বৃহস্পতিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আলোচিত বিমান ছিনতাই

রণক ইকরাম

আলোচিত বিমান ছিনতাই

রাইট ভ্রাতৃদ্বয়কে উড়োজাহাজের আবিষ্কারক হিসেবে গণ্য করা হলেও এমন একটি যন্ত্রের চিন্তাভাবনা প্রথম শুরু হয় ১৮৯৬ সালের আগ থেকেই। জার্মান ইঞ্জিনিয়ার অটো লিলিয়েনথালের মাথায় উড়ন্ত যানের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। এ নিয়ে বেশ গবেষণাও সারেন তিনি। তার তৈরি যান আকাশে উড়লেও একটার পর একটা সমস্যা দেখা দিত। ১৮৯৬ সালে লিলিয়েনথালের মৃত্যুতে গবেষণাটি থমকে যায়। কিন্তু তত দিনে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় লিলিয়েনথালের উড়ন্ত যানের নকশা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। অসম্পূর্ণ এবং ভুলে ভরা আখ্যা দিয়ে এটিকে কেন্দ্র করেই শুরু হলো তাদের নতুন প্রচেষ্টা। অনেক চড়াই-উত্রাই পেরিয়ে নানা গবেষণা-অধ্যবসায় শেষে ১৯০৩ সালে ধরা দিল সেই স্বপ্নের দিন। বছরের শেষ দিকে ১৭ ডিসেম্বর অরভিল এবং উইলবার রাইট তাদের তৈরি বিমান উড়িয়ে দিলেন। এরপর থেকেই উত্তরোত্তর গবেষণা আমাদের সব প্রযুক্তির পাশাপাশি বিমানকেও করেছে সমৃদ্ধ। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, তেমনি কঠিনও করে দিয়েছে। আবার অনেক কাঠিন্যের কারণ মানুষ নিজেই। বিমান তৈরির প্রায় ৪৫ বছর পর মহাকাশে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটল— যা নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বকে। ১৯২৮ থেকে শুরু করে ২০১৮ পর্যন্ত প্রায় ১৪০টিরও বেশি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। আজ আমরা জানব ইতিহাসের আলোচিত কয়েকটি বিমান ছিনতাইয়ের গল্প।

 

ইতিহাসের প্রথম

১৬ জুলাই ১৯৪৮

বিমান ছিনতাইয়ের ইতিহাসকে খুব বেশি প্রাচীন বলা যাবে না। তবে উড়োজাহাজ বা বিমানকে আধুনিক সভ্যতার অনুষঙ্গ ভাবলে ছিনতাইয়ের ইতিহাসকে কোনোমতেই নতুন বলা যাবে না।

ইতিহাসের প্রথম বাণিজ্যিক বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি ঘটে বিমান আবিষ্কারের প্রায় ৪৫ বছর পর। ১৯২৮ সালে বিমান ছিনতাইয়ের কথা বলা হলেও স্বীকৃত বিমান ছিনতাই ১৯৪৮ সালে। তারিখটি ছিল ১৬ জুলাই, ১৯৪৮। যদিও ছিনতাইকারীরা বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়েছিল, এরপরও ছিনতাইয়ের পরিণতিস্বরূপ বিমানটি ম্যাকাও সাগরে বিধ্বস্ত হয়েছিল। সে সময় ঘটনাটি বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ম্যাকাও থেকে হংকং যাওয়ার পথে ‘ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারওয়েজ’ এর ‘ক্যাটেসিনা বিমান’টি উড্ডয়নের মাত্র কয়েক মিনিট পরই ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে। ওয়ং উ ম্যান নামক একজনের নেতৃত্বে মোট চার বন্দুকধারীর ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্য ছিল যাত্রীদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা। আর সেই লক্ষ্যে ডাকাতদের একজন বিমানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের জন্য পাইলটকে নির্দেশ দিল। কিন্তু বিমানের চালক তার কথা শুনল না। উল্টো হাইজ্যাকাররা পাইলটের কাছ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হলো। কো-পাইলটও প্রধান পাইলটের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। আর বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হাইজ্যাকাররা পাইলটকে গুলিবিদ্ধ করে। তখন বিমানটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে এবং ম্যাকাও সাগরে পতিত হয়। বিমানে সর্বমোট ২৬ যাত্রী ছিল বলে জানা যায়। এদের মধ্যে কেবল একজনই বেঁচে ছিলেন। আর তিনি সেই ডাকাত দলের নেতা ওয়ং উ ম্যান। পরবর্তী সময়ে তার স্বীকারোক্তি থেকেই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি পরিষ্কার হয়। প্রথমে কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ববাসী এটিকে নিছক একটি দুর্ঘটনা বলেই ভেবেছিল। কিন্তু বিমানের ধ্বংসস্তূপ থেকে গুলিবিদ্ধ অংশ খুঁজে পেলে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তখন বেঁচে যাওয়া একমাত্র যাত্রী হংকং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওয়ংকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। তার পাশের শয্যায় পুলিশ নিজেদের একজনকে রোগী সাজিয়ে শুইয়ে রাখে। ওয়ংয়ের পাশের সেই রোগীর সঙ্গে কথার ফাঁকেই প্রকাশ হয়ে পড়ে পৃথিবীর প্রথম বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা।

