শনিবার, ২ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

বুড়ো ব্রিজের গল্প

তানভীর আহমেদ

বুড়ো ব্রিজের গল্প

চলতে চলতে পথচারী থেমেছে দুর্গম পাহাড় কিংবা মরু প্রান্তরে। তাই বলে শহর গড়া থেমে থাকেনি। রেলগাড়ি ছুটিয়ে নিতে রেলসেতু দিয়েই আধুনিক যুগের ব্রিজ বা সেতুগুলোর উন্নয়ন। হাজার হাজার বছর আগে নদী পেরোতে কাঠের ও পাথরের সেতু গড়েছে প্রকৌশলীরা। রোমান সাম্রাজ্যে গড়ে ওঠা সেতুগুলো এখনো মানুষকে চমকে দেয়। শুধু নির্মাণশৈলী নয়, টেকসই এই সেতুগুলো গুরুত্বের দিক থেকেও সভ্যতার গল্পে জায়গা করে নিয়েছে। গেল ৩০০ বছরে বহু সেতু তৈরি হয়েছে যেগুলো এখনো মানুষ —প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছে। বিশ্বজুড়ে বুড়ো সেতুর সংখ্যা অনেক। গোটা শহরের চিত্র বদলে দেওয়া, নতুন শহরের জন্ম দেওয়া— সবই হয়েছে এই সেতুগুলো দিয়ে। তেমনই কয়েকটি সেতুর গল্প এখানে—

 

ব্রুকলিন ব্রিজ

নিউইয়র্ক সিটির ল্যান্ডমার্ক ব্রুকলিন ব্রিজ। ম্যানহাটনের সঙ্গে নিউইয়র্ক সিটির যোগ করে দিয়েছে ব্রিজটি। ৬টি লেনে চলে গাড়ি। এলিভেটেড ট্রেন চলার সুযোগও রয়েছে। পথচারী ও বাইসাইকেল যাত্রীদের চলার জন্য আলাদা লেন রয়েছে। ১৮৮৩ সালের পর থেকে এখনো সমান গুরুত্ব নিয়ে ব্রিজটি ব্যবহার করছে সাধারণ জনগণ। রাতের শহর নিউইয়র্ক কখনো ঘুমায় না। যুক্তরাষ্ট্রের বুকের মধ্যখানে থাকা নিউইয়র্কের পূর্ব পাশের নদীর ওপর ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। টাওয়ার দিয়ে টানা দেওয়া স্টিল ব্রিজটির ক্যাবল বা তার টানা সেতুর নকশা যে কাউকে চমকে দেবে। বহু আগেই শত বছর পেরিয়ে যাওয়া ব্রিজটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন ১ লাখ ৫০ হাজার গাড়ি ও পথচারী পারাপার হয়। ব্রিজটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৪ বছর। এক যুগেরও বেশি সময়ের এই নির্মাণযজ্ঞ বিশ্বকে দেখিয়েছে প্রকৌশলবিদ্যার অন্যতম সফল ডিজাইন। ১৪ বছরের এই নির্মাণযজ্ঞে হাত লেগেছিল মাত্র ৬০০ শ্রমিকের। সে সময়ই ব্রিজটি তৈরিতে খরচ হয় ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৩৫ বছর পুরনো ব্রিজটির নকশা করেছিলেন জন অগাস্টাস। সাসপেনশন ও ক্যাবল-স্টে নকশার যৌথ মিলনে ব্রিজটি গড়া হয়। ৫ হাজার ৯৮৯ ফুট দীর্ঘ এই ব্রিজটির সবচেয়ে বড় স্প্যানটি ১ হাজার ৫৯৫ ফুট। ৮৫ ফুট প্রশস্ত ও ২৭৬ ফুট উঁচু ব্রিজটির নিচে ক্লিয়ারেন্স বা খালি জায়গা রয়েছে ১৩৫ ফুট। লাইমস্টোন, গ্রানাইট ও রোজেনডাল সিমেন্ট ব্যবহারে নির্মিত হয়েছিল ব্রিজটি। ১৯১৫ সালে ব্রিজটির নাম সরকারিভাবে ‘ব্রুকলিন ব্রিজ’ ঘোষণা করা হয়।

 

টাওয়ার ব্রিজ, লন্ডন

খ্যাতির দিক দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যায় লন্ডনের টাওয়ার ব্রিজ। ব্রিজের ওপরে রয়েছে ৬৫ মিটার বিশাল দুটি টাওয়ার। এই দুই টাওয়ারের সঙ্গে হাঁটার পথ সংযুক্ত। যেখানে হেঁটে হেঁটে লন্ডনের অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করা গেলেও এখানে হাঁটা-চলা নিষেধ। এটি মাঝ বরাবর আলাদা হয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে পারে যাতে করে বড় আকারের কোনো জাহাজের নিচ দিয়ে চলে যেতে পারে। এক সময় দিনে ৫০ বারও ব্রিজটির মাঝের অংশ উপরে উঠানো হতো। কিন্তু এখন আর এতবার প্রয়োজন হয় না, দিনে সাত থেকে আট বার উঠানো হয়। টেমস নদীর ওপর অবস্থিত এ ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ২৬৯ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ মিটার। এ ব্রিজটি ১৯৭৩ সালের ১৭ মার্চ সবার ব্যবহারের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এখনো পর্যটকরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন, মাঝ বরাবর সিঁড়ির মতো খুলে যাওয়া এই ব্রিজটির দিকে। ফ্যাশন মডেলরা আসেন ছবি তুলতে। পর্যটকরা ব্রিজটির ওঠানামা দেখতেই মুখিয়ে থাকেন। ১৮৮৬ সালে ব্রিজটির নির্মাণ শুরু হয়। ব্রিজটি নির্মাণে সেই সময় ব্যয় করা হয়েছিল ১১ লাখ ৮৪ হাজার পাউন্ড।

