনা সত্যি ভীষণ কঠিন কাজ। এখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ শেষে তাদের ‘হাফওয়ে হোম’-এ পাঠানো হয়। বাইরের পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ তাকেও নিতে হবে। সেই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেই ‘হাফওয়ে হোম’। যখন আমরা মনে করি এসব মা তাদের সন্তানসহ অর্থনৈতকভাবে স্বাবলম্বী জীবন পরিচালনায় সক্ষম তখন তাদের পুনর্বাসন করা হয়। আমি এই কাজটিই ২০ বছরের বেশি সময় ধরে করে আসছি। এই কাজটিই আরও ভালো করে করতে চাচ্ছি। এই দীর্ঘ সময় পাড়ি দেওয়ার পরও আমি মনে করি, এখনো অসহায়, নির্যাতিত মায়েদের পুনর্বাসনের জন্য আমাদের অনেক কিছুই করার আছে। অসহায় এই মায়েদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যই আমাদের এই প্রচেষ্টা। সত্যিকার অর্থেই এটি অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। আমি বলব না, আমি সব কিছু ঠিকঠাকভাবে করতে পারছি। কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি দেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট দেখা দিয়েছে। এই শরণার্থী শিবিরের মায়েদের দিকে আমরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা শিশু খাদ্য জোগাড় করতে গিয়ে সাময়িকভাবে হিমশিম খেয়েছি। এ ধরনের নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ থেমে নেই। এখন আমাদের টাকার দরকার। মায়েদের সন্তানসহ পুনর্বাসনে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ব্যয় জোগাড় করা আমাদের জন্য কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠেছে। নানা প্রতিবন্ধকতা, চ্যালেঞ্জ এলেও অনেক কিছুই পেয়েছি। ব্যক্তিজীবনের প্রাপ্তির সঙ্গে মায়েদের সন্তানসহ পুনর্বাসনের আনন্দ, সন্তুষ্টির তুলনা করব না। বাংলাদেশে ৩০ বছর কেটেছে আমার। এই শিশুপল্লী প্লাসের প্রতিটি ইটের সঙ্গে আমার জীবন, স্মৃতি, ভাবনা মিশে রয়েছে। বাংলাদেশও আমাকে নাগরিকত্বের সম্মান দিয়েছে। কিছু দিন আগে আমি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছি। আমার হাতে এসেছে বাংলাদেশের ‘এনআইডি’ কার্ড। আশা করছি কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্টও পেয়ে যাব। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে আমি গর্বিত, আনন্দিত। স্থানীয় প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সবার কাছ থেকেই আমি যে ভালোবাসা, সম্মান, সহযোগিতা পেয়েছি তা অনবদ্য। সবশেষে আমার এই পথচলায় আমার টিমের কথা না বললেই নয়। তারা সব সময় আমার সঙ্গে রয়েছে বলেই শিশুপল্লী প্লাস মায়েদের সন্তানসহ নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে চলেছে। এই অবিরাম যাত্রায় সবার সহযোগিতাই আমার কাম্য।

 

মা ও সন্তানকে আশ্রয়, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনর্বাসিত করেন প্যাট্রিসিয়া

গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের টেংরা এলাকায় ৫১ বিঘা জমির ওপর সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে অসহায় শিশু ও মায়ের পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘শিশুপল্লী প্লাস’। ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এই শিশুপল্লী প্লাস উদ্বোধন করেন। সম্পূর্ণ বিনা খরচে সমাজের অবহেলিত সুবিধা বঞ্চিত শিশু ও তাদের মায়ের আশ্রয় হয় এখানে। সবুজে ঘেরা এই আশ্রয় কেন্দ্রের আশ্রিত মা ও শিশুরা খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও আবাসের নিশ্চয়তা পেয়ে থাকে। শিশুপল্লীতে বর্তমানে ৩১১ জন শিশু ও ১৫০ জন মা রয়েছেন। এদের মধ্যে ১৫৪ জন মেয়ে ও ১৫৭ জন ছেলে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৫২ জন শিশু এবং ৯০০ মাকে আশ্রয় দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আর এসব শিশু ও মাকে দেখাশোনার জন্য ১৩৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে শিশুপল্লীতে।

৫১ বিঘার এই শিশুপল্লী প্লাসের চারপাশ সবুজে ঘেরা শত শত বৃক্ষাদি দিয়ে আচ্ছাদিত। কমপক্ষে ৪০ জাতের ফল ও ৫০ জাতের ফুল গাছ আছে এর মাঝে। এই কেন্দ্রের সীমানার ভিতরে শিশু ও তাদের মায়ের থাকার জন্য বয়স অনুযায়ী আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। এক তলার ৬টি আবাসন ভবন রয়েছে। প্রতি কক্ষে দুপাশ সারি সারি কক্ষে থাকেন আশ্রিত এসব শিশু ও মা। এখানে একটি প্রাথমকি ও প্রি-প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বিদ্যালয়টি সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত শিশু ও মাকে বিভিন্ন নিয়ম শৃঙ্খলারও শিক্ষা দেওয়া হয়। এখানে রুটিন অনুযায়ী খাবার প্রদান করা হয়। চিকিৎসার জন্য রয়েছে একটি ক্লিনিক। সেখানে একজন মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট, দুজন প্যারামেডিকেল চিকিৎসক, দুজন সেবিকা রয়েছেন। জরুরি প্রয়োজনে নিজেদের গাড়ি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা জেলা সদরে নেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। বিনোদনের জন্য রয়েছে টিভিরুম, কমনরুম এবং পত্রপত্রিকা ও বই-পুস্তক পড়ার সুবিধাও। আশ্রিত শিশু ও মায়েদের বিভিন্ন প্রয়োজনে ১৪৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন। শিশুপল্লী প্লাস কেন্দ্রের মূল ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাতের বামে পড়বে খেলার মাঠ। তাদের রয়েছে মেয়েদের একটি ক্রিকেট দলও। এখানে আশ্রিত অনেক শিশুই বর্তমানে সমাজে বিভিন্ন কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। যেসব শিশুর মা ও বাবা কেউ নেই এখানে তাদের বড় করে নিজস্ব খরচে বিয়ের ব্যবস্থাও করা হয়। শিশুপল্লীতে নিজস্বভাবে কাগজ তৈরি করা হয়। কাগজগুলো বেশিরভাগই বোর্ড। যা দিয়ে ভিজিটিং কার্ড, দাওয়াত কার্ড, ঈদ কার্ড বানিয়ে বাজারে বিক্রিও করা হয়। এখানে একটি প্রিন্টিং প্রেসও রয়েছে। আর ওই কাগজ তৈরির কাজে আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরে থেকে ৫০ জন নারী এসে কাজ করছেন। শিশুপল্লীর ভিতরে মায়েদের প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে গার্মেন্ট, টেইলারিং, বিউটি পার্লার, হ্যান্ডমেড পেপার, মোমবাতি, গামছা ও মুড়ি, মোয়া বানানোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হাউসকিপিংসহ নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। শিশুদের জন্য রয়েছে নাচ, গান, আর্ট শিক্ষারও ব্যবস্থা। রয়েছে একটি সুইমিং পুল। যা দিয়ে শিশুদের সাঁতার শেখানোর কাজে ব্যবহার হয়। একটি গরুর খামার, সবজি খামার ও মাছ চাষের ব্যবস্থা রয়েছে। ছেলেমেয়েদের মক্তবের শিক্ষা দেওয়া হয় ভিতরে থাকা মসজিদ থেকে। অন্য ধর্মের প্রার্থনালয় না থাকলেও পালিত হয় প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলো। আশ্রয়কেন্দ্রে শ্রীপুর ভিলেজ ট্রেড নামের একটি কক্ষ রয়েছে। একটি প্রশাসনিক ভবন, মিনি শিশু পার্ক, বেবি হাউস ও মাঝখানে একটি ওয়াটার টাওয়ারও রয়েছে। খেলার জন্য টেবিল টেনিস ও বাস্কেট বল খেলার মাঠও আছে। সকালের নাস্তার পর ১০টায় টিফিন, দুপুরে খাবার, ৫টায় আবার টিফিন ও রাতে রয়েছে রাতের খাবারের ব্যবস্থা। এখানে আশ্রিত শিশুদের ২৫ ডিসেম্বর জন্মদিন পালন করা হয়। বিধবা, তালাক প্রাপ্তা, স্বামী পরিত্যক্তা বা স্বামী নিরুদ্দেশ, স্বামী গুরুতর প্রতিবন্ধী, অবিবাহিত বা নির্যাতনের ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের মা ভর্তির যোগ্যতা রাখে। সন্তানের সংখ্যার ক্ষেত্রে নেই কোনো বাধা নিষেধ। পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে এবং নিয়মিত ধর্মীয় ইবাদত পালন করতে হবে। ধূমপান, জর্দা, পান, গুল, চা ইত্যাদি পান করা যাবে না।

শিশুপল্লী প্লাস নামক সেবামূলক সংস্থাটি বাংলাদেশের ৬৪ জেলার দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত দুস্থ মা ও শিশুদের উন্নয়নে কাজ করে আসছে। সংস্থাটি মা ও শিশুদের সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ বছর প্রাতিষ্ঠানিক সেবা প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং সমাজে পুনর্বাসিত হতে সহায়তা করে থাকে। এখানে রয়েছে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা। প্রয়োজনীয় পোশাক ও স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানও রয়েছে। সাধারণত এখানে সুবিধাভোগী মা ও শিশুরাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই সংস্থার প্রচারে কাজ করেন। তবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বেসরকারি এনজিওর বিভিন্ন সেমিনারেও সংস্থাটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশ নাগরিক প্যাট্রিসিয়া কার। তিনি ১৯৮৯ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুর দিকে কয়েকজন শিশু ও মাকে নিয়ে যাত্রা করেন। শিশুপল্লী প্লাসের চেয়ারম্যান সৈয়দ শামসুল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিসিয়া কার দীর্ঘ সময় অবিবাহিত জীবন কাটানোর পর ১৯৯৮ সালে ব্রিটিশ নাগরিক ডেরেক পারমার নামের একজনকে বিয়ে করেন। শিশুপল্লী প্লাসের চেয়ারম্যান সৈয়দ শামসুল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি প্রতিষ্ঠা থেকেই এখানে আছি। দীর্ঘ সময়ে অনেক শিশু ও তাদের মাকে এখানে আশ্রয় দিয়ে আত্মোন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের আলাদা ধর্মীয় উৎসব পালনের ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে ময়মনসিংহ রোডের মাওনা চৌরাস্তার পরেই এমসি বাজার। সেখান থেকে সোজা পূর্বদিকে ৪ কিলোমিটার গেলেই পাওয়া যাবে শিশুপল্লী প্লাস। টঙ্গীতে তাদের আরও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

 

একনজরে শিশুপল্লী প্লাসের কার্যক্রম

থাকার পদ্ধতি

 ► কেন্দ্রে প্রবেশের শুরুতে মায়েদের মানসিক অবস্থা থাকে বিপর্যস্ত। তাই প্রথমে তাদের কাউন্সেলিং করানো হয়। সঙ্গে খুব ছোট বাচ্চা থাকলে সে মাকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয় না। ছয় মাস বয়স থেকে স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাচ্চাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকেন নতুন মায়েরা। অন্য মা যান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ৩ বছর মায়েদের এখানে রেখে বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ করে তোলা হয়। আর্থিক সহায়তা দিয়ে প্রত্যেকের নিজ এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়। মায়েদের সঙ্গে ১১ বছরের নিচে ছেলেমেয়ে থাকতে পারে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ১৬-১৭ বছরের মেয়েদের রাখা হয়। ছেলে হলে রাখা হয় বাইরে। তাদের পড়াশোনা, খাবার, পোশাক সবকিছুর দায়িত্ব থাকে শিশুপল্লী প্লাসের। একইসঙ্গে ছেলেদের টেকনিক্যাল কাজেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

 

লিডার মা

 ► কেন্দ্রে আশ্রিত সবার দেখভালের জন্য লাল পাড়ের সবুজ শাড়ি পরা ১৪ জন মা আছেন। তারা ছয় মাসের জন্য এই পদে থাকেন। ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করলে দ্বিতীয় মেয়াদে লিডার হন। লিডার মায়েরা সমাধান না করতে পারলে  ডিসিপ্লিনারি কমিটি সমাধান করে।

 

আর্থিক সক্ষমতা

 ► আশ্রিত মায়েরা প্রতিমাসে ১৮০০ টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন। ১১০০ টাকা তাদের ইন্স্যুরেন্সে জমা হয়। বাকি ৭০০ টাকা নিজের বিভিন্ন খরচের জন্য দেওয়া হয়। আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার সময় জমানো ওই টাকা দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও মায়েরাও সদাচারণের জন্য টোকেন পেয়ে থাকেন। সেগুলো দিয়ে নিজেদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে থাকেন।

 

হাফওয়ে হাউস

► একটানা প্রায় তিন বছর আশ্রয় কেন্দ্রে থেকে মায়েদের রান্নাবান্না ও বাজার করার অভ্যাস চলে যায়। বাইরের পরিবেশের সঙ্গেও যোগাযোগ কমে আসে। তাই এই কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার তিন মাস আগে তাদের হাফওয়ে হাউসে রাখা হয়। সেখানে রান্নাবান্না, কেনাকাটা নিজেরাই করেন। তখন হঠাৎ করে কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার পর বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মিশতে সমস্যা হয় না।

 