 

দুঃস্বপ্নের নাইন ইলেভেন

১১ সেপ্টেম্বর ২০০১

যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী বিমান হামলায় পাল্টে যায় গোটা পৃথিবীর চেহারা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই বিমান হামলার ঘটনা ঘটে। আল-কায়েদার ১৯ জঙ্গি চারটি বিমান ছিনতাই করে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলা চালায়। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্র নিউইয়র্ক সিটিতে প্রথম আঘাত হানে জঙ্গিরা। স্থানীয় সময় তখন ৮টা ৪৬ মিনিট। ‘টুইন টাওয়ার’ হিসেবে পরিচিত বিশ্বের অন্যতম উঁচু দালানটিতে আঘাত হানে সন্ত্রাসীদের দখল করা দুটি যাত্রীবাহী বিমান। ওয়াশিংটনের পেন্টাগন ভবনেও হামলা চালায় আরেকটি বিমান। এ ছাড়া পেনসিলভানিয়ায় আরেকটি বিমান দিয়ে হামলার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হামলার আগে সাংকেতিক বার্তার মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করতেন। এই হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে আবু আবদুর রহমান নামের এক পরিকল্পনাকারী তার বান্ধবীকে এমনি এক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তিনি লেখেন, ৩ সপ্তাহের মধ্যে প্রথম সেমিস্টার শুরু হবে। দুটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (টুইন টাওয়ার) এবং দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তু) এ গ্রীষ্মে নিশ্চিতভাবে অনেক গরম পড়বে। ব্যক্তিগত পড়াশোনায় ১৯টি সনদপত্র (হামলায় অংশগ্রহণকারী হাইজ্যাকারদের সংখ্যা) এবং ৪টি পরীক্ষা (হামলায় ব্যবহৃত বিমান)। অধ্যাপককে আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। হামলার পর ঘটনাস্থলে এক মাস ধরে আগুন জ্বলেছিল। তবে কেউ কেউ জানান, হামলার ৯৯ দিন পর পর্যন্ত আগুন জ্বলার প্রমাণ রয়েছে। তারা জানান এ আগুন ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত জ্বলেছিল।

৪টি বিমান ওই হামলায় অংশ নিয়েছিল। দুটি বিমানের লক্ষ্য ছিল নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর ও দক্ষিণ টাওয়ার। অন্য একটি বিমান আঘাত হেনেছিল পেন্টাগনে, যেটির অবস্থান ওয়াশিংটনের ঠিক বাইরেই। আর চতুর্থ বিমানটি আছড়ে পড়েছিল পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে। ওই হামলায় তিন হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছিল। আহত হয়েছিল আরও ১০ হাজারের মতো মানুষ। তাদের অনেকের অবস্থাই ছিল গুরুতর।  প্রথমে মনে করা হয়েছিল বিমানের পাইলট হয়তো মাতাল হয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কিন্তু ১৮ মিনিটের মাথায় ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের আরেকটি বোয়িং৭৬৭ বিমান সাউথ টাওয়ারের ৬০তম তলায় ঢুকে পড়ে। স্থানীয় সময় ৯টা ৪৫ মিনিটে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের আরেকটি বোয়িং৭৫৭ বিমান আঘাত হানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দফতর পেন্টাগনের পশ্চিম অংশে। ওই হামলায় পেন্টাগনের ১২৫ জন সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। এ ছাড়া হামলাকারী বিমানের ৬৪ জন আরোহীর সবাই ঘটনাস্থলেই মারা যান। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ঠিক কেন্দ্রে এ হামলার ১৫ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের সাউথ টাওয়ারটি ধসে পড়ে। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১০টায় ধসে পড়ে অপর টাওয়ারটিও। নিউজার্সির ন্যুয়ার্ক বিমানবন্দর থেকে চতুর্থ বিমানটি উড়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশে। বিমানটি ছিনতাইয়ের পর যাত্রীরা বুঝতে পেরেছিলেন কী হতে চলেছে। কয়েকজন যাত্রী অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ককপিটে হামলা করেন, বাধা দেন ছিনতাইকারীদের। ১০টা ১০ মিনিটে পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে আছড়ে পড়ে বিমানটি।

হামলাকারীরা বিমানটিকে আসলে কোথায় নিতে চেয়েছিলেন সেটি পরিষ্কার নয়। এ হামলা প্রচণ্ড উদ্বেগ তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রে। নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশকে সারা দিনই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টায় হোয়াইট হাউসে ফেরেন তিনি। রাত ৯টায় দেশবাসীর উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। যুক্তরাষ্ট্র তার ভাষায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী এক যুদ্ধ শুরু করে।

 

ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট

২৩ নভেম্বর ১৯৯৬

ইথিওপিয়ার তিন নাগরিক অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ৯৬১ ফ্লাইট ছিনতাই করে। আদ্দিস আবাবা থেকে নাইরোবিগামী বিমানটি ছিনতাইকারীরা অস্ট্রেলিয়ায় নেওয়ার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু সেখানে যাওয়ার মতো প্রয়োজনীয় জ্বালানি ছিল না। পরে বিমানটি নিয়ে কমোরোস দ্বীপে অবতরণের চেষ্টা করেন পাইলট। কিন্তু সে পর্যন্তও পৌঁছাতে পারেনি বিমানটি। তার আগেই বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় ১৭২ যাত্রীর মধ্যে ১২২ জন নিহত হয়।

 

ভারতীয় ফ্লাইট ৮১৪

২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯

১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮১৪ নামের একটি যাত্রীবাহী বিমান নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছিল। ভারতের আকাশসীমায় আসার পরপরই ছিনতাইয়ের কবলে পড়ল। পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী দল হরকাতুল মুজাহিদীন এই ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। ছিনতাইয়ের মূল কাণ্ডটি ঘটায় একজন সশস্ত্র লোক। সে বোমা  মেরে বিমানটি উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিল এবং চালককে বিমানের গতিপথ পাল্টে পূর্ব দিকে উড্ডয়নের জন্য নির্দেশ দিল। সেই অনুসারে অমৃতসর, লাহোর, দুবাই ছুঁয়ে শেষ পর্যন্ত হাইজ্যাকাররা বিমানটিকে আফগানিস্তানের কান্দাহারে অবতরণ করতে বাধ্য করে। দুবাইতে তারা ১৭৬ যাত্রীর মধ্যে ২৭ জনকে মুক্তি দেয়। কিন্তু ১ জনকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং আরও কয়েকজনকে আহত করে। ছিনতাইকারীদের দাবি অনুসারে ভারত সরকার তাদের হাতে বন্দী মুশতাক আহমেদ জারগার, আহমেদ ওমর সৈয়দ শেখ এবং মাওলানা মাসুদ আজহারকে মুক্তি দিলে ৭ দিনের ছিনতাই নাটকের অবসান ঘটে। এই ছিনতাইয়ের ঘটনাটিকে ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ও শ্বাসরুদ্ধকর বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা মানা হয়।

 

ডিবি কুপার হাইজ্যাক

২৪ নভেম্বর ১৯৭১

২৪ নভেম্বর ১৯৭১ সালে ইতিহাসের আরেকটি আলোচিত বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এবার বিমানের ছিনতাইকারী একজন রহস্য মানব। যাকে ইতিহাসে ডিবি কুপার নামে ডাকা হয়। তিনি বোয়িং ৭২৭ নামের একটি বিমান ছিনতাই করে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেন। মজার ব্যাপার হলো— ডিবি কুপারের এই মামলা এখনো পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। এফবিআই কর্মকর্তারা এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেননা কুপারকে এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। যদিও কয়েক দিন আগে খবর বেরিয়েছিল, কুপার মারা গেছেন। তবুও এই রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে।

ছিনতাইয়ের ঘটনায় সম্পৃক্ত সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি ভুয়া পরিচয়ে ডেন কুপার নামে বিমানের টিকিট কেনেন। বিমানটি ছিনতাইয়ের পর তিনি তৎকালীন ২ লাখ আমেরিকান ডলার মুক্তিপণ গ্রহণ করেন এবং সেখান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে পালিয়ে যান। এরপর সেই টাকা তো দূরে থাক, মানুষটাকে পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি। বিমানে জিম্মি হিসেবে থাকা ৩৬ যাত্রী এবং ৬ ক্রুর সবাই জীবিত ছিলেন।

 

 

ছিনতাইয়ের বিমান ঢাকায়

২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর।

ফ্লাইট ৪৭২ নামের একটি জাপানি বিমান ১৫৬ জন যাত্রী নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে জাপানের টোকিওর হেনাডা বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছিল। এই বিমানের যাত্রাবিরতি ছিল ভারতের মুম্বাইয়ে। সেখান থেকে যাত্রাবিরতির পর ভালোয় ভালোয় উড়ছিল ফ্লাইট ৪৭২। কিন্তু মুম্বাই থেকে ওড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। বিমানটি ছিনতাইয়ের কবলে পড়েছে। জাপানের বামপন্থি সংগঠন ‘ইউনাইটেড রেড আর্মি’ বিমানটি ছিনতাই করে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ওসামো মারোয়াকার নেতৃত্বে বামপন্থি সশস্ত্র সংগঠনের মোট ৫ ছিনতাইকারী বিমানটি ছিনতাই করে নিয়ে আসে ঢাকা বিমানবন্দরে। ঢাকায় অবতরণের পর ছিনতাইকারীরা যাত্রীদের ছাড়ানোর জন্য ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং জেলে থাকা তাদের সংগঠনের ৯ সদস্যের মুক্তি দাবি করে। ১ অক্টোবর জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকিও ফুকুদা ঘোষণা করেন যে, সরকার ছিনতাইকারীদের দাবি মেনে নিতে রাজি আছে। তখন ছিনতাইকারী সংগঠনের ৬ কর্মীকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরের দিন ২ অক্টোবর জাপান এয়ারলাইন্সের চার্টার্ড বিমানে করে মুক্তিপণ হিসেবে টাকা ও ছয় রেড আর্মি বন্দীকে নিয়ে আসা হয়। একই দিনে তাদের মধ্যে বিনিময় হয়। ওইদিন হাইজ্যাকাররা ১১৮ যাত্রী এবং ক্রুকে মুক্তি দেয়। পরের দিন অর্থাৎ অক্টোবরের ৩ তারিখ ছিনতাইকারীরা বিমানটি নিয়ে সিরিয়ার দামেস্কে পৌঁছায়। সেখানে তারা আরও ১১ জিম্মিকে মুক্তি দেয়। শেষমেষ বিমানটি আলজেরিয়ায় উড়ে যায়। সেখানে বিমানটি কর্তৃপক্ষের দ্বারা বাজেয়াপ্ত হয় এবং বাকিদেরও মুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন বিদেশি বিমান ছিনতাইয়ের এই খবরটি ফলাও করে প্রচার হচ্ছিল, তখন খোদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই চলছিল অস্থিরতা। জাপানি বিমান ছিনতাই রক্তপাতহীনভাবে শেষ হলেও সেই সময়কার ঘটনায় রক্তস্নাত হয়েছিল বাংলাদেশ।