 

গোল্ডেন গেট, যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর অহংকার বলা যায় গোল্ডেন গেট ব্রিজকে। শুধু নামেই গোল্ডেন গেট না কাজেও সোনার মতো দামি ও গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ এটি। দৃষ্টিনন্দন ব্রিজের তালিকা করলেও নাম চলে আসবে এটির। যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৌশলী জোসেফ বার্মেনের সেরা কাজ এটি। ১৯৩৭ সালে এই ব্রিজটি সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। সানফ্রান্সিসকোর পশ্চিম তীরের এই ব্রিজটি গোটা শহরের আইকন। এর রং নিয়েও চোখ ধাঁধানো ধাঁধা রয়েছে। রোদে পোড়া ব্রিজটি দেখতে লাল টকটকে হলেও আর্কিটেকচারের দল কিন্তু বলছে রংটি কমলা। না, শুধু কমলা বললে ভুল হবে, ইন্টারন্যাশনাল অরেঞ্জ বা ‘বিশ্ব স্বীকৃত কমলা’ বলাই ভালো। ঘন কুয়াশায় ব্রিজটি দেখতে মায়াবী। মনে হবে কুয়াশার চাদরে ডুবে গিয়েছে ব্রিজের অন্য প্রান্ত। কবি-সাহিত্যিকরা একটু এগিয়ে বলেছেন, কুয়াশায় স্বর্গের দুয়ারে গিয়ে বুঝি ঠেকেছে ব্রিজের অপর প্রান্ত! ৯০ ফুট প্রশস্ত বিশাল এই ব্রিজটি দৈর্ঘ্য ৭৪৬ ফুট। সবচেয়ে বড় স্প্যানটি ৪ হাজার ২০০ ফুটের! চমকে গেলেন? এ তথ্য শুনে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক।

 

পন্ত দু গার্ড, ফ্রান্স

দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রাচীন এক শহর ভার্স পন্ত দু গার্ড। গার্ডন নদীর গা ঘেঁষে থাকা এই শহরে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রোমান সাম্রাজ্যের স্থাপত্যের অভূতপূর্ব নিদর্শন। নিদর্শনটি নাম পন্ত দু গার্ড ব্রিজ। পাহাড়ের এ পার থেকে ও পারে পানি পৌঁছে দিতেই রোমান স্থপতিরা এই ব্রিজটি তৈরি করেন অন্তত ১ হাজার ৯৪০ থেকে ১ হাজার ৯৬০ বছর আগে। ফসিল থেকে লাইমস্টোন, দুর্লভ পাথর দিয়ে তৈরি এই ব্রিজটি নকশায় আর্চ ব্রিজের কাতারে পড়েছে। ধনুকের মতো বাঁকানো তিনটি পিলারসহ মোট ৫টি পিলার রয়েছে নদীর বুকে। শহরের মানুষের গোসল, রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজের সব ধরনের পানি পৌঁছে দিতেই এই অবিশ্বাস্য ব্রিজটি তৈরি করে রোমানরা। চতুর্থ শতাব্দীতেও গৌরবের সঙ্গে এই ব্রিজটি ঝরনার পানি বয়ে নিয়ে যেতে পারত। ব্রিজের ওপর দিয়ে চলাচলের গুরুত্ব পরবর্তীতে বাড়তে থাকে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরও এই ব্রিজ কখনো ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হয়নি এর গুরুত্বের জন্য। বর্তমানে এটি ফ্রান্সের অন্যতম পর্যটনপ্রিয় একটি স্থাপনা।

 

কলকাতার গল্প বলে হাওড়া ব্রিজ

কলকাতার নাম উচ্চারণ হলে সবার আগে চোখে ভেসে ওঠে হাওড়া ব্রিজ। কলকাতার পর্যটনপ্রিয় স্পট এটি। বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলের সঙ্গে এই ব্রিজের পরিকল্পনা, নকশা ও বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি হয়েছিল। কারিগরি কারণে ব্রিজের কিছু অংশ ইংল্যান্ডে তৈরি হয়। সে অংশগুলো পরে জাহাজে করে কলকাতা নিয়ে আসা হয়।