খামার

► এখানে শাক-সবজি, পুকুর ও গরুর খামার রয়েছে। প্রয়োজনীয় সবজির ৪০ শতাংশ, মাছ ও বাচ্চার জন্য দুধ খামার থেকেই আসে। সবজি চাষে ব্যবহার হয় নিজেদের তৈরি কম্পোস্ট সার।

 

সদাচারের শিক্ষা

► বাচ্চাদের ঠিকভাবে তিনবেলা খাওয়া, হাত ধোয়া, যথাস্থানে ময়লা ফেলা, পরিচ্ছন্নতা ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা মানা, নিয়মিত অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়ানোর ওপর পাঁচটি টোকেন দেওয়া হয়। কেউ নিয়মের বাইরে গেলে টোকেন কাটা হয়। জমানো টোকেন দিয়ে তারা কেন্দ্রে নিজস্ব দোকান থেকে পছন্দের খেলনা কিনতে পারে। এতে করে তারা অজান্তেই একটি নিয়মের চর্চায় চলে আসে। গড়ে ওঠে সদাচারের শিক্ষা। 

 

আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলার কারণ

ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজের একজন ক্রু হিসেবে চাকরি করতেন শিশুপল্লী প্লাসের প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটিশ নাগরিক প্যাট্রিসিয়া কার। চাকরির সুবাদে একদিন ফ্লাইট বিরতির সময় বাংলাদেশের ঢাকায় অবস্থান নেন। সেসময় তিনি ঢাকার ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে অবস্থিত ফ্যামিলি ফর চিলড্রেন নামের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে যান। সেখানে বসে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটি হূদয় বিদারক দৃশ্য দেখতে পান। দেখেন এক মা তার শিশু সন্তানটিকে ওই কেন্দ্রে ভর্তি করে রেখে নিজের কাজে যাচ্ছেন। আর ওই সময় শিশুটির মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিশু সন্তানটিকে যেন ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তখন ওই শিশু সন্তান ও মায়ের কান্না দেখে ব্রিটিশ এই নাগরিক খুব কষ্ট পান। মনে মনে উদ্বুদ্ধ হন একটি শিশু আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলার। দেশে ফিরে নিজের বান্ধবীদের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করেন। তারপর ১৯৮১ সালের দিকে বাংলাদেশে এসে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর শ্রীপুরের তেলিহাটির টেংরা এলাকায় শিশুপল্লী প্লাস গড়ে তোলেন।

 

বাংলাদেশি প্যাট্রিসিয়া

ব্রিটিশ নাগরিক প্যাট্রিসিয়া ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের অসহায় নির্যাতিত মা ও সন্তানকে আশ্রয়, প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনর্বাসনের কাজ করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন সমাজসেবায় অনন্য ভূমিকা রেখে চলা এই মানুষটি। বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের শীর্ষ গণমাধ্যমগুলোয় তার কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। অনুপ্রেরণীয় ব্যক্তিত্ব আখ্যা দিয়েছে তারা। বাংলাদেশে তিন দশকে প্যাট্রিসিয়া অসংখ্য নারীকে তাদের সন্তানসহ পুনর্বাসন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত প্যাট্রিসিয়া বাংলাদেশের মানুষ ও সংস্কৃতিকেই আপন করে নিয়েছেন। শ্রীপুরের শিশুপল্লী প্লাসেই তিনি নিজ হাতে খাবার তৈরি করেন। এখানে তার সময় কাটে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে এবং সবসময়ের সঙ্গী ‘এভরি’ নামের সুদর্শন এক কুকুরের সঙ্গে। উন্নত দেশে, সুখকর জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের অসহায় মা, সন্তানদের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করে প্যাট্রিসিয়া কার সত্যিই অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

 

এবার পথশিশুদের আশ্রয়

শিশুপল্লী প্লাস শুধু নিজ কেন্দ্রে সব ধরনের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে না। কেন্দ্রের বাইরে ঢাকার পথশিশুদের জন্য নিয়েছে অভিনব এক উদ্যোগ। তাদের জন্য নিকুঞ্জ এলাকায় নিজস্ব জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন কয়েক হাজার পথশিশু দেখা যায়। যাদের থাকা খাওয়া সবই রাস্তায়। এসব শিশু দিনের বেলা এই কেন্দ্রে গিয়ে গোসল ও ঘুমানোর সুযোগ পাবে। মেয়েরা রাতেও থাকতে পারবে। পথশিশুদের পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যজনিত বিষয়কে সামনে রেখে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মেয়ে শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ের দুর্যোগ কবলিতদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। রানা প্লাজা ধ্বংস, এবারের বন্যা এমনকি রোহিঙ্গা সংকটেও তারা ত্রাণ বিতরণ করেছে।

 

সর্বশেষ খবর