 

ইজিপ্ট ফ্লাইট ৬৪৮

২৩ নভেম্বর ১৯৮৫

এটিকে ইতিহাসে ভয়াবহতম বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোর একটি মনে করা হয়। এটি ছিল আবু নিদাল সংগঠনের ভয়াবহতম হামলাগুলোর একটি। এই হামলা অনেকগুলো মৃত্যুর কারণ হয়েছিল বলে এটিকে ভয়ঙ্কর বিমান হাইজ্যাকের ঘটনা বলা হয়।

১৯৮৫ সালের ২৩ নভেম্বর উড্ডয়নের মাত্র ১০ মিনিট পরই সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিমানটি আক্রান্ত হয়। নিজেদের ইজিপ্ট রেভ্যুলুশন পরিচয় দেওয়া ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী দলটি ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গ্রেনেডে সজ্জিত ছিল। পুরো দলটি বিমানটি নিয়ন্ত্রণে উঠেপড়ে লাগে। এই দলের নেতা ওমর রাজ্জাক যাত্রীদের পাসপোর্ট কেড়ে নিতে শুরু করলেন। তখন ইজিপশিয়ান সিকিউরিটি অফিসার গুলি চালালে সেখানেই একজন সন্ত্রাসী নিহত হয়। আর এতে করে বিমানটির মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং ছিনতাইকারীরা নৃশংস হয়ে ওঠে। যার ফলে ১২টির বেশি প্রাণ ঝরে যায়। বিমানটির মূল গন্তব্য ছিল লিবিয়া। কিন্তু ফুয়েলের অভাবে তারা মাল্টায় অবতরণে বাধ্য হয়েছিল। 

 

প্রথম ব্রিটিশ বিমান

৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭০

ডসনের ফিল্ড হাইজ্যাকিংয়ের অংশ হিসেবে সন্ত্রাসীরা নিয়মিত বিমান ছিনতাই শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে ১৯৭০ সালে তারা একযোগে চারটি বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে। আর এর মধ্যে একটি বিমান ছিল ইংল্যান্ডের। এ বিমানটিই ছিল ছিনতাইয়ের কবলে পড়া প্রথম ব্রিটিশ বিমান। ১৯৭০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতের কাছে বিওএসির ‘সুপার ডিসি-১০’ বিমানটি ১১৪ জন যাত্রীসহ ছিনতাই করে ফিলিস্তিন মুক্তির জন্য গঠিত পপুলার ফ্রন্টের গেরিলারা। অস্ত্রধারী গেরিলারা বিমানচালককে জর্ডানের আম্মানের উত্তর-পশ্চিমে একটি বিমানবন্দরে নামতে বাধ্য করে। এর আগে তারা ওখানেই সুইস বিমান ডিসি-৮ এবং টি ডব্লিউ বোয়িং-৭০৭ বিমান ১৮৪ জন যাত্রীসহ ছিনতাই করে। লন্ডনে আটক গেরিলানেত্রী লায়লা খালেদ এবং সুইজারল্যান্ড ও জার্মানিতে আটক অন্য আরব বন্দীদের মুক্তির দাবিতে তারা ওই বিমান ছিনতাই করে। তাদের এই ছিনতাই প্রচেষ্টা যেমন সফল হয়েছিল, তেমনি তাদের উদ্দেশ্যও চরিতার্থ হয়েছিল। যথাযথ কর্তৃপক্ষ জিম্মিদের জীবনের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত গেরিলাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। ফলে গেরিলারা তিনটি বিমান উড়িয়ে দিলেও লায়লা খালেদ এবং অন্যদের বিনিময়ে তারা সব যাত্রীকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর