শনিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাইবর্গ : আধা যন্ত্র আধা মানব

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বদৌলতে সাইবর্গ সম্পর্কে অনেকেরই এখন জানা। এমনই কিছু সাইবর্গ যেমন রোবোকপ কিংবা টার্মিনেটর ইত্যাদি কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার ফলে সাইবর্গরা এখন আর শুধু কল্পনার চরিত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সাইবর্গ রয়েছে এখন বাস্তবেও—

সাইফ ইমন

সাইবর্গ : আধা যন্ত্র আধা মানব

কেভিন ওয়ারউইক (নিজেই যখন সাইবর্গ কারিগর)

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত সাইবর্গ হয়েছেন সবাই কোনো না কোনো সীমাবদ্ধতা দূর করতেই সাইবর্গের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু কেভিন ওয়ারউইক ব্যতিক্রম। ‘ক্যাপ্টেন সাইবর্গ’ নামে সুপরিচিত কেভিন ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের একজন প্রফেসর। বিশ্বের সবচেয়ে সম্পূর্ণ সাইবর্গ হওয়ার প্রচেষ্টায় যিনি নিজেই হয়েছেন নিজের পরীক্ষাগারের গিনিপিগ। কেভিন ওয়ারউইক তৈরি করেছেন শরীরে স্থাপনযোগ্য মাইক্রোচিপ, যা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন অনেক কিছু। এটা তিনি নিজের ওপরেই প্রয়োগ করেছেন। ১৯৯৮ সাল থেকেই তিনি নিজের শরীরে নানারকম মাইক্রোচিপ বসিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়ে আসছেন। তিনি তার বাহুতে লাগিয়েছেন এমন এক মাইক্রোচিপ যার সাহায্যে তিনি ঘরের লাইট, ফ্যান, টিভিসহ নানারকম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এমনকি মাইক্রোচিপের সাহায্যে তার নিজের শরীরকে যুক্ত করতে পারেন ইন্টারনেটের সঙ্গে।

 

 

নিল হারবিসন

(বিশ্বের প্রথম স্বীকৃত সাইবর্গ)

নিল হারবিসন বিশ্বের প্রথম আইন স্বীকৃত সাইবর্গ। তবে তিনি যান্ত্রিক রোবট নন। ৩২ বছর বয়সী হারবিসন জন্ম থেকেই বর্ণান্ধ। পৃথিবীর কোনো রং-ই দেখতে পেতেন না তিনি। কিন্তু প্রযুক্তি তাকে মুক্তি দিয়েছে শারীরিক সীমাবদ্ধতা থেকে। তার খুলির মধ্যে অপারেশন করে বসানো হয়েছে অ্যান্টেনা। যেটির তরঙ্গের মাধ্যমে তার কানে পৌঁছে যায় কোন জিনিসটির কি রং। ২০০৪ সালে ডাটিংটন কলেজ অব আর্টসে মিউজিকের ওপর পড়ালেখা করছিলেন তিনি। এ সময় তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যাডাম মন্টানডন। হারবিসনের জন্য মন্টানডন পাঁচ কিলোগ্রামের এক কম্পিউটার সংযুক্ত অ্যান্টেনা বানিয়ে দেন। ওই কম্পিউটার সংযুক্ত অ্যান্টেনা ৩৬০টি ভিন্ন শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের অনুবাদ করত, আর হেডফোনের মাধ্যমে ওই শব্দতরঙ্গ শুনে কোনটির কি রং তা বোঝার চেষ্টা করতেন হারবিসন। মন্টানডন ও হারবিসন ওই যন্ত্রটির নাম দিয়েছিলেন ‘আইবর্গ’। বিষয়টি এমন নয় যে, আইবর্গের কল্যাণে রংয়ের পৃথিবীতে খুব সহজেই যাত্রা শুরু করতে পেরেছিলেন হারবিসন। এর সঙ্গে সহ্য করতে হয়েছে হারবিসনকে। এরপর প্রায় পাঁচ মাস ধরে কোন শব্দতরঙ্গ কোন রংয়ের ব্যাপারে বলছে তা বুঝার চেষ্টা করেছেন তিনি। এরপর তার চোখে ধরা দিতে থাকে বর্ণিল পৃথিবী।                       

 

ক্লডিয়া মিশেল

(প্রথম মহিলা সাইবর্গ)

দুর্ঘটনায় অনেক সময় অনেকের অঙ্গহানি ঘটে। কিন্তু প্রযুক্তি আমাদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখন আমরা অনেকাংশেই শারীরিক সীমাবদ্ধতা জয় করতে পারছি। এমনই একজন বিশ্বের প্রথম মহিলা সাইবর্গ ক্লডিয়া মিশেল। মেরিন কর্পে কর্মরত মিশেল একদিন এক মোটরবাইক দুর্ঘটনায় একটি হাত হারিয়ে ফেলেন। এরপর তার শরীরে স্থাপন করা হয় এক বায়োনিক হাত যা তার শরীরের নার্ভাস সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত। এই রোবটিক হাতের সাহায্যে মিশেল এখন প্রায় সব ধরনের স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন। তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে ইতিহাসের প্রথম রোবটিক হাতের সাহায্যে রান্নাবান্না, কাপড় ভাঁজ করা কিংবা পানির বালতি বহন করাসহ প্রায় সব গৃহস্থালির কাজ করতে পারেন। তিনি তার হাতটি চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। যেটা দেখে মনে হয় এটা স্বাভাবিক মানুষের হাতের মতোই কর্মক্ষম।

 

 

জেসি সুলিভান

(প্রথম বায়োনিক হাতযুক্ত সাইবর্গ)

জেসি সুলিভান নামের এক ইলেকট্রিক্যাল লাইন্সম্যান ২০০১ সালের মে মাসে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন। এই দুর্ঘটনায় তিনি তার দুটি হাতই হারান। এর ফলে তার জীবন হয়ে পড়েছিল অর্থহীন। একসময় ডাক্তাররা তাকে প্রচলিত রাবারের হাত লাগানোর পরামর্শ দেন। এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও তখন ছিল না। ঠিক সে সময়ই শিকাগোর পুনর্বাসন কেন্দ্র তাকে বায়োনিক বা রোবটিক হাত লাগানোর প্রস্তাব দেয়। পাল্টে যায় সুলিভানের গল্প। স্বাভাবিকভাবেই শিকাগোর পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে যান সুলিভান। হয়ে উঠেন বিশ্বের প্রথম বায়োনিক হাতযুক্ত সাইবর্গ। কৃত্রিম হাত দুটি তার শরীরের নার্ভাস সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। তিনি স্বাভাবিক হাতের মতোই রোবটিক হাত দুটিকে মস্তিষ্কের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তার বিশেষত্ব কোনো জিনিস মুঠো করে ধরলে কত জোরে চাপ দিয়ে ধরছেন সেটাও বুঝতে পারেন।

 

স্টেলিউস আর্কাডিও

(তৃতীয় কানের সাইবর্গ)

স্টেলিউস আর্কাডিও বা স্টেলার্ক নামেই যিনি বেশি পরিচিত এই সাইবর্গ। পেশায় তিনি একজন পারফর্মেন্স আর্টিস্ট নিজের বাহুতে স্থাপন করেছেন তৃতীয় একটি কান। হ্যাঁ, বিষয়টি খুব উদ্ভট মনে হলেও সত্য। ১৯৯৬ সালে তিনি এই কান লাগানোর পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু তখন প্রযুক্তি সহায় ছিল না। অনেক পরে ২০০৭ সালে একটি অপারেশনের মাধ্যমে তিনি তার চামড়ার নিচে একটি কৃত্রিম কান স্থাপন করতে সক্ষম হন। এটি এখন তার শরীরেরই একটি অংশ। স্টেলার্কের পরিকল্পনা ছিল বিশাল। উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর সবাই যেন সবসময় তাকে শুনতে পায়! এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে কানটির মধ্যে ছোট্ট একটি মাইক্রোফোন বসানো হয়েছে। যাতে করে এটি ওয়াইফাই হটস্পটের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে ২৪ ঘণ্টা। এই কানের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কেউ তাকে ২৪ ঘন্টা শুনতে পারবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। স্টেলার্ক বলেন, ‘এই কানটি আমার জন্য নয়। শোনার জন্য আমার আগে থেকেই দুটি কান রয়েছে। এই তৃতীয় কানটি হলো একটি রিমোট লিসেনিং ডিভাইস। যেটি দিয়ে বিভিন্ন জায়গার মানুষ আমাকে শুনতে পাবে।’ স্টেলার্ক আরও বলেন, ‘শরীর আর যন্ত্রের সমন্বয়ের যে ভীতি আমাদের মধ্যে রয়েছে তা মন থেকে দূর করা উচিত। কারণ, টেকনোলজি আমাদের শরীরেরই একটা অংশ। এগিয়ে যাচ্ছে দিন, এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রযুক্তি।’

সর্বশেষ খবর