কলকাতা-হাওড়া ব্রিজ ১৮৭৪ সালে নির্মাণ শেষ হয়। ১,৫২৮ ফুট দীর্ঘ এবং ৬২ ফুট প্রশস্ত ব্রিজটির উভয় পার্শ্বে ৭ ফুট প্রশস্ত পায়ে চলার পথ ছিল। আর মাঝখানে ৪৮ ফুট প্রশস্ত পথ ছিল গাড়ি চলাচলের জন্য। ব্রিজটি তৈরি করতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৬০ লাখ রুপি। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে নতুন করে ব্রিজটি তৈরির কাজ শুরু হয় এবং ১৯৪২ সালে তা শেষ হয়। নতুন ব্রিজটি তৈরির জন্য ২৬ হাজার ৫০০ টন স্টিল ব্যবহৃত হয় । ব্রিজটি ৭০৫ মিটার লম্বা এবং ৩০ মিটার চওড়া।  ব্রিজটির উভয় পার্শ্বে ১৫ ফুট প্রশস্ত পায়ে চলার পথ আছে। যানবাহন চলাচলের পথটি ৭১ ফুট চওড়া।

 

সায়োসে পল, ইরান

পানির ওপর ইরানের সবচেয়ে দীর্ঘ স্থাপত্য সায়োসে ব্রিজটি। সায়োসে ব্রিজটির নির্মাণশৈলী এখনো স্থপতিদের বিস্ময় জাগায়। পানির ওপর দোতলা এই ব্রিজটি দেখে মনে হবে তোরণের ওপর তোরণ বসানো রয়েছে। আর্চ ব্রিজের দারুণ উদাহরণ এই ব্রিজটির নাম শুনলেই অনুমান বোঝা যাবে এতে তোরণ বা খিলান কয়টি। ফারসি ভাষায় সায়োসে মানে ৩৩ ব্রিজ বা ৩৩টি খিলান রয়েছে যে ব্রিজে। আল্লাহওয়ার্দি খান এই অনবদ্য ব্রিজটি নির্মাণ করেন। ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৫৯৯ সালে। শেষ হয় তিন বছর পর। ১৬০২ সালে এটি খুলে দেওয়া হয়। ২৯৮ মিটার দীর্ঘ এবং ১৩.৭৫ মিটার প্রশস্ত ব্রিজটিতে ৩৩টি স্প্যান রয়েছে। সবচেয়ে দীর্ঘ স্প্যানটি ৫.৬ মিটার উঁচু। ব্রিজটির স্থাপত্যশৈলীর কারিশমা অনেকেরই অজানা। জায়ান্দে নদীর ওপর থাকা ব্রিজটির নকশার কারণে পানির স্রোত হুট করেই বেড়ে যায়— যা অনেকে ভাবতেই পারেনি। দক্ষিণ প্রান্তে যেখানে ব্রিজটি এসে থেমেছে সেখানে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে পধচারীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিল। খিলান বা তোরণ বসানোর ক্ষেত্রে দারুণ আইডিয়া ছিল। দুই স্তরের তোরণ বসানোর মাঝে আরও একটি স্তরে তোরণ বসানো হয়। দুই তলা ব্রিজের পথচারীদের হাঁটার জন্য ব্রিজের দুইপাশেই ধনুকের মতো জানালা রয়েছে।

 

শত বর্ষ পেরোনো ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। নির্মাণের পর ১০০ বছর পেরিয়ে যাওয়া হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি রয়েছে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে। ব্রিটিশরা এই ব্রিজ তৈরি করতে সে সময়ই খরচ করে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ টাকা। ইতিহাস বলছে, দেশি-বিদেশি পর্যটকের যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে নদীর ওপর ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব পেশ করা হয়। ১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে তৎকালীন সরকার। ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৯১৪ সালের শেষের দিকে ব্রিজটির কাজ শেষ করে। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম মালগাড়ি চালানো হয়। দুই মাস পর ৪ মার্চ ডবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। সেদিনই ব্রিজটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হাডিঞ্জ। তার নামানুসারে ব্রিজটির নামকরণ হয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১০০ বছরের গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিল, এ সময়ের মধ্যে ব্রিজটির কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটবে না। সেটাই সত্যি হলো।

 

ইতিহাস জড়িয়ে সিলেটের ক্বিন ব্রিজ

ইতিহাসের সাক্ষী সিলেটের ক্বিন ব্রিজ। সিলেটের প্রবেশদ্বার বলা যায় একে। সুরমা নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজটি। গত শতকের তিরিশের দশকের দিকে তৎকালীন আসাম প্রদেশের গভর্নর ছিলেন মাইকেল ক্বিন। দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে একবার তিনি সিলেট পরিদর্শনে এলে তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতেই এ ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছিল। রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৩৬ সালে ব্রিজটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ক্বিন ব্রিজের প্রধান কাঠামোটি লৌহ নির্মিত। এর আকৃতি অনেকটা ধনুকের ছিলার মতো বাঁকানো। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ১১৫০ ফুট এবং প্রস্থ ১৮ ফুট। এই ব্রিজটি নির্মাণে তখনকার দিনেই ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজের উত্তর পাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর প্রথম দিকে কাঠ ও বেইলি পার্টস দিয়ে বিধ্বস্ত অংশটি মেরামত করা হয় এবং ব্রিজটি হালকা যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর